ফলের পুষ্টিগুণ ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার প্রতি ইঙ্গিত করে ভালো থাকার জন্য খনা বারো মাসই মানুষকে ফল খেতে উৎসাহিত করেছেন। উল্লেখ্য, এই একবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের জয় জয়কার সময়ে বিজ্ঞানীরাও বলছেন, ভালো থাকতে হলে নিয়মিত ফল খেতে হবে।
০২. বিজ্ঞানীরা বলেছেন, সুস্থতার জন্য একজন মানুষের প্রতিদিন ১০০-১১০ গ্রাম ফল খাওয়া প্রয়োজন। কেননা ফলে পুষ্টি ও বল ছাড়াও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু আমরা খাচ্ছি গড়ে ৩৫-৪০ গ্রাম। এর অন্যতম কারণ ফলের প্রাপ্যতা অপ্রতুল। আমাদের ভগ্ন স্বাস্থ্য ও অপুষ্টির এটা একটা অন্যতম কারণ।
০৩. মৃত্যুঞ্জয় রায় দেশের একজন স্বনামধন্য কৃষিবিদ ও লেখক। তাঁর কৃষি বিষয়ক উল্লেখযোগ্য বইগুলো হচ্ছে- কুলের বাগান, ফল বাগানের পোকামাকড়, ফসলের পুষ্টি সমস্যা ও প্রতিকার, টমেটো চাষ ও বালাই ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি। তিনি বাংলাদেশে উৎপাদিত ১৩০ টি ভিন্ন জাতের ফলের তালিকা করেছেন। বাংলাদেশের কৃষি বিজ্ঞানীরা ষাটাধিক উন্নত জাতের ফল অবমুক্ত করেছেন। এর মধ্যে বৃক্ষজাত ফল ৪৫% এবং অবৃক্ষজাত ফল ৫৫%।
০৪. অনেকেই দেশে উৎপাদিত সহজ লভ্য ফলের চেয়ে বিদেশী দামী ফল পছন্দ করেন। ভাবেন বিদেশী দামী ফলের পুষ্টিগুণ অনেক বেশী। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এ ধারণা ভূল। উদাহরণ স্বরূপ, বিদেশী দামী ফল আপেল ও দেশীয় সস্তা ফল পেয়ারার কথা বলা যায়। পরীক্ষায় দেখা গেছে, দেশীয় ১০০ গ্রাম ওজনের একটা পেয়ারায় আছে ১০০ মাইক্রোগ্রাম ক্যারোটিন এবং ২১০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি। পক্ষান্তরে ১০০ গ্রাম ওজনের আপেলে কোনো ক্যারোটিন নেই, ভিটামিন সি আছে মাত্র ৪ মিলিগ্রাম। বলা বাহুল্য, দেশে উৎপাদিত ফল শক্তি, পুষ্টি ও বিচিত্র স্বাদে অতুলনীয়।
০৫. আমাদের দেশে মাটি ও জলবায়ু ফল চাষের জন্য খুবই উপযোগী। একটু আন্তরিক হলে, বসত বাড়ির আশে-পাশে, রাস্তার ধারে ও অনাবাদী জমিতে পরিকল্পিত ভাবে ফল গাছ রোপণ করা যায়। উষ্ণতা, প্রখরতা অথবা শৈত্য কোনোটাই আমাদের দেশে ফল চাষের জন্য চরম ভাবাপন্ন নয়।
০৬. ফলের গাছ পরিকল্পিত ভাবে রোপণ করতে হবে। আমাদের দেশে সঠিক স্থান, সঠিক দূরত্ব ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে ফল ভালো হয় না। এ প্রসঙ্গে খনার বচন- “গাছ গাছালি ঘন সয় না/গাছ হবে তো ফল হবে না।”
০৭. নিয়ম মাফিক বছরে দুইবার ফল গাছে সার প্রয়োগের মাধ্যমে দ্বিগুণ ফল লাভ সম্ভব। বিশিষ্ট কৃষিবিদ এবং লেখক মো. জাহাঙ্গীর আলমের মতে, ”শীতে ফল গাছের প্রতি যত বেশী যতœশীল হওয়া যায়, পরবর্তী সময়ে ফলগাছ তত বেশী গুণগত মানসম্পন্ন ফল দিয়ে থাকে।”
০৮. আঁশ জাতীয় ফল, যেমন- তরমুজ ও কাঁঠাল এবং টক জাতীয় ফল যেমন আনারস ও জাম্বুরা সকালে খেলে সারা দিনের পরিশ্রমে হজম হয় এবং ক্রিমি ও আমাশয় উপশম হয়। তবে একবারে খালি পেটে টক জাতীয় ফল বিশেষত: আনারস না খাওয়াই ভালো। দুপুরে অন্যান্য ফল যেমন- পেয়ারা ও আপেল এবং রাতে খাবারের সাথে রেচক জাতীয় ফল যেমন- আম, কলা ও পেঁপে খেলে সহজে হজম হয় এবং মৃদু রেচকের কাজ করে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
০৯. ফলের গাছ রোপণ ও পরিচর্যার মাধ্যমে পর্যাপ্ত পরিমাণ ফল উৎপাদন করে উন্নয়নশীল এ দেশের পুষ্টি সমস্যা দূরীকরণ, ক্যালরি ঘাটতি পূরণ, রোগ প্রতিরোধ তথা চিকিৎসা ব্যয় সংকোচন সর্বোপরি বেকার সমস্যা সমাধান তথা দারিদ্র্য বিমোচনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখা সম্ভব। অনেকে বলেন, আমাদের দেশে দারিদ্র্য মানুষের চেয়ে অপুষ্টিতে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা অনেক বেশী।
১০. আমাদের দেশে উৎপাদিত মোট ফলের ৫৪% পাওয়া যায় বৈশাখ থেকে শ্রাবণের মধ্যে। এ সময় সংরক্ষণ, পরিবহন ও বাজারজাত করণের সমস্যায় প্রচুর ফল নষ্ট হয়। বছরের অবশিষ্ট আট মাসে পাওয়া যায় মোট উৎপাদিত ফলের ৪৬%। এ সময় ফলাহাবের অভাবে মানুষজন বিশেষতঃ মহিলা, শিশু ও বৃদ্ধরা বিভিন্ন অসুস্থতায় ভোগেন।
১১. কৃত্রিম ভাবে পাকানো ফল খাওয়া স্বাস্থ্যের অত্যন্ত ক্ষতিকর। উল্লেখ্য কৃত্রিম ভাবে পাকানো ফলের রং উজ্জ্বল ও আকর্ষণীয়। যা সহজেই ক্রেতা টানে। এসব ফল খেলে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। এমনকি ক্যান্সার, ব্লাড প্রেসার, ডায়বেটিস ও কিডনীর জটিলতা দেখা দেয়। যা জীবনের জন্য হুমকী স্বরূপ। এসব থেকে পরিত্রাণ পেতে নিজের হাতে বসত বাড়ীর আশে-পাশে ও অন্যান্য স্থানে ফলদ গাছ রোপণ করা যেতে পারে। উপরন্তু নিজের হাতে লাগানো গাছের ফল খাওয়া ও বিতরণের আনন্দই আলাদা।
১২. ফল রান্না করে খাওয়া হয় না বলে এর পুষ্টি গুণ অক্ষুন্ন থাকে। তবে গাছ থেকে ফল সংগ্রহের পর তরতাজা অবস্থায় খাওয়া ভালো। ফল বাসী হলে এবং বেশী নাড়াচাড়া করলে ক্রমান্বয়ে পুষ্টিগুণ কমতে থাকে।
১৩. সরকার ঘোষিত এবারের ফলদ বৃক্ষরোপন পক্ষ (১৫-৩০ জুন ২০০৯)-এর প্রতিপাদ্য- “ফল বৃক্ষের সমাহার, একটি বাড়ি একটি খামার।”
১৪. দেশে এবং পৃথিবীতে জনসংখ্যা বাড়ছে। সেই অনুপাতে বাড়ানো দরকার ফলদ গাছের সংখ্যা। বলা দরকার, বর্ষাকাল ফলদ গাছ (এবং অন্যান্য গাছ) রোপণের উপযুক্ত সময়।
লেখকঃ কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও কৃষি উন্নয়ন কর্মী।