শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৫ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাবীব নূহ

ইফতারের বারোটা



বেশ ক’বছর আগের এ ঘটনা। ইংল্যান্ডের কোন এক জায়গা। বাংলাদেশী ওডিয়েন্স। তারা সেখানে জড়ো হয়েছেন রামাদ্বানের সচেতনতা সৃষ্টির নিমিত্তে আয়োজিত প্রোগ্রামে। সেখানে রামাদ্বানের পর্যালোচনার পর শ্রোতাদের অনুভূতি ও ভাবনার কথা ‘শায়েখ’ শুনতে শুরু করলেন। আড়াল থেক উচ্চ পদস্থ সরকারি চাকরিজীবী একজন মহিলা তার অনেস্টি প্রকাশ করে বলতে লাগলেন, “সত্যি হল আমি সাওম ধরতে পারি না, এখন আমাকে কি করতে হবে,’শায়েখ’। আমি যেহেতু চাকুরি করি এজন্য সাওম পালন করতে পারি না কারণ, আমি তো আর অফিসে ইফতার করতে পারবো না।”

‘শায়েখ’ জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি ইফতার বলতে কি বুঝেন?” জবাবে তিনি বল্লেন, “এই তো, আমার আম্মারা যে রকম খেজুর, খিচুড়ি, চানা, সামুসা ইত্যাদি দিয়ে টেবিল সাজিয়ে বসে দুআ-দুরুদ করেন তা-ই তো ইফতারি, ইফতার।”

‘শায়েখ’ শুনে বল্লেন, “বোন! আপনার অনেস্টির জন্য ধন্যবাদ, এবং আপনার খটকাটা কোথায় আমি বুঝতে পেরেছি। আসলে, আপনি যা প্রকাশ করেছেন, তা হল আমাদের ‘ট্রেডিশন’ ‘কালচার’ বা সংস্কৃতি ও কৃষ্টি। এগুলো সব ভুল, তা কিন্তু নয়, আবার এ গুলোই ইসলাম তা কিন্তু নয়। আমরা সাওম পালন করি আল্লাহর আদেশ মান্য করতে। সাওম কি ভাবে পালন করতে হবে, তা আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পালন করে ভাল করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। আপনি খাবারের যে পদগুলির কথা বল্লেন তা থেকে খেজুর ছাড়া অন্য কিছুই তো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইফতারিতেই শুধু নয়, বরং সাধারণ সময়েও কোন দিনই তো খাননি তারপরও তিনি পৃথিবীর সেরা সাওম পালন করে গেছেন।”

অনেস্ট মহিলা আশ্চর্য হলেন। ‘শায়েখ’ আরো বল্লেন, সাওম পালন ভিন্ন বিষয় আর ইফতার করা আলাদা বিষয়। সাওমের সাথে ইফতারের সম্বন্ধ এরকম যে আপনার শরীরের কাপড় পরা আর হাতের চুড়ি পরা। কাপড় পরা জরুরী, চুড়ি পরা সৌন্দর্য। সাওম পালন ফারদ্ব তথা অবশ্যই পালনীয়,পরন্তু ইফতার করা মুসতাহাব তথা সুন্নাহ। তার মানে ইফতার সারাটা ভাল, অত্যাবশ্যক নয়।

অনেস্ট মহিলা, অহ্ বলে আরো তাজ্জব হওয়ার জানান দিলেন। ‘শায়েখ’ কথা চালিয়ে গলেন। তিনি বল্লেন, সাওম শেষ হয়ে যায় মাঘরিবের তথা সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে, তার অর্থ সাওম হল নির্দিষ্ট সময় পার করা। ধার্য করা সময়ের ভিতর কিছু বিষয় থেকে বিরত থাকা হল সাওম, অবশ্য সাথে নিয়ত বা সংকল্প থাকতে হবে। যখনই সূর্য, দিগন্ত থেকে পুরো আড়াল হয়েছে বলে আপনার পুরো বিশ্বাস হবে তখনই আপনার সাওম পুরো হয়ে গেছে। তেমন কঠিন নয় এ সাওম পালন। এখানে মনোবলটাই বেশি দরকার। আপনি যে কোন নির্জন দ্বীপে একাকী বসে অনায়াসে যেমন সাওম পালন করতে পারবেন তেমনি লোকালয়ের কোলাহল অথবা অফিসের গোলমালের মধ্যেও তা আদায় করতে পারবেন। যখনই সূর্যাস্ত হবে তখনই একটি সাওম সম্পূর্ণ হবে, কিছু খান অথবা না খান। ফজর থেকে শুরু হওয়া সাওমটি মাঘরিবের সাথ সাথেই শেষ হয়ে যাবে। এ ভাবে একটি সাওম পালনের দায়িত্ব শেষ হবে। ‘শায়েখ’ আরো অগ্রসর হয়ে বল্লেন,বোন! এবার ইফতার নিয়ে কথা বলছি শুনুন।

সারা রাত ঘুম শেষে প্রভাতে যখন কিছু খাবার খেলেন, এই খাদ্য গ্রহণ বা জলখাবারকে নাশতা, প্রাতরাশ, ইংরেজিতে Breakfast এবং আরবিতে ইফতার ও ফুতুর বলা হয়। তেমনি সারাদিন নিষ্পুণ্য উপোস থেকে অথবা পূণ্যময় সাওম পালন শেষে, বেলা ফুরালে যে হালকা খাবার খাওয়া হয় (হাল জামানায় নিশ্চয় হালকা নয় বরং ভারী, মহা-ভারী এবং মেগা ভারি) সে খাবার গ্রহণের নামই তো breakfast, ফুতুর, ইফতার ইত্যাদি।

ডান কনুইকে টেবিলে ঠেকিয়ে, উঁচু করা হাতের আঙুলে চেপে ধরা কলমটি নাড়াতে নাড়াতে এক সময় হাত ক্লান্ত হয়ে যায় শায়েখের।হয়ত সে কারণে হঠাৎ কলমটি খসে পড়ে হাত থেকে। ‘শায়েখ’ কথা বন্ধ করে মেঝের দিকে তাকালেন। কেউ একজন কলমটি কুড়িয়ে দিলেন। ‘শায়েখ’ আবার বুঝাতে শুরু করলেন এ ভাবে যে, এই ইফতার খাওয়া ছাড়াও সাওম পালন হবে তবে ইফতারকে উৎসাহিত করা হয়েছে। আবার সময় হলে পর দ্রুত ইফতার করাকেও উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। ইফতার করে নেওয়াটা ভাল পূণ্যের কাজ। অতিরিক্ত সাওয়াবের আ’মল। তবে সাওম নির্ভর নয় ইফতারের উপর। সাওম পালনের জন্য ইফতারকে শর্ত হিসেবেও ধরা হয়নি। তাই এই ইফতার খাওয়া ছাড়াও সাওম পালনে কোন সমস্যা নেই।

শেষ করার আগে, ‘শায়েখ’ একটি উপমা দিয়ে বলতে লাগলেন। ধরুন, নুমায়ের লোকটি অফিস শেষে ঠিক ইফতারের সময় বাসে চড়লো, ট্রাফিক জ্যামে পরায় বাসায় পৌঁছতে তিন ঘন্টা দেরি হল। এখন এই যে তিন ঘন্টা তিনি অতিরিক্ত সময় সাওম পালনের মত কাঠালেন, সে সময়টুকু কি সাওম পালনের মধ্যে গণ্য হবে? উত্তর হবে নিশ্চয় এ সময়টুকুকে সাওম ধরা হবে না, কারণ—উনার সাওম তো তিন ঘন্টা আগেই পূর্ণ হয়ে গেছে।

‘শায়েখ’ বল্লেন, তবে, নুমায়ের এখানে একটু চালাকি করতে পারতেন আর তা হল, নুমায়ের যদি ঐ সময়ে পকেট থেকে একটি চুইংগাম অথবা চকোলেট বের করে মুখে পুরে নিতেন, তাহলে তো তখন সাওম পূর্ণ হওয়ার সাথে সাথে উনার ইফতারও হয়ে যেত। বাসা-বাড়ির সাজানো ইফতার থেকে বাসে ঝুলন্ত নুমায়ের হয়ত আরো বেশি সাওয়াব পেতেন।

অনেস্ট মহিলা বল্লেন, ধন্যবাদ শায়েখ। এখন থেকে আমি সাওম পালনে সচেষ্ট হবো।

লেখক, মুফতি

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!