এই সময়ে সিলেট-সুনামগঞ্জ এবং তৎসংলগ্ন এলাকার জনগণ এক সংকটময় মুহুর্ত পার করছে। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল এবং ঘন বৃষ্টিপাতে বিপর্যস্ত সিলেট সুনামগঞ্জের শহর এবং গ্রাম অঞ্চল। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষ, ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্যের, ভেঙ্গে পড়েছে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। যার ফলে অনেক জায়গায় চাইলেও ত্রাণ এবং উদ্ধার তৎপরতা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
সিলেট এবং সুনামগঞ্জ বাসীর এই ক্লান্তিলগ্নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সু-দৃষ্টি এখন একান্তই কাম্য। এই মুহূর্তে উদ্ধার তৎপরতা এবং ত্রাণ কার্যক্রম বৃদ্ধি না করলে বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি এবং প্রাণনাশের আশঙ্কা করা যাচ্ছে। দুর্যোগ পীড়িত মানুষের পাশাপাশি গবাদি পশুদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়া অতীব জরুরী। তাছাড়া অসুস্থ মানুষদের জন্য ভ্রাম্যমান চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়াও ভবিষ্যৎতে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি মোকাবেলায় নিম্নোক্ত পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন জরুরী –
বন্যার কারণে সিলেট অঞ্চলে প্রায় প্রতিবছরই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে, আবার বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য নদ-নদীর খনন এবং বাঁধ নির্মাণের নামে ব্যাপকভাবে অর্থ ব্যয় হচ্ছে। কিন্তু তেমন কোনো দৃশ্যমান ফলাফল নজরে আসছে না। বন্যা যেহেতু এই অঞ্চলের একটি নৈমিত্তিক দুর্বিপাক, তাই বন্যা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা না করে টেকসই বন্যা ব্যবস্থাপনার দিকে মনোযোগ দেওয়া একান্ত জরুরি।
সুরমা-কুশিয়ারাসহ মাঝারি ও ছোট নদীগুলো আঁকাবাঁকা বা মিয়েনডারিং প্রকৃতির। আঁকাবাঁকা নদীতে সক্রিয় জলপথ একটি, নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয় অনেকটা ধীরে। একটি নদীর পানি ও পলি পরিবহনের ক্ষমতা অনেকাংশেই নির্ভর করে নদীর তলদেশের গড় ঢালের ওপর। নদী ভরাট হচ্ছে কি না, তা যাচাই করতে হয় দীর্ঘ মেয়াদে নদীর তলদেশের গড় ঢালের পরিবর্তন নিরীক্ষা করে; চর জেগে ওঠার ভিত্তিতে অনুমান করে নয়। বন্যার কারণ নানাবিধ। যেমন- পর্যাপ্ত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা ছাড়া নগরায়ণ, উজানে ও অববাহিকায় বৃষ্টিপাতের ফলে নদীর পাড় উপচে বা বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবনভূমিতে পানি প্রবেশ অন্যতম। বন্যা ও জলাবদ্ধতার যে কারণগুলো মানুষের সৃষ্টি, তার সমাধান কঠিন হলেও অসম্ভব নয়।
শহর অঞ্চলে জলাবদ্ধতার বড় কারণ বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট নির্মাণের ফলে গাছপালা, নালা ও জলাধারের অস্তিত্ব বিলোপ। এ ছাড়া পানি নিষ্কাশনের যে ব্যবস্থা, তা অপ্রতুল ও অব্যবস্থাপনার শিকার। শহরে জলাবদ্ধতা কমাতে হলে এলাকাভিত্তিক সমাধান না খুঁজে পুরো নগরী এবং আশপাশের এলাকার জন্য পরিকল্পনা, সঠিক নকশা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা দরকার। এ জন্য পর্যাপ্ত ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ভূগর্ভস্থ নালা ও সুড়ঙ্গ স্থাপন এবং রক্ষণাবেক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতিকেও কার্যকরভাবে ব্যবহার করা জরুরি। বৃষ্টির পানি উৎসের কাছে যতক্ষণ সম্ভব ধরে রাখার ব্যবস্থা করা, পুকুর-জলাধারের ধারণক্ষমতা বাড়ানো এবং ছাদ ও আঙিনায় গাছ লাগানোর মাধ্যমে বৃষ্টির পানির সর্বোচ্চ প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও শোধনের মাধ্যমে প্রাত্যহিক কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে।
পল্লি অঞ্চলে যেসব স্থাপনা জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী, সেগুলো পরিবর্তন ও সংশোধন করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রেও সমস্যার মূলে যেতে হবে এবং সমাধানের জন্য প্রকৌশল, ভূতত্ত্ব ও জীববিজ্ঞানের সমন্বয় ঘটাতে হবে। মোটের ওপর শহরের তুলনায় পল্লি অঞ্চলে জলাবদ্ধতার সমাধান করা কিছুটা সহজ।
প্রাকৃতিকভাবে বন্যাপ্রবণ এবং কম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বেড়িবাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে বন্যা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা না করাই ভালো। এসব এলাকা থেকে জনবসতি উঁচু এলাকায় সরিয়ে নিয়ে এবং কৃষিব্যবস্থা পরিবর্তনের মাধ্যমে বন্যার ক্ষতি অনেকটাই কমিয়ে আনা যায়।
সুনামগঞ্জের হাওর এলাকার মানুষ বার্ষিক প্লাবনে অভ্যস্ত। তাদের জীবনযাপন এবং কৃষিব্যবস্থা অন্যান্য এলাকার জন্য অনুকরণীয় হতে পারে। অতি বন্যা মোকাবিলায় দরকার বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে বর্তমান ও ভবিষ্যতে বন্যার প্রকৃতি ও ব্যাপকতা নিরূপণ করা। ডেটা ও মডেলের সমন্বয়ে শুধু পূর্বাভাস নয়, চলমান সময়ে বন্যার গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ ও নিরূপণ সম্ভব। এ জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক সেন্সর নেটওয়ার্ক স্থাপন করা দরকার হবে। বন্যার সঙ্গে সম্পর্কিত সেন্সর তৈরির প্রযুক্তি সহজলভ্য এবং বাংলাদেশের প্রকৌশলীরা স্বল্প খরচে এগুলো নির্মাণ ও স্থাপন করতে সক্ষম। এ ছাড়া উজানের দেশের সঙ্গে তথ্য–উপাত্ত বিনিময়ের মাধ্যমে পূর্বাভাসের মান বাড়ানো যায়।
উপরুক্ত পরিকল্পনাগুলো পর্যায়ক্রমে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে আশা করা যায় সিলেট এবং সুনামগঞ্জবাসী চরম মানবিক বিপর্যয় এবং অসহনীয় দুর্ভোগ থেকে রক্ষা পাবে।