ভিটামিন এ সমৃদ্ধ পুষ্টিকর সবজি গাজরে ক্যালসিয়াম, লৌহ, ফসফরাস, শ্বেতসার ছাড়াও অন্যান্য ভিটামিন যথেষ্ট পরিমাণে থাকায় স্বাস্থ্য সচেতন জনগোষ্ঠী ক্রমেই এর দিকে ঝুঁকছেন। ফলে এর চাষাবাদও গুরুত্ব পাচ্ছে। দেশে অদ্যাবধি গাজরের অনুমোদিত কোন জাত না থাকলেও সাধারণত বিদেশ থেকে আমদানীকৃত রয়েল ক্রস, কোরেল ক্রস, ইয়েলো রকেট, ওয়েপুড কিং প্রভৃতি জাতের গাজর চাষাবাদ হয়। আশ্বিন-কার্তিক মাস গাজরের বীজ বপণের উপযুক্ত সময়। পানি নিষ্কাশনের সুবিধা সম্বলিত দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটি গাজর চাষাবাদের জন্য উপযোগী। পরিচর্যার সুবিধার জন্য গাজর সারিতে চাষাবাদ করা ভালো। এ ক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে ২০ সে.মি এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব হবে ১০ সে.মি। উল্লেখ্য, গাজরের বীজ খুব ছোট বিধায় ধনিয়া ও ডাটার বীজের মতো ছাই বা ধুলা-বালি মিশিয়ে বপণ করতে হয়। চারা গজানোর ৭০-৮০ দিন পর সাধারণত গাজর সংগ্রহের উপযোগী হয়।
রংপুর, কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুর, পাবনা, বগুড়া প্রভৃতি এলাকায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যাপকভাবে চাষাবাদ হয় এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সবজি পটল। এক সময় পটলের প্রতি মানুষের আগ্রহ কম থাকলেও ক্রমান্বয়ে এটি জনপ্রিয় হচ্ছে। ফলে এর চাষাবাদও বাড়ছে। পটল চাষাবাদের জন্য উচ্চতর তাপমাত্রা ও অধিক সূর্যালোক উপযোগী। এ সবজি চাষাবাদের সাথে সংশ্লিষ্টদের ধারণা অত্যধিক বৃষ্টিপাত ফুলের পরাগায়ণ ব্যাহত করে। বন্যার পানি ওঠে না এবং বর্ষাকালে পানি নিষ্কাশনের সুবিধা সম্বলিত দোআঁশ ও এঁটেল দোআঁশ মাটি পটল চাষাবাদের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। পটলের উল্লেখযোগ্য জাত গুলোর মধ্যে আছে বারি পটল-১, বারি পটল-২, ডোরাকাটা ও মুর্শিদাবাদী। এর বংশ বিস্তারের জন্য গেড়, কাটিং বা পুরাতন লতার খন্ড ব্যবহার করা হয়। আশ্বিন-অগ্রহায়ণ এবং ফাল্গুন-চৈত্র মাস লতা লাগানোর উপযুক্ত সময়। বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের জন্য সারি থেকে সারির দূরত্ব হতে ১৫০ সে.মি এবং লতা থেকে লতার দূরত্ব হবে ১০০ সে.মি।
একটি বেসরকারী বীজ কোম্পানী বাজারে প্রচলিত চাল কুমড়ার অনেক গুলো জাত রয়েছে। যেমন- দূর্বার, দুরন্ত, জুপিটার হাইব্রিড ও পোলস্টার হাইব্রিড। এর মধ্যে জুপিটার হাইব্রিড চাল কুমড়ার চাষাবাদের সময় হলো ফেব্রুয়ারি-আগস্ট পর্যন্ত। বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদে প্রতি শতাংশে সাধারণত ১.৫ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। উপযুক্ত পরিচর্যায় বীজ বপনের ৫০-৬০ দিনের মধ্যে ফসল সংগ্রহ করা যায়। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদে একর প্রতি ১৮-২০ টন পর্যন্ত ফলন পাওয়া যেতে পারে।
দেশে বিভিন্ন জাতের আলুর চাষ করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে একটি উন্নত জাত হলো বারি আলু-১ (হীরা)। এ জাতের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো উপযুক্ত পরিচর্যায় এ গাছ দ্রুত বাড়ে এবং তাপ সহিষ্ণু। এ ছাড়া এ জাতটি মড়ক ও ভাইরাস সহনশীল। বপণের ৬০-৬৫ দিন পর থেকে আলু উত্তোলন করা যায়। হেক্টর প্রতি এর ফলন ৩০-৩৫ টন হতে পারে। উল্লেখ্য, এ জাতের আলু বগুড়া, কুমিল্লা ও যশোর অঞ্চলে বেশি চাষাবাদ হয়ে থাকে।
প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম, লৌহ ও ক্যারোটিন সমৃদ্ধ দেশের অন্যতম জনপ্রিয় সবজি কাঁকরোল। এটি গ্রীস্মকালে চাষাবাদ করা হয়। দোআঁশ ও এঁটেল দোআঁশ মাটি কাঁকরোল চাষের জন্য উত্তম। এর বীজ বপণ বা মোথা রোপণের উপযুক্ত সময় মধ্য এপ্রিল থেকে মধ্য জুন পর্যন্ত। কাঁকরোলের অনেক গুলো জাত রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি জাত হলো- মণিপুরী, আসামী, মধুপুরী, মুকন্দপুরী প্রভৃতি। ফসল সংগ্রহের উপযুক্ত সময় মধ্য জুলাই হতে মধ্য সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। উপযুক্ত পরিচর্যায় জাতভেদে হেক্টর প্রতি ২০-২৫ টন ফলন পাওয়া যেতে পারে। উল্লেখ্য, কাঁকরোল পেঁপে এবং কাঁঠালের মতো জলাবদ্ধতা মোটেই সহ্য করতে পারে না।
দেশের জনপ্রিয় একটি সবজি বেগুন। এর অনেক গুলো জাত রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য ও উন্নতমানের একটি জাত হলো বারি বেগুন-২ (তারাপুরী)। এ জাতের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এটা ব্যাকটোরিয়াজনিত ঢলে পড়া রোগ প্রতিরোধী। শীতকালে দেশের সব জেলায় চাষাবাদ উপযোগি এ জাতের গাছে সাধারণত: ৬৫-৭৫টি পর্যন্ত বেগুন ধরে থাকে। ১১০-১৪০ দিন জীবনকালের এ জাতের বেগুনের উপযুক্ত পরিচর্যায় হেক্টর প্রতি ৭৫-৮৫ টন পর্যন্ত ফলন পাওয়া যেতে পারে।
সালাদ, তরকারি ও ভাজি হিসেবে ব্যবহৃত রবি মৌসুমের একটি জনপ্রিয় সবজি মুলা। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ সবজি মুলা চাষাবাদের জন্য দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটি উত্তম। জীবনকাল ৫৫-৬০ দিন ধরা হলেও চারা গজানোর ৪০-৪৫ দিনের মধ্যেই মুলা খাবার পুরোপুরি উপযোগী হয়। মুলার অনেক গুলো জাত রয়েছে। উফশী জাতের মধ্যে আছে, বারি মুলা-১, বারি মুলা-২, বারি মুলা-৩, সুপার-৪০, ট্রপিক্যাল-৪৫ ইত্যাদি। উল্লেখ্য, মুলার পাতা শাক হিসেবেও খাওয়া হয়। এতে প্রচুর ভিটামিন ‘এ’ রয়েছে।
প্রায় সব ধরনের মাটিতে চাষাবাদ সম্ভব হলেও দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটিতে বরবটি সবচেয়ে ভালো জন্মে। এ সবজি চাষাবাদের জন্য উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু উপযোগী, যা দেশে বিদ্যমান। শীতকাল ছাড়া প্রায় সারা বছর এর চাষাবাদ সম্ভব। বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের জন্য সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে ১০০ সে.মি এবং মাদা থেকে মাদার দূরত্ব হবে ৫০ সে.মি। এ ছাড়া মাদার আকার হবে ৪৫x৪৫x৪৫ সে.মি। প্রতি মাদায় ৪/৫টি বীজ বপণ করতে হবে। বরবটির অনেকগুলো জাত রয়েছে। হাইব্রিড দু’টি জাত হলো- সামুরাই ও গ্রীণ ফলস। পারিবারিক চাহিদার জন্য গ্রামাঞ্চলে বসত ঘরের আশে-পাশে এবং শহরাঞ্চলে টবে/ছাদেও চাষাবাদ করা যেতে পারে। বরবটির বাউনীর প্রয়োজন হয়। উল্লেখ্য, বরবটি সুস্বাদু ও পুষ্টিকর সবজি।
লেখক: সম্পাদক – আনোয়ারা (শিকড় সন্ধানী প্রকাশনা)।