আমাদের দেশে বেশ কয়েক বছর ধরে সরকারী-বেসরকারীভাবে গাছ লাগানোর কথা বলা হচ্ছে। চেষ্টা করা হচ্ছে, এ বিষয়ে গণ- সচেতনতার। ফলও পাওয়া যাচ্ছে। প্রতি বছর গাছ-লাগানো হচ্ছে। তবে দেশের আয়তন ও জনসংখ্যার অনুপাতে তা যথেষ্ট নয়। আরো গাছ লাগানোর দরকার। কেননা প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য মোট ভূমির ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা দরকার, অথচ সরকারী হিসাবে আমাদের আছে ১৭ শতাংশের মতো আর ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউটের হিসাব মতে, আছে মাত্র ৫ শতাংশ।
যা হোক, লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, দেশব্যাপী যে সব গাছ লাগানো হচ্ছে, তার অধিকাংশই বিদেশী প্রজাতির। বিদেশী প্রজাতির বিভিন্ন গাছ; যেমন- শিশু, মেহগনি, রেইনট্রি প্রভৃতি ক্ষেত্র বিশেষে দেশীয় বিভিন্ন ধরণের গাছের তুলনায় লাভজনক হলেও সার্বিক বিবেচনায় আমাদের দেশীয় গাছ লাগানো উচিৎ। জীব বৈচিত্র্য রক্ষার জন্য দেশীয় বিভিন্ন গাছ ছাড়া উপায় নেই। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ভিন্ন দেশী রেইনট্রি, মেহগনি, আকাশমণি ইত্যাদি গাছে আমাদের দেশীয় পাখি যেমন- দোয়েল, কোয়েল, ঘুঘু, ময়না, শালিক, বক এমনকি কাকাও বাসা বাঁধে না। ফলে আমাদের প্রাকৃতিক শোভা বর্ধনকারী পাখির ওপর সুদূর প্রসারী প্রভাব পড়ছে। ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। শুধু পাখির জন্য নয়, একই সাথে ভিনদেশী গাছ আমাদের জীবজন্তু-পশু, কীট প্রত্যঙ্গ ও পরিবেশ-প্রতিবেশের জন্যও হুমকী স্বরূপ বলে অনেকে মনে করেন। উল্লেখ্য, আকাশমণির পরাগ রেনু হাঁপানী ও এলার্জি রোগ সৃষ্টির জন্যও দায়ী বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
নানা কারণে দেশীয় পুরনো গাছ কাটতে কাটতে প্রায় শেষের দিকে। কিন্তু নতুন করে লাগানোর ক্ষেত্রে দেশীয় গাছের কথা প্রায়ই আমাদের মনে আসে না। আমরা নব বনায়নের ক্ষেত্রে প্রায়ই ভিনদেশী গাছকে অগ্রাধিকার দিই। অথচ এগুলো আমাদের পরিবেশের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই সংগতিপূর্ণ নয়। একই সাথে তা পাখি কুলের খাদ্য ঘাটতি ও প্রজনন (বংশ বৃদ্ধি) সমস্যায় সৃষ্টির জন্য দায়ী। বছর কয়েক আগে ঢাকার একটি পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে পড়েছিলাম, একটি তুত গাছের বাগানে বেশ কিছু কবুতর ধুঁকে ধুঁকে প্রাণ দিচ্ছে। যতদূর মনে পড়ে বাণিজ্যিক স্বার্থে দেশীয় অন্যান্য গাছ উজাড় করে তুঁত বাগান করা হয়েছিল। তুঁত গাছের বিষক্রিয়ায় আমার অন্যতম প্রিয় পাখি কবুতর মারা যাওয়ার সংবাদ পড়তে পড়তে দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে ভেবেছিলাম, কবুতর গুলো অন্য এলাকায় চলে গেলেও পারতো। সম্প্রতি প্রকৃতি বিষয়ক একটা বই পড়ে জানা গেলো, পাখিরা খুব এলাকা প্রিয়। এক এলাকার পাখি সাধারণতঃ অন্য এলাকায় যায় না। ঘুরে- ফিরে তারা নিজেদের পরিচিতি পরিবেশে ঘোরা-ফেরা ও বসবাস করে।
যা হোক, গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে প্রকৃতি ও পরিবেশের স্বার্থে আমাদের দেশীয় গাছ; যেমন- কড়চ, হিজল, বরুণ, জারুল, আম, জাম, কাঁঠাল, তেতুল, শেওড়া, গাব প্রভৃতিকে অবশ্যই বিবেচনায় আনতে হবে। গ্রামাঞ্চলে অনেকে বাড়ীতে বা বাড়ীর ধারে-কাছে তেতুল, শেওড়া ও গাব এ জাতীয় গাছ লাগাতে চান না। অনেকের ধারণা, এসব গাছে ভূত থাকে। আসলে এসব গাছ খুব ঝোপালো থাকে ফলে পেঁচার মতো পাখির এ গুলো প্রিয় আবাসস্থল। মানুষ জন এসব গাছের কাছ দিয়ে গেলো, পেঁচা কিংবা ওখানে চুপচাপ বসে থাকা অন্য পাখি ভয় পেয়ে ডানা ঝাপটায়, এক ডাল থেকে অন্য ডালে পালায় এবং ক্ষেত্রে বিশেষে বিকট শব্দ করে। ঝোপালো গাছ থাকায় সহজে কিছু দেখা যায় না, ফলে অনেকে মনে করেন এসব ভূতের কাজ।
প্রসঙ্গত: পেঁচার কথা একটু বলা যায়। পেঁচা একটা নিরীহ পাখি। দিনের আলো তার সহ্য হয় না। তাই এ সময় ঝোপানো গাছে লুকিয়ে থাকে। আর রাতে খাদ্যের সন্ধানে বের হয়। কৃষকের এক নম্বর শত্রু ইদুর হলো পেঁচার প্রিয় খাবার। ঘুরে ফিরে পেঁচা তাই আমাদের জন্য উপকারী প্রাণী। কিন্তু কুসংস্কার বশত: নির্বিচারে পেঁচা নিধন এবং তেতুল, শেওড়া ও গাবের মতো ঝোপালো গাছ না থাকায় প্রজনন ও বাসা বাঁধার অসুবিধা হেতু পেঁচা আজ আমাদের প্রকৃতি থেকে বিলুপ্তির পথে। পক্ষান্তরে ইঁদুরের সংখ্যা ও উৎপাত ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভূক্তভোগী কৃষক মাত্রই তা জানেন।
উল্লেখ্য, ইঁদুর নিধনের জন্য বিভিন্ন ভাবে প্রতি বছর সরকারের অনেক টাকা খরচ হওয়া সত্ত্বেও ইদুর নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে নতুন গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে চাই দেশীয় গাছ।
লেখক: আব্দুর রশীদ লুল, সম্পাদক – আনোয়ারা (শিকড় সন্ধানী প্রকাশনা)।