যতদূর মনে পড়ে ১৯৭৮/৭৯ সাল থেকে আমি লেখালেখি শুরু করি। পাঠশালায় পড়াকালীন সময় থেকে বাংলা সাহিত্য আমাকে টানলেও, বিচিত্র বিষয় মাথায় দোল খেললেও লেখা হয়নি। হাই স্কুলে পড়াকালীন স্কুল লাইব্রেরীর গল্প-উপন্যাসে ডুবে থাকি আকন্ঠ। বিশেষত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গল্প আমাকে মুগ্ধ করে। পড়তে পড়তে ইচ্ছে জাগে, নিজের মাথায় দোল খাওয়া বিষয় বৈচিত্রকে প্রকাশের। এক সময় সযত্নে হাতে তুলে নিই কলম। লিখতে থাকি গল্প আর গল্প। প্রথমত নিজের গল্পের নিজেই মুগ্ধ পাঠক। নিজেই নিজের সৃষ্ট চরিত্রের বিশ্লেষণ করি। চেষ্টা করি, গল্প গুলোকে ছোট গল্পের সংজ্ঞায় ফেলার। ততক্ষণে রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পে সংজ্ঞা শেখা হয়ে গেছে। যখন-তখন আপন মনে আওড়াই- “ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা/ছোট ছোট দুঃখ কথা —-।”
হাই স্কুলে পড়াকালীন ১৯৭৮/৭৯ সালে ছোট গল্প দিয়ে আমার লেখালেখি শুরু হলেও পরবর্তীতে আমি বিচিত্র বিষয়ে লিখেছি। লিখেছি প্রবন্ধ-নিবন্ধ, ছড়া-কবিতা, আলোচনা-সমালোচনা, স্মৃতিচারণ প্রভৃতি। বলা দরকার, আমার প্রথম লেখা গল্প হলেও প্রথম প্রকাশিত লেখা কিন্তু গল্প নয়, কবিতা।
যা হোক, সেই ১৯৭৮/৭৯ সাল থেকে অদ্যাবধি প্রচুর গল্প লিখলেও এবং তা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সংকলনে প্রকাশিত হলেও এখনো আমার কোন গল্প গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। লেখালেখির প্রথম জীবনে আমি স্বপ্ন দেখতাম আমার প্রথম বই হবে গল্পের। কিন্তু অনেক স্বপ্নের মতো, আমার সে স্বপ্নও পূরণ হয়নি। প্রথম লেখা প্রকাশের বাইশ বছর পর প্রকাশিত হয় আমার প্রথম বই- “হৃদয়ে মম” (জুন ২০০৫)। স্মৃতিচারণমূলক প্রবন্ধ-নিবন্ধের বই “হৃদয়ে মম” পাঠকপ্রিয়তার প্রেক্ষিতে আমি কিছুটা আর্থিক লাভমান হলেও আজো অলস-অবসর মুহুর্তে ভাবি-আহা! গল্পের বই হলে আমি সহাস্যে প্রতিষ্ঠিত লেখক ও একনিষ্ঠ পাঠকের হাতে তুলে দিতে পারতাম। বলা বাহুল্য, সেই আক্ষেপবোধ থেকে দু’টি গল্পের বই- “বসন্ত বাতাসে” এবং “মেঘের কোলে রোদ হেসেছে” প্রকাশের প্রস্তুতি নিচ্ছি। আশা করছি, অদূর ভবিষ্যতে বইগুলো প্রকাশিত হবে।
বিচিত্র বিষয়ে লেখালেখি করলেও গল্প তথা কথাসাহিত্য আমার প্রিয় সাবজেক্ট। গল্প পড়তে পড়তে আমি যেমন অনেক বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছি, তেমনি নিজের লেখা গল্প তথা গল্পের চরিত্র নিয়ে ভেবে ভেবে আমি দিনের পর দিন সাবাড় করেছি। এমনও হয়েছে নিজের সৃষ্ট গল্পের নায়ক-নায়িকা কিংবা পার্শ্ব চরিত্রের দুঃখ-বেদনায় নিজেই চোখের জল ফেলে লেখা নষ্ট করেছি।
নানা কারণে বিশেষত ভবঘুরে জীবনের জন্য প্রথম জীবনের অনেক গল্প আজ হারিয়ে গেছে। অপরিপক্ষ হাতের সেই গল্পগুলোর জন্য আজকাল প্রায়ই আমার আক্ষেপ ঝরে। সেই প্রথম জীবনের আবেগ-উচ্ছাস, প্রেম-ভালোবাসা, প্রকৃতি-পরিবেশ, সমাজ চিত্র সম্বলিত লেখাগুলোতে আজ হাত বুলালে হয়তো চমৎকার গল্প হতে পারতো।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কথাসাহিত্য দিয়ে আমার ব্যাপক পঠন-পাঠন শুরু হলেও বাংলা সাহিত্যে প্রিয় কবির মতো আমার প্রিয় গল্পকার আজো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর গল্প-ছুটি, পোস্ট মাস্টার, হৈমন্তী, বলাই —- আমার অনেক অনেক পড়া গল্প। আহ কী সার্থক ছোট গল্প! রবীন্দ্রনাথের ‘পোস্ট মাস্টার’ ও ‘ছুটি’র মতো আমি অনেকবার পড়েছি আলাউদ্দিন আল আজাদের গল্প- ‘বৃষ্টি’। ‘বাতাসী যা ছিনাল—-’ চমৎকার সমাজ চিত্র সম্বলিত গল্প।
আমার বহুবার পড়া বই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘শ্রীকান্ত’। উত্তম পুরুষে লেখা ‘শ্রীকান্ত’ পড়তে পড়তে আমি উদ্দীপ্ত হয়েছি ‘আমি গল্প’ লিখতে। এ পর্যন্ত আমি অনেক গল্প লিখেছি আমি আমি করে উত্তম পুরুষে। গল্পে নিজেকে জড়াতে ভালো লাগে। অনেক পাঠক ভাবেন লেখকই বুঝি গল্পের নায়ক। অনেক বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, পরিচিত পাঠক এসব গল্প পড়ে প্রশ্ন রাখেন, অনেকে সরাসরি বলেন- এই যে অন্য নারীর সাথে নিজের জড়াজড়ির কথা লিখেন, ভাবী কিছু বলেন না?
সৌভাগ্যক্রমে এসব বিষয়ে বেগম সাহেবা মাথা ঘামান না। বেচারীর ধারণা, এসব গল্প, শুধুই গল্প এবং গতানুগতিকতার বাইরে পাঠকদের একটু বৈচিত্র্য দেয়ার চেষ্টা মাত্র। যদিও শেষ পর্যন্ত লেখক আমি গল্পের সাথে লেপ্টে থাকি না। কৌশলে গল্পের নায়ককে একটা নাম দিয়ে নিজেকে সরিয়ে আনি।
প্রসঙ্গত একটা গল্পের কথা বলি, আশির দশকে প্রকাশিত উত্তম পুরুষে লেখা আমার গল্প ‘সাত সাগরের ওপার থেকে’ পড়ে অনেকেই জানতে চান, আমি সাত সাগরের ওপার থেকে কবে দেশে এসেছি? অথচ আজ পর্যন্ত সাত সাগর পাড়ি দেয়া তো দূরের কথা, আমার পক্ষে এক সাগরও পাড়ি দেয়া সম্ভব হয়নি। এ রকম আরো কিছু কথা আছে, উত্তম পুরুষে লেখা আমার গল্প নিয়ে।
এক বিশ্ব বিখ্যাত লেখক বলেছেন, “গল্প লেখকের জীবনী লেখা অসম্ভব ব্যাপার। নিজের জীবনটাই তিনি বারে বারে তাঁর সমস্ত লেখার মধ্যে ঢুকিয়ে দেন, ফলে জীবন সায়াহ্নে জীবনী লেখার মতো কোনো- অব্যবহৃত উপাদানাই তাঁর ঝুলিতে পড়ে থাকে না।”
গল্পের সাথে নিজের সম্পৃক্ততা সম্পর্কে পাঠকের প্রশ্নে আমার উপরোক্ত কথাই মনে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি পাঠকের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে হেসে পাশ কাটালেও আমি তো জানি, চেতন-অবচেতন মনে নিজের স্বপ্ন, চাওয়া-পাওয়া, দুঃখ-বেদনা, নিজের জীবনের ছোট ছোট ঘটনা, দেখা-জানা-শোনা বিষয়-আশয় আমার গল্পের ফাঁকে ফাঁকে অহরহ ঢুকে পড়ে।
গল্প লিখতে লিখতে এক সময় আমি ভাবতে ভালোবাসতাম, আমার নামের সাথে ‘কথাশিল্পী’ অভিধা যুক্ত হবে। কিন্তু কথার শিল্প বোনা চাট্টিখানি কথা না। যদিও অনেক পাঠক বলেন, আমার গল্প ভালো, খুব সফ্ট। কেউ কেউ বলেন, সহজ-সরল সাধারণ শব্দে আমার ছোট ছোট গল্প গুলো অনায়াসে পড়া যায়। কখনো কখনো পাঠক ফোনে-পত্রে জানান, এ রকম গল্প আরো চাই। পাঠকের এমন মন্তব্যে অনেক ক্ষেত্রে আমি মুগ্ধ নয়, কুন্ঠিত হই। কেননা গল্প নিয়ে আমার নিজেরই অতৃপ্তি প্রচুর।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা নিয়ে আমার ছিঁটে-ফোটা গল্প আছে। আমার স্বাধীনতা কেন্দ্রিক ‘চৈতন্য’ শীর্ষক গল্পে স্বাধীনতার পর জন্মগ্রহণকারী নায়ক নির্দ্বিধায় তার ভালোবাসাকে বিসর্জন দেয়, যখন জানতে পারে তার প্রেমিকার বাবা একজন রাজাকার। অর্থ-বিত্ত, রূপ-যশ কিছুই তাকে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারেনি। গল্পটা গুরুত্ব সহকারে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তবু আমার ধারণা, এতদসংক্রান্ত আমার সার্থক বা উল্লেখযোগ্য কোনো গল্প নেই। অথচ প্রায় প্রতিনিয়ত ভাবছি, উল্লেখযোগ্য একটা কিছু করা দরকার।
আগেই বলেছি আজতক আমি নিজেই আমার গল্প নিয়ে অতৃপ্ত। জানি না, লেখক জীবনে এ অতৃপ্তিটা কাটিয়ে ওঠা যাবে কিনা।
লেখক, সম্পাদক – আনোয়ারা (শিকড় সন্ধানী প্রকাশনা)।