বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৮ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাবীব নূহ

একটি অকৃত্রিম, অনুপম এবং ব্যতিক্রমী লাইফটাইম এচিভমেন্ট এওয়ার্ড



আজীবন সম্মাননা। লাইফটাইম এচিভমেন্ট এওয়ার্ড। পৃথিবীর সচেতন মানুষজন মাত্রই জানেন এ সম্মাননার কথা। গুণী ও যোগ্যরা এ সম্মাননা পেয়ে থাকেন তাদের মহৎ কর্মের স্বীকৃতি ও পুরস্কার স্বরূপ। পৃথিবীর দেশে দেশে ছোট-বড় অনেক অর্গানাইজেইশন,কোম্পানি এবং প্রতিষ্টান রয়েছে যারা প্রতিভাধরদেরকে ঐসব সম্মাননা প্রদান করে গর্ববোধ করে থাকে।

এ নিবন্ধে একটি ব্যতিক্রম আজীবন সম্মাননার কথা প্রচার করছি। ব্যতিক্রম এ আজীবন সম্মাননার জনক বিশিষ্ট নবী দাউদ আলাইহিস সালাম। প্রায় তিন হাজার বছর আগে তিনি তাঁর চল্লিশ বছরের রাজত্ব কালের একদম শুরুর দিকে এ পদ্ধতি চালু করেছিলেন তাঁর নিজের জন্য। তখন তা সম্মাননা বা আজীবন সম্মাননার স্বীকৃতি পায়নি। তার প্রায় ষোলশ বছর পর, শেষনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, ঐশী নির্দেশনায়, মাদিনা শহরে সে স্বীকৃতি প্রদান করেন। এবং এর সাথে রাসূল সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যায়ক্রমে আরো বিস্তর করে এর রূপরেখা ঘোষণা করে একে সবার জন্য উম্মুক্ত করে দেন।

সাড়ে চৌদ্দশ বছর আগে চালু হওয়া এ আজীবন সম্মাননা এখন সর্বজনীন। মাত্র দুটো শর্ত পূরণ হলে যে কেউ এই সম্মাননা লাভ করতে পারবেন। প্রথম শর্ত হল ঈমান আর দ্বিতীয় শর্ত হল সিয়াম সাধনায় পারঙ্গম মু’মিন-ম’মিনাতকে কিছু নির্দিষ্ট নিয়মে সিয়াম পালন করতে হবে।

এ শর্তগুলোর সমাধা হলেই তারা সাঈমুদ দাহার খ্যাত দুর্লভ সম্মাননার অধিকারী হয়ে ইহ ও পরকালীন প্রভূত পুরস্কার লাভে ধন্য হবেন। পৃথিবীতে এই একটি মাত্র আজীবন সম্মাননা আছে যা চিরন্তন শাশ্বত। এবং যার কল্যাণ মানুষের মৃত্যুর সাথে শেষ হয়ে যায় না বরং এর জন্য ওপারে হয়ত বিশেষ আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান-সমূহ আয়োজিত হবে। তখন এ সম্মাননা প্রাপ্তরা তাঁদের সাফল্যের স্বীকৃতি পেয়ে আনন্দে আপ্লুত হবেন।

দাহার আরবি শব্দ الدّهْرُ,যার অর্থে আছে সময় ও কাল। কম অথবা বেশি সময়, দীর্ঘ সময়, জীবন এবং সারা জীবন ইত্যাদি। তবে মোটামুটি জীবন অর্থে বেশি ব্যবহার হয়। এ শব্দ বিভিন্ন অর্থে কুরআনে দুবার আর হাদীসে বেশ ক’বার উল্লেখ হয়েছে।

সাওম পালন একটি অন্যতম ও অনন্য এক ইবাদত। আখিরাতের পথযাত্রী এবং শাশ্বত কল্যাণ প্রত্যাশীদের কাছে লোভনীয় এই ইবাদতের আকর্ষণ সব সময় বেশি। কিন্তু তারপরও ইসলাম সমগ্র জীবনের প্রতিদিন সাওম পালনে সংগত কারণে নিরুৎসাহিত করে থাকে। বরং তার বদলে এমন তিনটি বিকল্প ধারা সৃষ্টি করে দেয়া হয়েছে যে, আদতে একজন মুসলিম গোটা জীবন সিয়াম পালন না করেও কিন্তু আস্ত জীবন সিয়াম পালনকারীর মর্যাদা পেতে পারবেন যদি ঐ বিকল্প ধারা অনুসরণ করেন।

বৎসরে ৩৬৫ দিন এবং চন্দ্র হিসেবে প্রায় ৩৫৫ দিবস। এ দিনগুলোতে অর্থাৎ সারা বছর ক্রমাগত বা লাগাতার, অবিরাম সিয়াম যাকে সারদুস সাওম বলে অথবা গোটা জীবন সর্বদা সিয়াম যাকে সাওমুল আবাদ বলে। আমাদের শারিআহ বা ইসলামে এ সাওম ও সিয়ামকে উৎসাহিত বা পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়নি।

বর্ণিত আছে, নূহ আলাইহিস সালাম সাওমুল আবাদ পালন করতেন। আমাদের ইসলামে, বছরের মধ্যে পাঁচদিন সিয়াম পালন নিষেধ বা হারাম। দুটো ঈদ এবং তাশরীকের তিনদিন। ঐ পাঁচদিনসহ পুরো বছর সিয়াম পালন মোটেই গ্রহনীয় নয়। আবার ঐ পাঁচদিন বাদ দিয়েও পুরো বছর সিয়াম ধারণ সাধারণের জন্য পছন্দনীয় নয়। তার অনেকগুলো কারণের অন্যতম হল, সিয়াম তখন স্বভাবজাত হয়ে মাহাত্ম্য ও গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে। তাই পূণ্যময় সাওমুদ দাহার পালনে বিকল্প ঐ তিন পন্থা বা কৌশল অবলম্বন ছাড়া উপায় নেই।

প্রথম পন্থাটি নবী দাউদ আলাইহিস সালামের সিস্টেম ছিল। তিনি একদিন সাওম পালন করতেন অতপর পরের দিন খানাপিনা করতেন। এভাবে শাতরুদ দাহার বা নিসফুদ দাহার অর্থাৎ অর্ধেক বৎসর অথবা অর্ধেক জীবন তিনি সিয়াম সাধনায় কাঠিয়েছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ সিয়ামের নামকরণ করছেন সাওমু দাউদ আলাইহিস সালাম। তাঁর বাণীতে তিনি বলছেন, “লা সাওমা ফাওক্বা সাওমি দাউদা আলাইহিস সালাম…”(দাউদের সাওমের উপর আর কোন সাওম হয়না)। অন্য বিবরণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আফদ্বালুস সিয়াম”(সর্বোত্তম সিয়াম) এবং বলেছেন, “লা আফদ্বালা মিন যালিক”(এর চেয়ে উত্তম সাওম আর নেই)। অন্যত্র তিনি বলেছেন, “আহাব্বুস সিয়ামি ইলাল্লাহি সিয়ামু দাউদ”(দাউদের সিয়াম,সব চেয়ে পছন্দনীয় সিয়াম)।

আমাদের সময়ে রামাদ্বানের সিয়ামের পর অন্য এগারো মাসে ঐ নিষেধ পাঁচদিন বাদ দিয়ে, একদিন সাওম ধরে অপর দিন সাওম ছেড়ে যখন এ সিয়াম পালন করা হবে তখন এমনিতেই অর্ধেক জীবনের চেয়ে আরো বেশি সিয়াম পালন হবে। আর আধিক্য অনেক সময় পূর্ণতার বৈশিষ্ট্য লাভ করে, তার মানে এ কারণেও সাওমু দাউদ পালনকারী মুসলিম সমগ্র জীবন ব্যাপী সাওম পালনকারীর নামান্তর হয়ে যান।

অর্ধ বছর অথবা অর্ধ জীবন সিয়াম পালন নিশ্চয় সহজ ও মামুলি নয়,অনেক কষ্টসাধ্য এবং দুঃসাধ্য ব্যাপার। সৌভাগ্য মুসলিমীনদের যে, এর চেয়ে সহজতর আরো দুটো পন্থা তারা লাভ করেছেন যা কার্যত জীবনভর সিয়াম না রেখেও নাবাবী ফরমান অনুযায়ী তারা আজীবন সিয়াম পালনকারীর মর্যাদা লাভ করবেন। এই গ্রহণসাধ্য আজীবন সিয়ামের দুটো কৌশলের ভিত হচ্ছে, আল-কুরআনের ৬ নাম্বার সূরার ১৬০ আয়াত, যেখানে রব্বানী ঘোষণা হচ্ছে, ‘একটি সৎকর্মের বিনিময় দশগুণ পাবে।’

সে সূত্রে, একটি সাওমে দশটি সিয়ামের এবং তিনটি সিয়ামে ত্রিশটি তথা একমাস সিয়ামের সাওয়াব অর্জন করে একজন মুসলিম আজীবন সিয়াম পালনকারীর সম্মাননা লাভ করবেন যদি তিনি এ ধারায় সিয়াম পালনে অভ্যস্ত হন। এ ছিল আজীবন সিয়ামের দ্বিতীয় পন্থা।

সাঈমুদ দাহারের সবচেয়ে সহজ এবং শেষ পন্থাটি হচ্ছে বছরে মাত্র ৩৬ টি সিয়াম পালন, তাও আবার রামাদ্বানের প্রায় ত্রিশটি সিয়াম সহ। একে দশ পাওয়া যাবে – সূত্রে রামাদ্বানের একমাসে দশ মাসের সমান হবে। অবশিষ্ট থাকলো দুইমাস, যার জন্য প্রায় ৬০টি সিয়ামের প্রয়োজন। রাহমাতুললিল আ’লামীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা দিলেন, রামাদ্বান শেষে, শাওয়াল মাসে ৬টি সিয়াম পালন করলে সাঈমুদ দাহারের অন্তর্গত হয়ে যে কোন মুসলিম আজীবন সিয়াম পালনকারীর সম্মাননা লাভ করতে পারবেন।

সালাত ও সালাম জানাই- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এবং সাধুবাদ জানাই ঐসব মুসলিমদেরে যারা এ ব্যতিক্রম লাইফটাইম এচিভমেন্ট এওয়ার্ড লাভে ধন্য হবেন। মোবারকবাদ। মারহাবা।

লেখক, মুফতি

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!