১.
“স্যার! কিছু পয়সা দিন, কিচ্ছু কিনে খাব, কাল থেকে খাবার পাচ্ছি না।”
এ ছিল ছিন্নমূল এক শিশুর চাওয়া, যখন আমাদের গাড়িটি ট্রাফিক জ্যামে কোন একদিন আটকা ছিল।
এ দৃশ্য বিরল নয়। বরং কিছু দেশ বা শহরের বহুল ঘটনা।
এশিয়া ও আফ্রিকার বহু শহরে নিজে দেখেছি, এ ভাবেই অভুক্ত মানুষ চেয়ে নিচ্ছে নিরুপায় হয়ে।
কেউ একজন বলেছিলেন, তাঁদের অনেকে নাকি ধোঁকা দেয়, অর্থাৎ অভাব নয় বরং তা তাঁদের অভ্যাস।
কিন্তু এ কথাটিই অনেককে ধোঁকায় ফেলে দেয় অনাহারীর সাথে সদাচরণ করতে।
অল্প সংখ্যক ভিক্ষুক হয়ত প্রবঞ্চনা করছে ঠিকই কিন্তু পৃথিবীর বাস্তবতা না বুঝলে নিজেকেই ধোঁকা দেওয়া হবে।
আর পৃথিবীর বাস্তবতা হল, অগণিত মানুষ এ ধরায় প্রতিদিন খাদ্যের জন্য দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। এ এক নির্মম বাস্তব।
খাদ্যের দুর্গতি যে এ সভ্য দুনিয়ার অন্যতম এক সমস্যা, তা বিশ্লেষণ করার তেমন প্রয়োজন নেই, কারণ সচেতন যে কেউ তা অনুধাবন করতে পারবে।
অধুনা বিশ্বের নিত্যতা হচ্ছে, শক্তিধরদের চাপিয়ে দেওয়া কিছু যুদ্ধ-বিগ্রহে উৎপীড়িত ও নির্বাসিত মানুষের খাদ্যের দুর্দশা।
অপ্রীতিকর বটে তবুও এ পৃথিবীর মানুষ দু নয়নে দেখছে যে, কোথাও একটি জনপদের খাদ্য ও পানি আটকিয়ে দেওয়া হয়েছে। কেউ নির্দ্বিধায় খানি-পানি আটকানোকে অস্ত্রের জায়গায় ব্যবহার করছে আর কেউ নিষ্পেষিত হচ্ছে।
নাকাল এই পৃথিবীতে নিগৃহীত মানুষের খাদ্য-পানির নিরাপত্তা কে কবে দিতে পারবে—জানি না। তবে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন।
আরো প্রয়োজন এ বিষয়েও পৃথিবীর মানুষকে সজাগ করা যে—যাদের কাছে খাদ্য আছে, আছে পানি, তাঁরা যেন স্রষ্টার এ অনুগ্রহের অপচয় না করে।
আর যাদের কাছে স্রষ্টার এ নেয়ামতগুলো পর্যাপ্ত আছে তাঁরা যেন পরোপকারে তাঁদের দানের হাত সর্বদা উন্মুক্ত রাখে।
এবং পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলো যেন অন্য অযথা বিভিন্ন খাতে ব্যয় না করে সুষম খাদ্য বন্টন করে চলে এবং এক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণ হয়।
জাতিসংঘ, তেমন কিছু করতে না পারলেও, ১৯৭৯ সাল থেকে প্রতি ১৬ অক্টোবর, বিশ্ব খাদ্য দিবস সোৎসাহে পালন করে আসছে।
এবং এ উদযাপনের সময়ে একটি থিম, একটি প্রতিপাদ্য প্রতি বছর সামনে নিয়ে আসে। তাঁরা চায় পৃথিবীর মানুষকে প্রতিপাদ্য বিষয়ে সচেতন করতে। এবারের থিম দেওয়া হয়েছে “জলই জীবন,জলই খাদ্য”।
এবারের থিম খুবই প্রাসঙ্গিক এবং যথার্থ হয়েছে।
২.
‘নাসীহা ফাউন্ডেশন’ আমাদের পরিচালিত ক্ষুদ্র একটি সংগঠন। সংস্থাটি প্রথম থেকেই পরিবেশবাদী ভূমিকা পালন করে চলেছে।
বিগত ফেব্রুয়ারিতে (২০২৩) নাসীহা রজনী খ্যাত আমাদের কনফারেন্সে আমরা সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব তুলে ধরেছি যেমনটি আমরা করে থাকি প্রতিটি কনফারেন্সে। এবারের একটি অন্যতম প্রস্তাব ছিল—পানির সঠিক ব্যবহার।
বিশেষ করে আমরা মুসলিমরা যেন উদ্বু (উযু) ও গোসলের ক্ষেত্রে সুন্নাহ অনুযায়ী পানির যথাযথ ব্যবহারে অভ্যস্ত হই।
কারণ পৃথিবীতে পানির সঙ্কট আছে ও চলছে এবং বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুসারে আগামীতে এ সংকট আরো তীব্র হবে।তখন যেন মুসলিমদের ঘাড়ে কোন দোষ চাপানো না হয়, কারণ ইসলামের নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার সর্বোচ্চ তাগিদ দিলেও অপচয় আর অপব্যবহারের অনুমতি কখনো দেননি।
৩.
আমাদের কনফারেন্সগুলোতে ট্রেইনি বা ক্ষুদে বক্তাদের দ্বারা আমরা পরিবেশ এবং ধর্মীয় অবহেলিত বিষয় নিয়ে সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনা পেশ করিয়ে থাকি যা কনফারেন্সের অন্যতম unique আকর্ষণে পরিগণিত হওয়া ছাড়াও সংশ্লিষ্টদের মাঝেও প্রভূত সাড়া ফেলে চলেছে।
বিগত কনফারেন্সে এমনি একজন বক্তা পানি নিয়ে যা বলেছেন তা নিচে পেশ করছি :
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ
আমি ফারদিনুর রহমান রাইয়ান।
আমি পানির সঠিক ব্যবহার নিয়ে অল্প কথা বলবো।
আল-কুরআনের ২৪ নাম্বার সূরার ৪৫ নাম্বার আয়াতের প্রথমাংশে বলেছেন—
আল্লাহ প্রত্যেক জীবকে পানি থেকে সৃষ্টি করেছেন।
তাই বলা যেতে পারে—পানির অপর নাম জীবন।
কিন্তু, সব জিনিষের মত এই পানিরও সঠিক ব্যবহারের কথা ইসলাম জোর দিয়ে বলেছে।
বিশেষ করে সব জিনিষের মত পানির অপচয়ও ইসলাম খুব অপছন্দ করে।
এমনকি, যে পবিত্রতার জন্য আমাদের পানির দরকার সেখানেও অর্থাৎ উযু এবং গোসলের জন্যও পরিমিত ভাবে পানির ব্যবহার আমাদেরকে শিখানো হয়েছে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উযু এবং গোসলে কতটুকু পানি ব্যবহার করতেন তা নিয়ে সাহীহ বুখারীর ২০১ নাম্বার হাদীসটি আপনাদের শুনায়ে আমার বক্তব্য শেষ করবো।
আনাস রাদ্বি আল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক সা‘ (৪ মুদ) হতে পাঁচ মুদ পর্যন্ত পানি দিয়ে গোসল করতেন এবং উযু করতেন এক মুদ দিয়ে।
উল্লেখ্য, ১ মুদ হচ্ছে ৬০০ গ্রাম, আর চার মুদ তথা ১ সা‘ হচ্ছে প্রায় আড়াই কেজির মত।
শোকরিয়া সবাইকে।
শোকরিয়া নাসীহাকে।
৪.
ইসরাফ বা অপচয় উযুতেও হতে পারে।এবং আলেমগণ তাতে একমত, একজোট।
একটি নদীতে অপরিমিত পানি থাকা সত্ত্বেও, উযু করতে যেয়ে যদি কেউ তিনবার করে ধৌত করার জায়গাগুলো চারবার করে ধুতে থাকে, তাতে সে অপচয় করছে।
তাও অন্যায়, তাও গোনাহ।
সাহাবী, সাদ ইবন আবি ওয়াক্কাস রাদ্বি আল্লাহু আনহু উযু করছিলেন।
তাঁর পাশ কেটে যেতে যেতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেখলেন তিনি প্রয়োজনের অধিক পানি ব্যবহার করছেন।হয়ত তিনি ভাল উদ্দেশ্যেই অতিরিক্ত পানি খরচ করছিলেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন,
“মা হাযাস সারাফ” (” مَا هَذَا السَّرَفُ ”)।(সা’দ!) এই অপচয় কেন?
সা’দ রাদ্বি আল্লাহু আনহু বললেন, “আ’ ফিল উদ্বু’ই ইসরাফুন”(أَفِي الْوُضُوءِ إِسْرَافٌ)।উযূতেও কি অপচয় আছে?
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জবাব দিয়ে বললেন, “না’ম, ও ইন কুনতা আলা নাহরিন জারিন” (نَعَمْ وَإِنْ كُنْتَ عَلَى نَهَرٍ جَارٍ ” .) হ্যাঁ যদিও তুমি প্রবহমান নদীতে থাকো।
আবদুল্লাহ ইবনু আমর রাদ্বি আল্লাহু আনহু থেকে প্রচারিত উল্লিখিত হাদীসটি সুনান ইবনু মাজাহ এর ৪২৫ নাম্বার থেকে নেওয়া হয়েছে।
৫.
একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের শরীরে মোটামুটি ৬০% পানি থাকে।
পৃথিবীর ৪ ভাগের ৩ ভাগই মোটামুটি পানি।
এত পানি! কিন্তু পানির টানাটানিটা কোথায়? কোথায় সংকট?
আদপে সেই অভাব হচ্ছে — সুপেয় জলের।পরিষ্কার পানির।
আফ্রিকার একটি অঞ্চলে স্বচক্ষে দেখেছি পানির সেই হাহাকার।
লেখক: মুফতি।