মুক্তির পরপরই চারিদিকে হইচৈই ফেলতে সক্ষম হওয়া বিশাল বাজেটের ভারতীয় চলচ্চিত্রটির নাম “পাঠান”। চলচ্চিত্রটি সম্প্রতি কয়েকজন বোদ্ধা বন্ধুর সাথে ওয়েষ্ট লণ্ডনের একটি প্রেক্ষাগৃহে দেখার সুযোগ হয়েছিলো।
ফিল্মটি দেখে মনে হলো- ব্যবসায়িক সফলতার মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের আর্থিক আয়ের পাশাপাশি চিরশত্রু প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকে অমানবিক হিসেবে তুলে ধরার সাংস্কৃতিক যুদ্ধজয়ের কাজটি সার্থকভাবে করতে পেরেছে ভারত। কিন্তু তা করতে যেয়ে অমানবিক চরিত্রে দাঁড় করানো পাকিস্তানীদের সাথে কিন্তু প্রেম-প্রণয়ের কাজটি বাদ পড়েনি। মধ্যখানে প্রণয়ের সুবাদে পাকিস্তানী নারী গোয়েন্দার সাথে চরম রোমাঞ্চ এবং ঘাম ঝরানো মিশন শেষে পাঠান’র মুখে স্বস্তির “জয় হিন্দ” উচ্চারণের মধ্যদিয়ে শেষ হয় চলচ্চিত্রটি। এদিক থেকে বলা যায়, চূড়ান্তভাবে সফল হয়েছেন এর নির্মাতারা। তবে হলিউড অ্যাকশন ছবির আদলে অতিমাত্রার ভিএফএক্স’র ব্যবহার ফিল্মটির বিশ্বাসযোগ্য বাস্তবতাকে কিছুটা হলেও ক্ষুন্ন করেছে বলে আমার মতো অনেক দর্শককের মনে হওয়া স্বাভাবিক। কারণ অতিবাস্তবতা হয়তো কেবল রোবটীয় বিশ্বের বাস্তবতা হতে পারে।
ফিল্মটির নাম যেমন “পাঠান” তেমনি দুর্দান্ত শক্তিমত্তা ও সাহসিকতা প্রদর্শিত হয়েছে প্রতিটি সিকোয়েন্স। আমরা জানি, পাঠান ভারতীয় উপমহাদেশের একটি বিশেষ মানবগোষ্ঠী, যাদের বেশকিছু স্বাতন্ত্র্যে বৈশিষ্ট রয়েছে এবং তাদের মূল আবাস আফগানিস্তানের দুর্গম পাহাড়ী অঞ্চলে হলেও পাকিস্তান ও ভারতে বেশকিছু পাঠান বাস করেন। অতিথিপরায়ন, ধার্মিক, পরিশ্রমী ও দৃঢ়চেতা হিসেবেও তাদের খ্যাতি রয়েছে। তাদের জাতিগত চেতনা খুব বেশী। তারা যে দেশেই বাস করুক, সবার আগে নিজেকে পাঠান হিসেবে পরিচিয় দিতে পছন্দ করে। একজন পাঠান তার বংশ বা গোত্রের সম্মানের জন্য জীবন দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না। সাহসিকতা ও শক্তিমত্তা বোঝাতে “পাঠান কা বেটা” বলে একটি কথা চালু আছে।
তাদের অতিথিপরায়নের বর্ণনা গিতে গিয়ে বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী তার বিখ্যাত ভ্রমণ কাহিনী ‘দেশে বিদেশে’ বইয়ে লিখেছেন, ‘আজ বলতে পারি পাঠানের অভ্যর্থনা সম্পূর্ণ নির্জলা আন্তরিক। অতিথিদের বাড়িতে ডেকে নেয়ার মতো আনন্দ পাঠান অন্য কোন জিনিসে পায় না- আর সে অতিথি যদি বিদেশী হয় তা’হলে তো আর কথাই নেই’।
তবে ‘পাঠান’ এর সাফল্যের পেছনে ফিল্মটির পরিচালক ও কাহিনীকার সিদ্ধার্থ আনন্দ এবং রচয়িতা শ্রীদার রাঘবন ও আব্বাস টায়ারওয়ালার কীর্তি স্বীকার করতেই হয়। দুর্দান্ত সিনেমাটোগ্রাফি এবং টানটান স্ক্রিপ্টের কারণে কোথাও হোঁচট খায়নি বা ঝুলেও পড়েনি। ভালো রাইটার ছাড়া ভালো সিনেমা বানানো ইম্পসিবল, আর ভালো রাইটার যে ক্রিঞ্জ এলিমেন্ট দিয়েও টাইট স্ক্রিনপ্লে তৈরি করতে পারে তার প্রমাণই পাঠান।
পাঠান এবছরের শুরুতে (২৫ জানুয়ারী) মুক্তিপ্রাপ্ত ভারতীয় হিন্দি ভাষার অ্যাকশন থ্রিলার চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রটিতে প্রধান চরিত্রে আছেন ভারতীয় সিনেমার কিং খান খ্যাত শাহরুখ খান, জন আব্রাহাম, এবং দীপিকা পাড়ুকোন। ফিল্মটি নাম চরিত্র পাঠান হলেন শাহরুখ খান, প্রতিদ্বন্দ্বী জিম চরিত্রে জন আব্রাহাম, প্রধান নারী রুবিনা মহসিন চরত্রে দীপিকা পাড়ুকোন এবং মিশনের মধ্যখানে বিপদে পতিত পাঠানকে উদ্ধারকারী হিসেবে টাইগার চরিত্রে বলিউডের আরেক কিং, সুলতান খ্যাত সালমান খান অভিনয় করেন।
পোস্ট কোভিড বিশ্বের কনসেপ্টে “পাঠান” বলা যায় চমৎকার একটি থিমের চলচ্চিত্র। এতদিন বিশ্বের মানুষ পারমাণবিক ও রাসায়নিক মারণাস্ত্রের হুমকি শোনে আসছে। এখন এতে যুক্ত হয়েছে বায়োলজিক্যাল মারণাস্ত্র। চীনের উহান শহর থেকে ছড়িয়ে পড়া মহামারি কোভিডকে চীনের বায়োলজিক্যাল অস্ত্রের ল্যাবের উৎপাদন বলেই মনে করছেন অনেকে। এই সপ্তাহেই একটি রিপোর্টে দেখা গেছে ইউএস’র এফবিআই এখনো মনে করে কোভিড চীনেরই ল্যাবে সৃষ্ট জীবনঘাতি ভাইরাস!
এমনি বায়োলজিক্যাল একটি ভাইরাস “রক্তবীজ” এর সর্বনাশী হাত থেকে ভারতকে বাঁচাতে প্রাণপণ যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা “র” এর প্রাক্তন এজেন্ট পাঠানকে। আর রক্তবীজের জন্য দায়ী করা হয় পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইকে। মধ্যখানে বিভিন্ন অপারেশনে পাঠানের সাথে পাকিস্তানী ডাক্তার রুবিনা মহসিনের সাথে পরিচয় এবং তাঁর সাথে প্রণয়ে জড়ান পাঠান। ফিল্মটি শুরু হয় ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের স্পর্শকাতর ইস্যু জম্মু ও কাশ্মীরের একটি সংবাদের প্রতিক্রিয়া ও প্রেক্ষাপটকে ঘিরে।
কাহিনীটি এভাবে এগোতে থাকে যে, ২০১৯ সালে ভারত সরকার জম্মু ও কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা প্রদানকারী সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে। এখানে বলে রাখা দরকার যে- ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের অধীনে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে প্রদত্ত একটি বিশেষ মর্যাদা, যা জম্মু ও কাশ্মীরের স্বায়ত্ত্বশাসন ও সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দিতো। আর এই ধারা সংবিধানে যুক্ত হয়েছিলো ভারত ও কাশ্মীরের নেতাদের দীর্ঘ আলোচনার ভিত্তিতে। কিন্তু ২০১৯ সালের ৫ আগষ্ট ভারতের ক্ষমতাসীন মৌলবাদী বিজেপি সরকার সংবিধানের সুদূরপ্রসারী ব্যবস্থার মাধ্যমে তা বাতিল করে দিয়েছিল। একই সাথে কাশ্মীর উপত্যকাটির সমস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছিল।
এই ৩৭০ ধারা বাতিলের খবরটি ক্যান্সারে আক্রান্ত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর জেনারেল কাদিরকে প্রভাবিত করে ও তিনি ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি একটি বেসরকারী সন্ত্রাসী সংগঠন “আউটফিট এক্স”-এর নেতৃত্ব দানকারী জিমের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এদিকে, প্রাক্তন “র” এজেন্ট পাঠান এবং তার সিনিয়র অফিসার নন্দিনী “জয়েন্ট অপারেশন অ্যাণ্ড কোভার্ট রিসার্চ” (জেওসিআর) নামে একটি ইউনিট খোলেন ও ট্রমা বা আঘাতের কারণে অবসর নিতে বাধ্য হওয়া এজেন্টদের নিয়োগ দেন।
কর্নেল সুনীল লুথরার পাঠানের অনুরোধ গ্রহণ করেন এবং একটি বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে ভারতের রাষ্ট্রপতিকে আক্রমণ করার আউটফিট এক্সের পরিকল্পনা বন্ধ করতে তার দল দুবাই চলে যায়। তবে তারা বুঝতে পারে যে সন্ত্রাসীদের মূল পরিকল্পনা ছিল দুই বিজ্ঞানীকে অপহরণ করা। জিম বিজ্ঞানীদের গাড়িবহরে আক্রমণ করে এবং পাঠান তাকে থামানোর চেষ্টা করে। ফলে একটি লড়াই শুরু হয়, তবে পরে জিম একজন বিজ্ঞানীর সাথে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। লুথরা জানায় যে জিম হচ্ছে একজন প্রাক্তন র এজেন্ট, যাকে কয়েক বছর আগে মৃত ঘোষণা করা হয়েছিল। সোমালীয় সন্ত্রাসীরা জিমের স্ত্রী এবং অনাগত সন্তানকে হত্যা করেছিল, এই ঘটনা ঘটতে দেয়ার জিম তার দেশের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তার মৃত্যুর মিথ্যা কথা প্রচার করে।
এদিকে, পাঠান “রক্তবীজ” নামক কোডওয়ার্ড সম্পর্কে জানতে পারে এবং আরও জানতে পারে যে দুবাইয়ে হত্যা করা ব্যক্তিরা প্রাক্তন এজেন্ট ছিল এবং তাদের অর্থকড়ি স্পেনে রুবিনা মহসিন নামের একজন পাকিস্তানি ডাক্তারের কাছে স্থানান্তরিত হয়েছে। এটি জানার পর পাঠান স্পেনভ্রমণ করে, তবে সে জিমের লোকদের কাছে ধরা পড়ে যায়, সেখানে সে আরও জানতে পারে যে রুবিনা হচ্ছে একজন প্রাক্তন আইএসআই এজেন্ট। জিম যখন তার আস্তানা ছেড়ে যায়, রুবিনা জিমের লোকদের আক্রমণ করে এবং পাঠানের সাথে পালিয়ে যায়। রুবিনা জানায় যে রক্তবিজ মস্কোতে রয়েছে এবং জিমের আগে এটি তাদের হস্তগত করতে তারা মস্কোতে যায়। তবে রুবিনা পাঠানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং তাকে পুলিশে ধরিয়ে দেয়। পরে জানা যায় যে রক্তবীজ চুরি করতে জিম রুবিনাকে ব্যবহার করে পাঠানকে বাধ্য করেছিল। পাঠানকে বন্দী করে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়, তবে টাইগার এসে তাকে উদ্ধার করে।
তিন বছর পর, পাঠান আফ্রিকায় যায় এবং জিমের সহযোগী রাফিকে ধরে ফেলে। তারপর সে নন্দিনীর সাথে দেখা করে এবং জিম যে দুটি ক্ষেপণাস্ত্র কিনেছে তা নন্দিনীর কাছে প্রকাশ করে, অন্যদিকে নন্দিনী প্যারিসে রুবিনার অবস্থানের কথা প্রকাশ করে। পাঠান রুবিনার সাথে দেখা করে, রুবিনা জানায় যে রক্তবীজ হল গুটিবসন্তের মতো নকশা করা রূপান্তরিত প্রাণঘাতী ভাইরাস, জিম যে বিজ্ঞানীকে বন্দী করেছিল এটি তার তৈরী। তার দেশ এই ধরনের হামলার পরিকল্পনা করবে তা না জেনেই পাঠানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য রুবিনা পাঠানের কাছে ক্ষমা চায়। তারা জিমের ল্যাবে হানা দেয়, জিম অন্যদের সাথে পালিয়ে যায় তবে তারা ভাইরাসযুক্ত একটি অরব পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়। তারপর পাঠান এবং তার দল ভাইরাসের জন্য ভ্যাকসিন প্রস্তুত করতে একটি ল্যাবে যায়।
পাঠান ২০২৩ সালের ২৫ জানুয়ারী প্রজাতন্ত্র দিবসের সাপ্তাহিক ছুটির দিনে আইম্যাক্স, ৪ডিএক্স ও স্ট্যান্ডার্ড ফরম্যাটে ভারতে মুক্তি পায়। এটি একই সাথে তামিল এবং তেলেগু ভাষায় ডাবিং করে মুক্তি দেওয়া হয়। চলচ্চিত্রটি সমালোচকদের কাছ থেকে ইতিবাচক পর্যালোচনা লাভ করে এবং হিন্দি চলচ্চিত্রের ইতিহাসে উদ্বোধনী দিনে ও উদ্বোধনী সপ্তাহান্তে সর্বোচ্চ আয়ের ভারতীয় বক্স-অফিস রেকর্ড ভাঙে। বিদেশী বাজারেও এটি বেশ কিছু আয়ের রেকর্ড ভাঙে।
চলচ্চিত্রটি নিয়ে যেমন আলোচনা আছে তেমনি সমালোচনাও রয়েছে। মুক্তির আগে ‘বেশারম রং’ নামে এর একটি গানের সঙ্গীত ভিডিও প্রকাশিত হয়। সঙ্গীত ভিডিওতে দীপিকা পাড়ুকোন জাফরান বা গেরুয়া রঙের বিকিনি পরিহিত অবস্থায় দেখা যায়, যার ফলে ডানপন্থী হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলি প্রতিবাদ জানায় এবং ছবিটি বয়কটের চেষ্টা করে। অনেকে গানটিকে ‘অশ্লীল’ বলে আখ্যায়িত করে বলেছেন যে এটি ভারতীয় সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যায়। কেউ কেউ বলেছেন, এটি “নোংরা মানসিকতার সাথে শ্যুট করা হয়েছে ও দীপিকার পোশাককে আপত্তিকর বলে মনে করেন। একটি মুসলিম সংগঠনও গানটির ব্যাপারে আপত্তি জানায়। গানটির সিকোয়েন্সে কিছু সম্পাদনার পাশাপাশি চলচ্চিত্রে কিছু ছোটখাটো পরিবর্তনের পর চলচ্চিত্রটিকে প্রদর্শনের জন্য ছাড়পত্র প্রদান করা হয়।
কৃতজ্ঞতা: চলচ্চিত্রটি দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য প্রিয়জন শরীফ ভাইকে (কবি, সাংবাদিক মুহাম্মাদ শরীফুজ্জামান) অশেষ ধন্যবাদ। সাথে ছিলেন আমাদের আরেক প্রিয়জন খান ভাই (লেখক ও বোদ্ধা সমালোচক হাসনাত আরিয়ান খান)। এর আগে শরীফ ভাইয়ের আগ্রহে প্ল্যান-প্রোগ্রাম করেও শেষ পর্যন্ত সেটি দেখা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এরই মধ্যে কথা প্রসঙ্গে খান ভাই ছবিটি দেখা দরকার বলে আগ্রহ প্রকাশ করার সাথে সাথে শরীফ ভাই তার এলাকা আক্সব্রিজে সব বন্দোবস্ত করে ফেলেন। দেখার আগে ও পরে জম্পেস আড্ডা আর ভূরিভোজ তো ছিলোই।
লেখক: কবি, লণ্ডন থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সুরমার বার্তা সম্পাদক