উচ্চ ফলনশীল ধান চাষাবাদে ব্যাপক ভাবে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন। ব্যাপক ভাবে রাসায়নিক সার প্রয়োগের ফলে ক্রমে কৃষি জমির উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে। ক্রমে কৃষি জমি/মাটি হয়ে পড়ছে পুষ্টিহীন অর্থাৎ জমি/মাটির উর্বরাশক্তি কমে যাচ্ছে। যা চাষাবাদের জন্য উদ্বেগজনক। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে বিশেষজ্ঞরা বলেন- চাষাবাদে জৈব সারের ব্যবহার থেকে শুরু করে জৈব কৃষির দিকে নজর দেয়া উচিৎ। তাঁদের মতে, জৈব উপাদানের অভাবেই আমাদের কৃষি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। একই সাথে ক্রমে প্রকৃতিও অনেক বেশি বৈরি হয়ে ওঠছে। চাষাবাদে মনে রাখা উচিৎ- ‘আমার খাদ্য জোগায় মাটি, তার স্বাস্থ্য রাখব খাঁটি।’ সাথে সাথে এও মনে রাখা দরকার- ‘আবর্জনা পঁচা জৈব সার যদি করেন ব্যবহার, মাটির স্বাস্থ্য ভাল হবে ফসল বাড়বে চমৎকার।’
বারোমাসী ধান হিসেবে দেশে ইতিমধ্যে স্বীকৃতি পেয়েছে নেরিকা-১। এ জাতের আরো দু’টি ধান হলো নেরিকা-২ এবং নেরিকা-৩। নেরিকা ধান চাষাবাদের অন্যতম গুণগত বৈশিষ্ট্য হলো এর স্বল্প জীবনকাল। সরাসরি বীজ বপণের মাধ্যমে চাষাবাদ করা হলে ৮৫ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে ফসল তোলা যায়। গতানুগতিক চাষাবাদ অর্থাৎ বীজ তলায় চারা করে পরবর্তীতে প্রস্তুতকৃত মূল জমিতে চাষাবাদে ফসল তুলতে সর্বোচ্চ ১০০ দিন সময় লাগে বলে সংশ্লিষ্টরা বলেন। বীজতলায় চারার বয়স ১২ থেকে ১৫ দিন হলে নেরিকা-১ জাতের ধান মূল জমিতে রোপণের উপযোগি হয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, নেরিকা ধানের বৈশিষ্টের মধ্যে আছে মাটির গভীর থেকে খাদ্য গ্রহণের ক্ষমতা, রোগ-বালাই প্রতিরোধ ক্ষমতা, সহজে ধান ঝরে না পড়া, আলোক অসংবেদনশীলতা, উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ এবং সর্বোপরি সারা বছর চাষের উপযোগি। উল্লেখ্য, এশিয়ান অরাইজা স্যাটাইভার সংগে আফ্রিকান অরাইজা গাবারিমা শংকরায়ন করে আফ্রিকা রাইস সেন্টার ১৯৯০ সালে ইন্টারন্যাশনাল স্পেসিফিক নেরিকা ধান উদ্ভাবন করে। শংকরায়ন করে উচ্চ ফলনশীল জাতের এ ধান উদ্ভাবন পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম সাফল্য। নেরিকা জাতের ধানের ভাত সুস্বাদু ও সুগন্ধিযুক্ত। সব মিলিয়ে এ ধান চাষাবাদ নি:সন্দেহে লাভজনক।
বাংলাদেশ ধান গবেষনা ইনস্টিটিউট (ব্রি) কর্তৃক উদ্ভাবিত একটি ভালো ধান হলো-বাংলামতি (ব্রি-৫০)। উচ্চ ফলনশীল এ ধান বোরো মওসুমে চাষাবাদের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। অত্যন্ত সম্ভাবনাময় এ ধান ক্রমান্বয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লেও সবচেয়ে বেশি চাষাবাদ হচ্ছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে। চাষাবাদ সংশ্লিষ্ট অনেকে বলেন, বিদেশী হাইব্রিড ধানকে পেছনে ফেলে বাংলামতি ধানের বাম্পার ফলন হচ্ছে। এ ধানের চাল পোলাও, কোরমা ও বিরিয়ানি তৈরীর জন্য খুবই উপযোগি এবং রফতানিযোগ্য। এ ধান চাষাবাদে সাফল্যের খবর প্রায়ই বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে আসছে। উল্লেখ্য, এ ধানকে অনেকেই বিশ্বখ্যাত ভারত-পাকিস্তানের বাসমতি ধানের সাথে তুলনা করেন। এ ধান মৃদু লবণাক্ত জমিতেও চাষাবাদ সম্ভব।
শীতকালীন সবজি ওলকপি চাষাবাদের জন্য বীজ বপনের সময় হলো ভাদ্রের শুরু থেকে পৌষের শেষ পর্যন্ত। একর প্রতি ২৫০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। ওলকপির চারার বয়স ২০-২৫ দিন হলে তা মূল জমিতে স্থানান্তর করতে হয়। পূর্ব প্রস্তুতকৃত মূল জমিতে চারা রোপণের জন্য চারা থেকে চারার দূরত্ব হবে ১.৫ ফুট এবং একই ভাবে সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে ১.৫ ফুট। উল্লেখ্য, উপযুক্ত পরিচর্যায় ভালো জাতের ওলকপি একরে বিশ হাজার থেকে চব্বিশ হাজার কেজি পর্যন্ত হতে পারে।
শীতকালীন অন্যতম জনপ্রিয় সবজি শিম চাষাবাদে এর গাছ/লতা দুই থেকে তিন হাতের মতো লম্বা হলে আগা/ডগা ভেঙ্গে দেয়া ভালো। এতে মূল গাছ মজবুত অর্থাৎ হৃষ্ট-পুষ্ট হয়। একই সাথে মূল গাছের পাতার গোড়া থেকে নতুন করে বলিষ্ট-সতেজ শাখা বের হয়। নতুন বেরুনো শাখা/লতা উপযুক্ত পরিচর্যায় তরতরিয়ে বেড়ে ওঠে। এতে গাছ ঝোঁপালো হয় এবং সঙ্গত কারণেই ফলনও অনেক বেশি পাওয়া যায়।
ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ‘গোল্ডেন আপেল’ খ্যাত আমড়ার চাষাবাদ ও চাহিদা দেশে ক্রমে বাড়ছে। এক সময় অবহেলা করা হলেও এখন আমড়া বাণিজ্যিক ভাবে প্রায় সারা দেশেই চাষাবাদ হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেশি চাষাবাদ হচ্ছে বরিশাল বিভাগে। বরিশাল অঞ্চলের সব জেলায় আমড়ার বাণিজ্যিক চাষাবাদ হলেও সবচেয়ে বেশি চাষাবাদ হয় বরিশাল জেলার বানারীপাড়ায়, পিরোজপুর জেলার আটঘর ও কুড়িয়ানায় এবং ঝালকাঠি জেলার পোষন্ডা গ্রামে। স্বাদ ও পুষ্টিগুণে বরিশালের আমড়ার জনপ্রিয়তা অনেক বেশি। স্বাদ ও আকার-আকৃতিতে হুবহু বরিশাল অঞ্চলের মতো না হলেও এ আমড়া সারা দেশেই চাষাবাদ সম্ভব। বর্ষায়/বন্যায় পানি ওঠে না এমন জায়গা আমড়া চাষের জন্য উপযোগি।
বিদেশী দূর্লভ ও লোভনীয় ফল আঙ্গুর চাষাবাদ এখন দেশে হচ্ছে। সফল আঙ্গুর চাষাবাদের মাধ্যমে অনেকেই ইতিমধ্যে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে শিরোনাম হয়ে ওঠেছেন। আঙ্গুরের অনেকগুলো জাত রয়েছে, এর মধ্যে দেশে সফল চাষাবাদের দু’টি জাত হচ্ছে- মেনিনডি সিডলেস ও ক্রিমসন সিডলেস। আঙ্গুর গাছের জন্য বাউনি/মাচা প্রয়োজন। অনেকে স্থায়ীভাবে মাচা তৈরীতে পাকা খুঁটি ও জিআই তার ব্যবহার করেন। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, আঙ্গুর চাষাবাদ সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে পারলে দেশের অপুষ্টি দূরীকরণের পাশাপাশি আমদানি কমিয়ে বহু বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় সম্ভব।
লেখক: আব্দুর রশীদ লুল, সম্পাদক – আনোয়ারা (শিকড় সন্ধানী প্রকাশনা)।