রবিবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৮ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কাইয়ূম আবদুল্লাহ

লণ্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের অমর একুশের অনন্য আয়োজন ও সেই স্মরণীয় সন্ধ্যা: একটি ব্যক্তিগত অনুভূতি



অমর একুশে উদযাপন। কম সময়ের মধ্যে গুরুত্বসহকারে একটি উপভোগ্য এবং একই সাথে ভাষা বিষয়ে চিন্তার খোরাক জাগানিয়া অনুষ্ঠান উপহার দেয়ার জন্য লণ্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের নবনির্বাচত নির্বাহী কমিটিকে অনেক ধন্যবাদ। কম সময়, কারন জানুয়ারির একেবারে শেষে নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব গ্রহণ পর্যন্ত মাত্র সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে সুচারুরূপে ভাষা ও শহীদ দিবসের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন সত্যি বেশ কষ্টসাধ্য। শুধু অনুষ্ঠানটি সময়মতো শুরু না করতে পারা এবং একারনে অনেকটা তাড়াহুড়ো করে শেষ করতে বাধ্য হওয়া ছাড়া সবদিক থেকে তা ছিলো চমৎকার একটি উপস্থাপনা।

“অমর একুশে অহংকারের ৭০ বছর” শীর্ষক অনুষ্ঠান উদযাপনে বিষয় ও আলোচক নির্বাচনও ছিলো সুচিন্তিত ও সময়োপযুগী। সম্মানিত আলোচকবৃন্দ যা বলেছেন, নিজেদের ভাষার মর্যাদাকে সমুন্নত রাখা ও সম্প্রসারিত করার স্বার্থে তা যদি আমরা সবাই আন্তরিকভাবে মেনে চলি এবং সেই লক্ষ্যে সঠিক কাজ করতে পারি তাতে যে সুফল পাওয়া যাবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এই ৭০ বছরে বিশ্বায়নের দিক থেকে বাংলা ভাষার অগ্রগতি সাধিত হলেও নিজেদের মধ্যে ভাষার সঠিক চর্চার ঘাটতি এবং বিলেতে আমাদের নতুন প্রজন্মকে আশানুরূপ আকৃষ্ট না করতে পারার বিষয়ে আলোচকগণ আলোকপাত করার চেষ্টা করেছেন।

প্রধান আলোচক ড. আব্দুল হান্নান “বিলেতে বাংলা ভাষার ভবিষ্যত” শীর্ষক তাঁর সুচিন্তিত ও সুশ্রাব্য দীর্ঘ আলোচনায় বিলেতে বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠা ও প্রসারে আমাদের অগ্রজদের অপরিসীম অবদান এবং সেটি ধরে রাখা ও উন্নয়নে আমাদের করণীয় সম্পর্কে যা বলেছেন, সত্যি তা ছিলো অসাধারণ। এছাড়া বিজ্ঞ আলোচকগণের বক্তব্যও ছিলো যথোপযুক্ত।

“বিলেতে বাংলা চর্চায় মিডিয়ার ভূমিকা” বিষয়েও চমৎকার বলেছেন নির্ধারিত তিন আলোচক। বিবিসি বাংলার প্রযোজক মিজানুর রহমান খানের আলোচনায় ভাষা যে শুধু বর্ণমালার সমষ্টি নয়, এটি একটি সম্পর্কের ব্রিজ এবং দেশ, পরিবার ও স্বজনদের সাথে সেই ব্রিজ বা সেতুর সম্পর্ক অটুট রাখতে স্বীয় ভাষা শেখা ও চর্চার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে ওঠে এসেছে।

চ্যানেল এস’-এর অনুষ্ঠান প্রধান ফারহান মাসুদ খান ভাষা ও সংস্কৃতির উন্নয়নে গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে ব্যাপক প্রচারণার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
টিভি ওয়ানের প্রযোজক ও উপস্থাপক জিয়াউর রহমান সাকলাইন মাতৃভাষা চর্চা না হওয়ায় কীভাবে পরিবারের প্রবীণদের সাথে নতুন প্রজন্মের সম্পর্কে ছেদ সৃষ্টি হচ্ছে তা তুলে ধরেছেন।

ছবি: এখলাছুর রহমান পাক্কু

আলোচকদের আলোচনার উপর লণ্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি যথাক্রমে সৈয়দ নাহাস পাশা, নবাব উদ্দিন, মোহাম্মদ বেলাল আহমদ, সদ্য সাবেক সেক্রটারি মুহাম্মদ জুবায়ের, সদ্য সাবেক ট্রেজারার আ স ম মাসুম, টিভি উপস্থাপক উর্মী মাজহার ও কবি-ছড়াকার দিলু নাসেরের সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া ও প্রশংসার বিষয়টিও ছিলো ব্যতিক্রম। অনেক আলোচক নিজেদের সন্তানদের অন্য অনেক ভাষা ও বিশাল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকার্যক্রমের সাথে সাথে বুনিয়াদি মাতৃভাষা বাংলার সাথে পরিচিত এবং ওই ভাষায় অনেকাংশে তাদের পারদর্শী করে তোলার গল্প শুনিয়েছেন, যা উপস্থিত অনেককে আশাবাদী ও উৎসাহ যুগিয়েছে।

নবনির্বাচিত ক্লাব সেক্রেটারি তাইসির মাহমুদের উপস্থাপনায় অনুষ্ঠানে যথারীতি সভাপতিত্ব করেন দ্বিতীয়বার নির্বাচিত ক্লাব সভাপতি এমদাদুল হক চৌধুরী। কিছু ইংরেজী শব্দের অনুপ্রবেশ ঠেকানোর ব্যর্থতা ছাড়া সেক্রেটারি তাইসির মাহমুদের পুরো উপস্থাপনা ছিলো বেশ ভাবগাম্ভীর্য্যপূর্ণ ও সাবলিল। সভাপতি এমদাদুল হক চৌধুরী বিলেতে বাংলা চর্চায় প্রিন্ট মিডিয়ার ভূমিকা তুলে ধরার পাশাপাশি বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ের অবতারণা করেন। “ভবনের দেয়ালে আলোর ঝলকানিতে আমরা উচ্ছসিত হই অথচ সেই ভবনের ভেতরেই আলো নিভিয়ে দেয়া হয়েছে” উল্লেখ করে তিনি বাঙালি অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটসে বাংলা ভাষা চর্চার দুরাবস্থার দিকেই যে ইঙ্গিত করেছেন সেটি বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

যেটি না হলে একুশের অনুষ্ঠান অপূর্ণই থেকে যেতো, তা হলো সাংস্কৃতিক পর্বে কবিতা আবৃত্তি ও সঙ্গীত পরিবেশনা। ক্লাবের নবনির্বাচিত এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি গল্পকার সাঈম চৌধুরীর সঞ্চালনায় এ পর্বে কবি ও আবৃত্তিকার তৌহীদ শাকীল ও দিলু নাসেরের স্বরচিত কবিতা পাঠাবৃত্তি এবং আবৃত্তিকার সালাউদ্দিন শাহীন কর্তৃক শামসুর রাহমানের “দুঃখিনী বর্ণমালা” কবিতার আবৃত্তি মুগ্ধতা ছড়িয়েছে।

ক্লাব সদস্য তৌহীদ চৌধুরীর মেয়ে শিশুশিল্পী তানিশা চৌধুরী ভূমিকায় যথাযথ বাংলা উচ্চারণ বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করলেও তার ভাষাভিত্তিক জাগরণের গান “মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা” পরিবেশনা ছিলো সাবলিল ও শ্রুতিমধুর। আর অমর শহীদদের স্মরণে চ্যানেল এস’র সংবাদ পাঠক ববি রায়ের কণ্ঠে “সব ক’টা জানালা খুলে দাও না/ আমি গাইব গাইব বিজয়েরই গান” পরিবেশনা পুরো পরিবেশকে ভাবগম্ভীর্য্যে ভাসিয়ে দেয়। গানটির সুরের মূর্ছনা মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীনতা অর্জনে আত্মবিসর্জনকারী সকল শহীদ স্মরণে আমাদের অন্তরাত্মা ক্ষণিকের জন্য হলেও চলে যায় তাদের স্মৃতির চরণে।

ছবি: এখলাছুর রহমান পাক্কু

ক্লাবের নির্বাহী সদস্য, আবৃত্তিকার নাজমুল হোসেইন কর্তৃক বহু ঘেঁটেঘুটে ভাষা শহীদদের জীবন বৃত্তান্ত সংগ্রহ এবং তাদের শাহাদাৎ বরণের মর্মান্তিক মুহূর্তের বিবরণ সযত্নে তুলে ধরাটা ছিলো অনুষ্ঠানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক। আমরা সাধারণত ৪/৫ জনের নামই জানতাম। কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা যে তারও অধিক সেটি ওই উপস্থাপনার মাধ্যেমে অনেকের কাছে পরিষ্কার হলো।

তাছাড়া সূচনাতে নির্বাহী কমিটি ও অন্যান্য শিল্পীর সম্মিলিত কণ্ঠে অমর একুশে গান পরিবেশনা এবং সেই পরিবেশনায় অডিয়েন্স থেকে সুর মিলিয়ে শহীদের স্মরণে নিজেদের সম্পৃক্ত হওয়ার আত্মতৃপ্তিতো আছেই। আর রক্তিম সূর্যের বুকে ভাষাশহীদদের আবক্ষ প্রতিকৃতিসহ আল্পনা অঙ্কিত অপূর্ব মঞ্চ নির্মাণ অনুষ্ঠানের বাহ্যিক অবয়বে ঘটিয়েছিলো নান্দনিকতার বহিঃপ্রকাশ।

অনুষ্ঠানের সমাপ্তিতে উপস্থিতির সকলকে ধন্যবাদ জানালেন এবং নির্বাহী কমিটির সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দিলেন ক্লাবের সিনিয়র সহসভাপতি ব্যারিস্টার তারেক চৌধুরী ও ট্রেজারার সালেহ আহমদ। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া সত্ত্বেও উপস্থিতি খুব একটা কম ছিলো না। সারগর্ভ আলোচনা, আবৃত্তি ও সঙ্গীতের সংবেদনশীল মূর্ছনায় বলা যায় তা ছিলো এক অনন্য আয়োজন, স্মরণীয় সন্ধ্যা।

কাইয়ূম আবদুল্লাহ: কবি, বার্তা সম্পাদক – সাপ্তাহিক সুরমা, লণ্ডন

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!