শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী এই মহান ব্যক্তিত্ব চির নিদ্রায় শায়িত হন নিজ বাড়িতে তাঁরই নির্মিত মসজিদের পাশে। আপাতদৃষ্টিতে বলা যায় কয়েস চৌধুরী ছিলেন একজন সফল মানুষ। অর্থ-বিত্ত, সামাজিক মর্যাদা এবং প্রভাব প্রতিপত্তিসহ সামগ্রিক বিচারে তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন অর্থবহ, সফল ও সার্থক বলেই আমরা মনে করি। বেঁচে থাকাকে তিনি শুধু উপভোগ করেননি, সবার সাথে ভালোভাবে বেঁচে থাকতে এবং নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে সুখী হতে চেয়েছেন। মানুষের মাঝে বেঁচে থাকার সুখানুভূতি তাঁকে উদ্বেলিত এবং আনন্দিত করতো। এই মহান ব্যক্তি সম্পর্কে বলতে গেলে স্বল্প পরিসরে বলা সম্ভব নয়, তবু সংক্ষেপে তাঁর একজন ভোটার তথা নির্বাচনী এলাকার মানুষ হিসেবে আমি দু’একটা কথা একটা তুলে ধরছি।
পৃথিবীর অন্যতম উন্নততর দেশ যুক্তরাজ্যে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার মধ্যে সুখে-শান্তিতে, নির্ঝঞ্ঝাটে বসবাসের সুযোগ থাকা সত্বেও তিনি দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করার জন্য বাংলাদেশে থাকতেন। আমরা (প্রবাসীরা) অনেকেই যা করতে পারি না, তিনি তা করে দেখিয়ে গেছেন। শুধুমাত্র এমপি নাম লাগানোর খায়েশ থাকলে ইংল্যান্ডেও সেটা করতে পারতেন। বরং এখানে (ইংল্যান্ডে) করলে টাকা এবং পরিশ্রম দুটোই অনেক কম লাগতো। জনসেবার ক্ষেত্র হিসেবে তিনি নিজের মাতৃভূমি বা দেশকেই বেছে নিয়েছিলেন, এটা অবশ্যই নিখাদ দেশপ্রেম। তিনি একদম শিখরে থেকেও মূলত: থাকতে চেয়েছেন নিজ শেকড়কে আঁকড়ে ধরে। তাঁর এ মাটির টানে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্তের মাঝে তুলনাহীন এক মহানুভবতার পরিচয় মেলে যা আমাদের সবার জন্য শিক্ষনীয়। এই মহান ব্যক্তির জীবন ও কর্ম থেকে সত্যিই আমাদের শেখার অনেক কিছুই আছে।
বাংলাদেশে অনেক কষ্ট, অনেক ত্যাগ এবং অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে প্রায় তিন যুগের সক্রিয় রাজনীতি তাঁকে যা দিয়েছে, এর-চে অনেক বেশী তিনি দিয়ে গেছেন দেশ এবং দেশের মানুষকে। অন্তত ২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারি মহান জাতীয় সংসদে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিল উত্থাপন করার কারণে তিনি গোটা বাঙালি জাতির ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। বাংলাদেশের অনেক এমপি যা বিগত চার দশকে সাহস করে করতে পারেননি, মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী সেটা করতে পেরেছিলেন। তিনি নিজেই বলতেন ‘আমি সাহসী নই, দুঃসাহসী’। সত্যিই তিনি তাই ছিলেন এবং বুকের পাটা সেরকম বড় মাপের ছিলো বলেই যুদ্ধাপরাধীদের বিষাক্ত লেজ ধরে টান দেবার দুঃসাহস করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিলো।
আমরা যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে অনেকের বাণী ও বচন শোনে মুগ্ধ হই, এ বিষয় নিয়ে বক্তৃতার ফুলঝুরি ফোটানো নেতাদের পেছনে দাঁড়িয়ে সেলফি তোলে কৃতার্থ হই। কিন্তু কাজে এবং কথায় মিল আছে এমন মানুষ খুব একটা দেখি না! কয়েস চৌধুরী ছিলেন কাজে ও কথায় মিল থাকা একজন মানুষ। তিনি যা করে দেখিয়েছেন, তা আমাদের গোটা জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করার একটা দলিল হয়ে চির ভাস্বর থাকবে। আমরা নেতাদের রাজনৈতিক কমিটমেন্ট এবং মন মননের শুদ্ধতার নজির দেখে মুগ্ধ হই না, কিন্তু কারও কারও চটকদার ভন্ডামী দেখে আপ্লুত হই! কয়েস চৌধুরী ছিলেন একজন শুদ্ধ পুরুষ, ভন্ডামী ছিলো তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। তাই রাজনৈতিক জীবনে অনেক খাড়া পাহাড় বেয়ে তাঁকে উঠতে হয়েছে। সামাজিক জীবনেও তাঁকে সোজাসাপ্টা কথা বলার কারণে যথেষ্ট মূল্য দিতে হয়েছে।
আমাদের দেশের রাজনীতিতে পিচ্ছিল পথ বেয়ে অত্যন্ত সন্তর্পণে এগুতে হয়, যেখানে পা পিছলে যাওয়া মানে হেরে যাওয়া। আমি দেশের রাজনীতিকে ঢালাওভাবে দোষ দিচ্ছি না, বরং মনে করি- এখনো রাজনৈতিক সততা বিলীন হয়ে যায়নি। তবে নির্দ্ধিধায় বলতে পারি- বাংলাদেশের রাজনীতিতে সততা এবং মেধার মূল্যায়ণ খুব কম হয়। বিভিন্ন কারণে মেধাবীরা রাজনীতি থেকে সরে যান, শুদ্ধ করে বললে বলা যায় ‘সরিয়ে দেয়া হয়’। এজন্য শুধুমাত্র আমাদের দলীয় রাজনীতি বা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি দায়ী নয়, বরং অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়াদিও জড়িত। জনগণ সবই বোঝতে পারে, কোন কোন ক্ষেত্রে সমর্থনও করে। যেখানে রাজনৈতিক যোগ্যতার ক্ষেত্রে আর্থিক দূর্নীতি কোন ব্যতিক্রম তৈরী করে না, সেখানে দূর্নীতি রাজনীতি দ্বারা আশ্রিত বা লালিত হবেই। মানুষ এসব অনেকটা স্বাভাবিক বলেই ধরে নেয়।
তবে আমরা দেখেছি, একজন কয়েস চৌধুরীর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে দল বা ক্ষমতা বিক্রি করে টাকা কামানোর কোন নজির নেই। উপরন্তু তিনি নিজের উপার্জিত অর্থ মানুষের ও দলের কল্যাণে অকাতরে বিলিয়ে গেছেন, যা তাঁর নির্বাচনী এলাকা তথা সিলেটের আপামর মানুষের জানা আছে। বিদেশ থেকে কেউ ফোন করে বলে ‘এমপি সাহেব, আমার বাড়িতে খাবার নেই’ তিনি বাজার সদাই করে পৌঁছে দেন। এরকম সাংসদ দেশে আর কেউ আছেন বলে আমরা জানি না। বরং পদবীর জোরে টাকার কুমিরে পরিণত হওয়া অনেকের নাম ঠিকানা আমরা জানি। মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী দুর্দিনে দলকে অনেক দিয়েছেন, কর্মিদের কাছে তাই তিনি যোগ্যতম আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। দলের কোন গুরুত্বপূর্ণ পদে না থাকলেও গণমানুষের নেতা হয়ে মৃত্যু বরণ করার সৌভাগ্য তাঁর হয়েছিলো, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তিনি শিক্ষা বিস্তারের জন্য উল্লেখযোগ্য কাজ করে গেছেন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াও নিজ উদ্যোগে তিনি অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেছেন। সদালাপী, বিনয়ী এবং নিপাট ভদ্রলোক কয়েস চৌধুরী মানুষের সাথে খুব সহজে মিশে যেতে পারতেন এবং মানুষের ব্যথা-বেদনা তাঁকে কষ্টে জর্জরিত করতো। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কলঙ্কিত রাতে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা তাঁর হৃদয়ে দাগ কেটে ছিলো। ঐদিন শিশু রাসেলের করুণ মৃত্যু তাঁকে সবচেয়ে বেশী কষ্ট দিয়েছিলো। একটা অবুঝ শিশুকে নৃশংস ভাবে হত্যা করা কোন সভ্য সমাজ মেনে নিতে পারে না, কিন্তু আমাদের দেশে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার রহিত করা হয়েছিলো। কয়েস চৌধুরীর নরম হৃদয়ে অদেখা এই শিশুকে ঘিরে জন্ম নিয়েছিলো এক আকাশ সমান ভালোবাসা, তাই তিনি শেখ রাসেলের নামে গড়ে তুলেছিলেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। ‘শেখ রাসেল জাতীয় শিশু কিশোর পরিষদ’ গড়ে তোলা ছিলো তাঁর এক অনন্য কীর্তি। তাঁর গড়া এসব সংগঠন ও স্থাপনা এবং প্রতিষ্ঠান কালের সাক্ষী হয়ে আমাদের চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে। শুধু তিনি এখন আর নেই, যার অকৃত্রিম ভালোবাসায় এগুলো তৈরী হয়েছিলো।
এতো সুন্দর মনের, পরিপাটি, সুদর্শন, ব্যক্তিত্ববান এবং সুশিক্ষিত এই মানুষটি এতো তাড়াতাড়ি চলে যাবেন, তা আমরা কল্পনাও করিনি। তাঁর অকাল প্রয়াণের কথা ভাবলেই মন ভারী হয়ে ওঠে। বিশাল একটা নির্বাচনী এলাকা, আরও অনেক কিছু হয়তো করার পরিকল্পনা ছিলো। আমি তাঁর উন্নয়নের ফিরিস্তি টানতে চাই না, তবে নিজে যেমন কাজ করতেন, তেমনি কাজ করার জন্য সবাইকে উৎসাহ এবং পরামর্শ দিতেন।
আমি বিশ্বাস করি, গণমানুষের নেতা মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী কয়েস অনাদিকাল মানুষের ভালোবাসায় বেঁচে থাকবেন। তিনি মানুষের কল্যাণে কাজ করার জন্য নিজেকে যেভাবে বিলিয়ে দিয়েছেন, তা ইতিহাস হয়ে থাকবে। তাঁর মহাপ্রয়াণে সবার মতো আমিও শোকাহত। তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে, তবে অনেক কিছু রেখে গেছেন। যা অনাদিকাল থেকে যাবে, তাঁর শূন্যতা অথবা না থাকা জুড়ে।
লেখক: কবি, সাধারণ সম্পাদক – প্রবাসী বালাগঞ্জ ওসমানীনগর এডুকেশন ট্রাস্ট