বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৮ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আব্দুর রশীদ লুলু

নবাব আলীবর্দী খার আমপ্রীতি



নবাব আলিবর্দী খা। ছবি: ইন্টারনেট

নানা কারণে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব আলীবর্দী খা (১৬৭৬-১৭৫৬)’’র শাসনামল ইতিহাসে অনেক আলোচিত। উল্লেখ্য তাঁর প্রকৃত নাম মীর্জা মহম্মদ আলী। ভাগ্যান্বেষণে দিল্লী থেকে বেরিয়ে পড়া রাজনীতি ও রণনীতিতে কৌশলী এবং বিচক্ষণ মীর্জা মহম্মদ আলী জীবনে ক্রমশ: উন্নতি লাভ করতে থাকেন। সুজাউদ্দিন বাংলার মসনদে আসীন হলে তাঁকে ‘আলীবর্দী’ উপাধি দিয়ে রাজমহলের ফৌজদার নিযুক্ত করেন। অনেক ঘটনা প্রবাহের মধ্য মোঘল শক্তির ধ্বংস ও পতনের প্রেক্ষপটে নবাব আলীবর্দী খা ১৭৪০ সালে বাংলা বিহার-উড়িষ্যার মসনদে উপবেশন করেন। ঐতিহাসিকরা মোঘল সাম্রাজ্যের নামে মাত্র অধীনে থাকা এ নবাবের বিচক্ষণতা ও সুশাসনের প্রশংসা করেন।

নবাব আলীবর্দী খা তাঁর শাসনামলে মারাঠাবর্গী ও ইংরেজদের বিভিন্ন কৌশলে সংযত রাখার পাশাপাশি প্রজা সাধারণের সুখ-শান্তির বিষয়ে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নেও ভূমিকা রাখেন। বিশেষ করে তাঁর আম প্রীতি ইতিহাসে একটি আলোচিত বিষয়।

বিশ্লেষকদের ধারণা, আমাদের দেশে বিভিন্ন রকমের, বিভিন্ন নামের ও স্বাদের আম থাকলেও তা এখনকার মতো এতো উন্নতমানের ছিল না। অনেক ঐতিহাসিকদের মতে, নবাব আলীবর্দী খার আগে এদেশে আম তথা ফলের মান উন্নয়নে সরকারিভাবে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। তাঁর সময়েই বাংলায় আম ও অন্যান্য প্রজাতির ফলের মান উন্নয়নে কাজ শুরু হয়। তিনি একজন শাসক ও রাষ্ট্রনায়ক হয়েও উদ্ভিদ বিজ্ঞানীর দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ফল-ফসলের উন্নয়নে সরকারিভাবে বহুবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তাঁর শাসনামলে সঙ্কর পদ্ধতিতে প্রায় দেড় শত আমের নতুন জাত সৃষ্টি করা হয়। পাশাপাশি তাঁর নির্দেশে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় সরকারিভাবে প্রচুর আমের বাগান সৃষ্টি হয়। পলাশীর সুবিখ্যাত আম্রকাননটিও তাঁর সৃষ্টি।

এ ছাড়া গবেষকদের ধারণা, বিহার থেকে দিনাজপুর, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, কুষ্টিয়া, বীরভূম, রাজশাহী, মালদহ ও খুলনার বিস্তীর্ণ এলাকার পরিকল্পিত ও সুপ্রাচীন আম বাগান গুলোর দলিল ঘাটলে হয়তো দেখা যাবে এগুলোর বেশি ভাগই নবাব আলীবর্দী খার আমলে সৃষ্টি। উল্লেখ্য, সরকারিভাবে আম বাগান সৃষ্টিতে সরকারি খাস ও পতিত জমি ব্যবহার করা হতো। যাতে প্রজা সাধারণের অন্য ফল-ফসল চাষাবাদে বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি কৃষকরা যাতে তাদের নিজস্ব জমিতে স্বাধীনভাবে নতুন উদ্ভাবিত আমের বাগান গড়ে তুলতে পারে সেজন্য নবাব আলী বর্দী খা মুক্ত হাতে অনুদান প্রদান করতেন। সরকারি ও বেসরকারিভাবে বাগান সৃষ্টির পাশাপাশি এ গুলো রক্ষণাবেক্ষণেও তাঁর প্রখর দৃষ্টি ছিল। কেউ যাতে কোনোভাবে আমের (এবং অন্যান্য ফল-ফসলের) বাগান নষ্ট করতে না পারে সেদিকে নজর রাখার জন্য তাঁর সৈনিকদের প্রতি নির্দেশ ছিল।

বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার নানা নবাব আলীবর্দী খা তাঁর উদ্ভাবিত আমের নামকরণেও উদার ও অসাম্প্রদায়িক ছিলেন বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। গবেষকদের ধারণা, এখনকার জনপ্রিয় ও সুপরিচিত ফজলি, গোপাল ভোগ, জামাই খোশ, দিলখোশ, ল্যাংড়া, হিমসাগর, লক্ষণভোগ, নবাব আলী বাহার, কুতুব আলী বাহার, ক্ষীরসাপাতি, জিড়ামূখী প্রভৃতি নামের আমের প্রবর্তক নবাব আলীবর্দী খা।

আম বাংলাদেশের শ্রেষ্ট ফল। স্বাদ, গন্ধ ও পুষ্টিমানের বিবেচনায় আম দেশের ফলের রাজা। আম গাছ এখন জাতীয় গাছও। দেশে এখন অনেক উন্নতমানের আমও বিদ্যমান। আম (এবং অন্যান্য ফল-ফসল) নিয়ে এখন অনেক গবেষণাও হচ্ছে। কিন্তু এক সময় অবস্থা অন্যরকম ছিল। উল্লেখ্য, ইতিহাস খ্যাত মোঘল সম্রাট বাবর তাঁর লেখা ‘বাবরনামা’য় এদেশের ফলের মান নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে গিয়েছেন। কিন্তু মান উন্নয়নে তিনি কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনিন। এ রকম প্রেক্ষাপটে নবাব আলীবর্দী খার আম তথা ফলপ্রীতি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয়। এ কথা নি:সন্দেহে বলা যায়, সুশাসনের পাশাপাশি আম তথা ফল-ফসলের উন্নয়নে যুগান্তকারী অবদানের জন্য বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব আলীবর্দী খা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!