বাংলা ছোটগল্পের জনক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনের ছোট ছোট ঘটনাকে অবলম্বন করে চমৎকার সব শিল্পনৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন। ছোটগল্পের ক্ষুদ্র পরিসরে কোনো একটি বিষয়কে ভাব-কল্পনার দ্বন্দ্বে আন্দোলিত করে বিশেষ কোনো দিক রূপায়িত করার ক্ষেত্রে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। রবীন্দ্রসৃষ্ট কলাকৃতি নিয়ে নতুন কিছু বলা কঠিন, কারণ এ বিষয়ে প্রচুর আলোকপাত করা হয়েছে। বর্তমান আলোচনায় এসব গুরুগম্ভীর কোনো বিষয় নেই। দীর্ঘ পাঠবিরতির পর যখন ‘গল্পগুচ্ছ’ পড়া হয় তখন পাঠকচিত্তে নতুনভাবে এক একটা দিক উন্মোচিত হয়। মনে হয় এ যেন নতুন আবিষ্কার! আসলে রবীন্দ্র সাহিত্য মাধুর্যতায় ভরা এক রহস্য-ভান্ডার। তাতে আছে নারী চরিত্রের অনুপম সব রহস্যময়তা। নারী-পুরুষ মিলে সংসার। সংসারে ঘটে যায় কত বিচিত্র ঘটনা। কোনো না কোনো ঘটনা বা চরিত্রের সাথে মিলে যায় রবীন্দ্র ছোটগল্পের কোনো কোনো দিক। তাঁর ছোটগল্পে পুরুষ চরিত্রের পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন ধরনের নারী চরিত্র। স্নেহময়ী নারী, নির্যাতিত নারী, নির্যাতনকারী নারী, প্রতিবাদী নারী, প্রগতিশীল নারী ইত্যাদি। আরও একধরনের নারী আছে যারা স্বভাবসুলভ আচরণে স্বপক্ষের শত্রুতায় পর্যবসিত হয়েছে। বর্তমান সমাজে নারীর অবস্থান পর্যবেক্ষণ করলেও দেখা যায় রবীন্দ্র সাহিত্যের নারীরা আশেপাশেই অবস্থান করছেন। কোথাও প্রকটরূপে কোথাওবা প্রচ্ছন্নরূপে। তাই রবীন্দ্র সাহিত্যে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি নারীর অবস্থান নিরীক্ষণ করার প্রয়োজনীয়তা অপ্রাসঙ্গিক নয়।
রবীন্দ্র সাহিত্যের নারীরা কেউ কেউ মুখ বুজে নির্যাতন সহ্য করেছে, কেউ নির্যাতনকারীকে সমর্থন করেছে, কেউ স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার পথ খুঁজে নিয়েছে। তার মধ্যে এমন নারী চরিত্রও রয়েছে যে― সে সময়ের তুলনায় অনেক প্রাগ্রসর। কিন্তু সবাই প্রাগ্রসর জীবনের এমন সুযোগ পায় না, অথবা সমাজ কর্তৃক তাদেরকে সে সুযোগ দেওয়া হয় না! নারীর জীবনযাত্রার অগ্রগতির নানা ক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিকতাকে বাধা হিসেবে দেখানো হয়; কিন্তু কোনো কোনো সময় দেখা যায় নারীই নারীর অগ্রগতির পথে বাধা। ‘দেনাপাওনা’, ‘খাতা’, ‘শাস্তি’, ‘মধ্যবর্তিনী’, ‘প্রতিহিংসা’, ‘স্ত্রীর পত্র’, ‘হৈমন্তী’ প্রভৃতি গল্পের ঘটনাংশ পর্যবেক্ষণে কী বার্তা পাওয়া যায় তা আলোচনা করে দেখা যেতে পারে।
বিয়ের পণ নিয়ে বিশেষ করে বরের মায়ের নিষ্ঠুরতার কাহিনি ‘দেনাপাওনা’। এই গল্পে রায়বাহাদুরের স্ত্রী তথা নিরূপমার শাশুড়িকে দেখা যায় একজন নির্যাতনকারী মহিলা ও নারী সমাজের চরম শত্রু হিসেবে। তিনি নিষ্ঠুর শাশুড়ি ও বাক্যে বিষময়ী নারী। নিরূপমার বাবা বেয়াই বাড়িতে নিজের ও মেয়ের অপমানের জ্বালা সইতে না পেরে ঋণগ্রস্ত হয়ে যৌতুকের টাকা নিয়ে যখন মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে উপস্থিত হলেন তখন নিরূপমাকে সামান্য একটু তেজে জ্বলে উঠতে ও প্রতিবাদ করতে দেখা যায়। কিন্তু তারপর থেকেই যেন নিরূপমার প্রতি শাশুড়ির আক্রোশ আরও বেড়ে যায়। তার বাক্যতীরে বিষ মাখিয়ে নিরূপমাকে লক্ষ্য করে ছুড়তে লাগলেন। নিরূপমা প্রতিকার করতে পারল না, শয্যা নিল এবং অকালে মারা গেল। নিরূপমার শাশুড়ি এমনি এক দজ্জাল ও নির্দয় শাশুড়ি ছিলেন যে তার ডেপুটি ম্যাজেস্ট্রেট পুত্র যখন বউকে কর্মস্থলে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাড়িতে চিঠি লিখল, তখনও মৃত পুত্রবধূর জন্য একটু অনুশোচনা করলেন না; বরং পুত্রকে লিখে পাঠালেন, ‘তোমার জন্য আরও একটি মেয়ের সম্বন্ধ করিয়াছি, অতএব অবিলম্বে ছুটি লইয়া এখানে আসিবে। এবারে বিশ হাজার টাকা পণ এবং হাতে হাতে আদায়।’ এই গল্পে নিরূপমার স্বামী নিরূপমার বন্ধু ছিল; কিন্তু শত্রু ছিল দজ্জাল শাশুড়ি যিনি একজন নারী।
‘খাতা’ গল্পে উমার সমবয়সী দুই ননদ উমাকে বিপদে ফেলেছিল। এই গল্পে দেখা যায় বালিকাবধূ উমার একান্ত ভাব প্রকাশের নিজস্ব সম্পদ একখানি খাতা সে বহু যতেœ লুকিয়ে রাখত এবং অবসর মুহূর্তে সে খাতায় তার মনের কথা লিখে রাখত। তার শ্বশুরবাড়ির মেয়েমহলে লেখাপড়ার চর্চা নাই। তারই সমবয়সী দুই ননদ তীলকমঞ্জুরী ও কনকমঞ্জুরী কৌতূহলবশত দ্বারের ছিদ্র দিয়ে দেখে উমা তার খাতায় লিখছে। এ খবরটা তাদের বড় ভাই প্যারীমোহনকে দেয়। প্যারীমোহন একদিন উমার কাছ থেকে খাতাটি কেড়ে নেয়। বালিকাবধূর নিজস্বতা বলতে আর কিছুই রইল না। উমা কোনো দিন সে খাতা ফিরে পায়নি। কিন্তু তার স্বামীরও একখানা খাতা ছিল, সেটা কেউ কেড়ে নেওয়ার সাহস করেনি। ছোট একটি বিষয়কে অবলম্বন করে লেখা এই গল্পেও রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন কীভাবে পুরুষরা নারীর স্বাধীনতা হরণ করে এবং তাদের স্বপ্নের জগতকে ভেঙে তছ্নছ্ করে দেয়। এই গল্পে সাংসারিক জটিলতা নেই কিন্তু উমার সমবয়সী দুই ননদ― এরা অপ্রাপ্তবয়স্ক হলেও ভূমিকা রেখেছিল প্রাপ্তবয়স্ক নারীর মতোই এবং তাদের দাদার ইচ্ছার সহযোগী হয়ে উমার স্বতঃস্ফূর্ত মনোজগতে বাধা সৃষ্টি করেছিল। এখানে তীলকমঞ্জরী ও কনকমঞ্জরীর আচরণ থেকে বলা যায়, নারী পুরুষের অধীন থাকতে থাকতে তাদের অবচেতন মনও পুরুষের প্রভুত্বকে বাহবা দেয় এবং এতে স্বপক্ষের ক্ষতি হলেও তা স্বাভাবিক মনে করে।
‘শাস্তি’ গল্পে চন্দরার বড় জা রাধার সাথে ঝগড়াঝাটি না করলে হয়ত খুনাখুনির ঘটনা ঘটত না।‘বউ গেলে বউ পাইব, কিন্তু আমার ভাই ফাঁসি গেলে আর তো ভাই পাইব না।’ বউর প্রতি এই মনোভাব যে স্বামীর তার ঘর করার চাইতে না করাই শ্রেয় মনে করেছে চন্দরা। এ কী নিদারুণ অভিমান! জেলখানায় ফাঁসির পূর্বে স্বামী তার সাথে দেখা করতে চায় শুনেও বলেছিল ‘মরণ―’। চন্দরার অভিমান হওয়া স্বাভাবিক। যে স্বামী নিজের ভাইকে বাঁচানোর জন্য নিজের স্ত্রীকে খুনের দায় স্বীকার করে নিতে অনুরোধ জানায় তার সাথে ঘরসংসার করার চাইতে ফাঁসিতে ঝুলে মরে যাওয়াই ভালো মনে করেছে চন্দরা। এক পুরুষ অন্য পুরুষকে বাঁচানোর জন্য নিজের স্ত্রীর উপর অপরাধ চাপিয়ে দিল। কিন্তু আদালত কি ন্যায় বিচার করল? স্বামীর কথা শুনে চন্দরা বজ্রাহত হয়েছিল; আদালতের বিচার দেখেও কি নারী সমাজ বজ্রাহত হয়েছিল? ‘শাস্তি’ গল্পের চন্দরা চরিত্রের মাধ্যমে নারীর প্রতি পুংদৃষ্টি ও আদালতের দেওয়া শাস্তির অসঙ্গতি তুলে ধরে রবীন্দ্রনাথ নিজেও তৃপ্ত হননি। বর্তমান সমাজও চন্দরাকে এবং তার দৃঢ়তাকে সম্মান করে কিন্তু চন্দরার মতো পুরুষের উপর অভিমান করে নারী নিজে শাস্তি ভোগ করুক এমনটা নিশ্চয়ই নারী সমাজ চায় না। সংসারের কুটিনাটি নিয়ে দুই জা চন্দরা ও রাধা ঝগড়াঝাটি করে স্বামীদের মাথা গরম করে না রাখলে রাধাও মরত না চন্দরাও ফাঁসি হতো না। এই গল্পে রবীন্দ্রনাথ গরিব ঘরে প্রবেশ করে অশিক্ষাজনিত পশ্চাদ্বর্তী নারীর ঝগড়াঝাটিকে উপলক্ষ করে একটি ঘটনা ঘটিয়েছেন মাত্র― মূলত তিনি পুরুষতান্ত্রিকতার কড়া সমালোচনা করেছেন। তরে ঝগড়াটে প্রবৃত্তির প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলতে চান যে, শুধু পুরুষের কারণেই নারীদের করুণ অবস্থা হয় না; বরং পিছিয়ে পড়ার জন্য নারী নিজেও অনেকটা দায়ী।
‘মধ্যবর্তিনী গল্পের শৈলবালাকে হরসুন্দরীর সুখ বিনাশক হিসেবে দেখা যায়। ‘মধ্যবর্তিনী’ গল্পটি তিনটি মাত্র চরিত্র নিয়ে রচিত। নিবারণ, হরসুন্দরী ও শৈলবালা। নিবারণ-হরসুন্দরীর ছোট সংসার অতি সাধারণভাবে চলছিল। গল্পকারের ভাষায়, ‘তাহাতে কাব্যরসের নামগন্ধ ছিল না।’ কোনো এক ফাল্গুন মাসে হরসুন্দরী অসুস্থ হয়ে পড়েন। স্বামী নিবারণ চক্রবর্তী চিকিৎসার কোনো ত্রুটি করেন নাই। ভালোবাসা, সেবা, শুশ্রƒষা দিয়ে স্ত্রীকে সুস্থ করে তুলেন। হরসুন্দরী স্বামীর প্রতি ভালোবাসার তীব্র আকর্ষণবোধ করেন এবং স্বামীর সংসারকে সুখে ভরিয়ে দেবার মানসে একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। গল্পকার বলছেন,
‘মনে যখন একটা প্রবল আনন্দ একটা বৃহৎ প্রেমের সঞ্চার হয় তখন মানুষ মনে করে, ‘আমি সব করতে পারি।’ তখন হঠাৎ একটা আত্মবিসর্জনের ইচ্ছা বলবর্তী হইয়া উঠে।’
সন্তানহীনা হরসুন্দরী পরিণতির কথা না ভেবে দ্বিতীয় বিয়ের জন্য স্বামীকে পীড়াপীড়ি করে। স্বামীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও কেবল সংসারে সন্তানসুখ দেওয়ার জন্য শৈলবালার সাথে বিয়ে দেয়। কিন্তু গল্পের এ পর্যায়ে এসে আমরা দেখি শৈলবালা স্বামীর মতিগতি চালচলনকে বদলে দিয়েছে। হরসুন্দরী সংসারকর্মে শৈলবালাকে দক্ষ করতে গেলে নিবারণ বলেছেন যে সে তাকে দিয়ে বড় বেশি পরিশ্রম করাচ্ছে। সেই অবধি হরসুন্দরী শৈলবালাকে দিয়ে কোনো কাজ করায় না। ফলে ‘সংসারের কাজ করা, পরের দিকে তাকানো যে জীবনের কর্তব্য এ শিক্ষাই তার হইল না।’ হরসুন্দরী সংসারে দাসীর মতো খাটতে লাগল আর শৈলবালা রাণীর মতো সকল রাজৈশ্বর্য ভোগ করতে লাগল। কিন্তু নিবারণের নব্য প্রেমানুভূতিতে শৈলবালার সমস্ত ঐশ্বর্য যোগাতে কীভাবে যে নিবারণ ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ল তা টের পেল না শৈলবালা। ঋণের দায় থেকে মুক্তির কোনো উপায় না দেখে নিবারণ হরসুন্দরীর সাহায্যপ্রার্থী হয়। কিন্তু ততক্ষণে হরসুন্দরী তার সমস্ত সোনা-গহনা শৈলবালাকে দান করে বসে আছে। নিরুপায় নিবারণ শেষপর্যন্ত শৈলবালার সাহায্যপ্রার্থী হয়। সংসারে শৈলবালা কেবল পেতেই শিখেছে দিতে শিখেনি। স্বামীর চরম বিপদেও তার গহনা সিন্দুকে বন্দী করে রেখেছে। নিবারণ যতই কাতরভাবে সাহায্য চায় শৈলবালা স্বার্থপরের মতো বলে ‘সে আমি জানি না। আমার জিনিস আমি কেন দিব।’ ঐ দুর্বল ক্ষুদ্র সুন্দর সুকুমারী বালিকাবধূর হৃদয় লোহার সিন্দুকের চাইতেও কঠিন অনুভব করে নিবারণ। হরসুন্দরী স্বামীর সংকটে সাহায্যের জন্য জোর করে শৈলবালার কাছ থেকে চাবি কেড়ে নিতে চাইলে শৈলবালা চাবি পুকুরে ফেলে দেয়। হরসুন্দরী তালা ভাঙ্গার কথা বললে শৈলবালা আত্মহত্মার হুমকি দেয়। শেষপর্যন্ত নিবারণ বাড়ি বিক্রি করে ঋণমুক্ত হয়।
এখানে শৈলবালার চরিত্রটি লক্ষ্য করার বিষয়। একতরফা পেতে পেতে শৈলবালা হয়েছে স্বার্থপর। স্বামীর বিপদেও সাহায্য করেনি। তার জন্যই যে সংসার ডুবতে বসেছে এটাও সে অনুধাবন করতে চায়নি। যে সন্তানসুখের জন্য এ বাড়িতে তার আগমন তাও পূরণ করতে পারেনি। সংসারের সমস্ত সোহাগ আদর পেয়েও তার নারী জীবন ব্যর্থ হলো। আদর-যতœ-সোনা-গহনা কিছুই তার সঙ্গী হলো না― এক চরম ব্যর্থতায় পৃথিবী থেকে অকালে বিদায় নিল। হরসুন্দরীর জীবনের এক সুখের মুহূর্তে আবেগ তাড়িত হয়ে এই মধ্যবর্তিনীকে এনেছিল এবং মধ্যবর্তিনী তার কালশত্রু হয়ে সংসার জীবনকে তছ্নছ্ করে দিয়ে গেল। এখানেও দেখি নারীর শত্রু নারী।
‘প্রতিহিংসা’ গল্পে ইন্দ্রাণীর শত্রু নয়নতারা। কেননা, এই গল্পে নয়নতারাকে ইন্দ্রাণীর প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখা যায়। নয়নতারার হিংসুটে মনোভাব, স্ত্রীজনসুলভ নিষ্ঠুর অপমানশরের লক্ষ্যস্থল ছিল কুলবতী ও রূপবতী ইন্দ্রাণী। নয়নতারা জমিদারপতœী এবং ইন্দ্রাণীর স্বামী নয়নতারার জমিদারির ম্যানেজার হিসেবে বেতনভুক্ত কর্মচারী। কাজেই মনিবপতœী হিসেবে নয়নতারা তার ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে। সে ইন্দ্রাণীর প্রতি প্রতিশোধ নেওয়ার মানসে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। একসময় সে নিজেই ইন্দ্রাণীর স্বামীকে ডেকে নিয়ে বলে, ‘তোমাকে আর রাখা হবে না, তুমি বামাচরণকে সমস্ত হিসাব বুঝিয়ে দিয়ে চলে যাও।’ শেষপর্যন্ত জমিদারি যখন অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে তখন এই ইন্দ্রাণী ও তার স্বামী অম্বিকাচরণই তা রক্ষা করেছে। ইন্দ্রাণীর প্রতি নয়নতারার আচরণ নারীর প্রতি নারীর শত্রুতাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।
‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পে মৃণালের বড় জা এবং বিন্দুর শাশুড়ি বিন্দুর জীবনের করুণ পরিণতির জন্য দায়ী। এখানে দেখি নারী জীবনের বঞ্চনা। এই বঞ্চনাটা একতরফা যে পুরুষদের কাছ থেকে এসেছে তাও নয়; বরং নারীর কাছ থেকেই এসেছে। রবীন্দ্রনাথ স্পষ্টভাবে বলেই দিয়েছেন ‘মেয়ে মানুষ মেয়ে মানুষকে দয়া করে না।’ মৃণালের বড় জা এবং বিন্দুর শাশুড়ির মাধ্যমে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। বিন্দুর মতো মেয়েরা সমাজে সকল সময়েই অসহায় এবং তাদেরকে সহযোগিতা করার জন্য মৃণালরা বেশি নেই। কিন্তু খুঁতখুঁত খিটখিট করার মানুষের অন্ত নেই।
‘হৈমন্তী’ গল্পে হৈমন্তীকে মানসিকভাবে নিপীড়ন করার ক্ষেত্রে দৃশ্যমান চরিত্রগুলো ছিল নারী। কেবল হৈমন্তীকে লজ্জা দেবার জন্যই মহিলাম-লের মুখ দিয়ে বেরিয়েছিল ‘ওমা, এ কী কা-! এ কোন নাস্তিকের ঘরের মেয়ে। এবার এ সংসার হইতে লক্ষ্মী ছাড়িল, আর দেরি নাই।’ এরকম মন্তব্য করার পর সংসারে লক্ষ্মী থাকার কথা থাকলেও আর থাকতে পারবেন না। কারণ, এসব মন্তব্য মনের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
উল্লিখিত প্রতিটি নারী চরিত্র গল্পগুলোতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে কিন্তু বাস্তবতায় এমন নারী চরিত্রই নারীর অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। গল্পের প্রয়োজনেই নারীদের পারস্পরিক ঝগড়ার বিষয়টি এসেছে। এই নারীঝগড়ার প্রতি রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠস্বরে কিন্তু কোনো কটাক্ষ নেই; বরং সমাজের নারীর পশ্চাদ্বর্তিতা লক্ষ্য করে ১৯৩৬ সালে নিখিলবঙ্গ মহিলা কর্মীদের সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে তিনি বলেছিলেন যে আত্মরক্ষা ও আত্মসম্মানের জন্য মেয়েদের বিদ্যাবুদ্ধির চর্চা জরুরি এবং তার মধ্য দিয়েই গৃহবন্দিত্ব ঘুচবে এবং রক্ষণশীল মনের অস্বাস্থ্যকর আবর্জনা সরিয়ে দিয়ে তাদের বুদ্ধির উজ্জ্বল দীপ্তি প্রকাশিত হবে। কিন্তু গরজটা জাগাতে হবে মেয়েদের নিজেদের ভিতর থেকে। তাই তিনি গল্প বলতে বলতে পরিবার ও সমাজের অন্যায্যতার প্রতি পাঠকের দৃষ্টিকে আবদ্ধ করেন। পাঠকের মনে সুখ-দুঃখের অনুভূতি জাগিয়ে তিনি প্রচলিত সমাজ ভাবনা থেকে অর্থাৎ বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে উন্নততর পরিস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করেন। সর্বোপরি ঝগড়া বিমুক্ত নারী সমাজ গঠনের মানসভূমি প্রস্তুতির জন্য রবীন্দ্রনাথ তার বিভিন্ন নারী চরিত্রকে (সেটা প্রধানই হউক বা অপ্রধানই হউক) হিংসুটে-ঝগড়াটে-নিষ্ঠুর প্রভৃতি নানারকম বৈশিষ্ট্য আরোপ করে সাহিত্যের রস সৃষ্টি করেছেন। এটাকে নিছক রস সৃষ্টির উপাদান মনে না করে যদি একটু ভিন্ন ভাবে চিন্তা করা যায়, তাহলে দেখা যাবে যে, অত্যন্ত গোপনে, আভাসে, ইঙ্গিতে ব্যক্তি স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, নারীস্বাধীনতা বা নারীমুক্তির দিকনির্দেশনা রবীন্দ্র ছোটগল্পেই লুকিয়ে রয়েছে।
লেখক: প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, কমলগঞ্জ সরকারি গণমহাবিদ্যালয়, কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার।