সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সংকলনে: আনিসুল আলম নাহিদ

হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতির জনক স্যামুয়েল হ্যানিম্যান আজও প্রাসঙ্গিক



স্যামুয়েল হ্যানিম্যান। ছবি: ইন্টারনেট

দু’শো বছর আগেকার কথা। গোথার এক জন শিক্ষিত দর্জি নিজের দুর্বল স্বাস্থ্যের ব্যাপারে হ্যানিম্যানের সাহায্য চেয়েছিলেন। হ্যানিম্যান তাঁকে চিঠিতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। সেই পরামর্শ দু’টো কারণে উল্লেখযোগ্য – (১) পরামর্শ নিয়েছিলেন যিনি, তিনি দুর্বল শরীর নিয়েও অনেক দিন বেঁচে ছিলেন (২) হ্যানিম্যানের সেই পরামর্শ আজও সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক। সেই চিঠির বিষয়বস্তু এখানে তুলে ধরা হল-
মানবশরীর (কোমল মানব যন্ত্র) অধিক শ্রমের উপযোগী নয়। যদি মানুষ উচ্চাকাঙ্খা বা কোনও কিছু লাভের আশায় প্রশংসনীয় বা নিন্দনীয় কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে কিছু করে তবে তা প্রকৃতি বিরুদ্ধ কাজ হবে। ফলস্বরূপ তার শরীর আঘাতপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যদি শরীর প্রথম থেকেই দুর্বল হয় তা হলে এক সপ্তাহের কাজ দু’সপ্তাহে করা যেতে পারে। আপনার গ্রাহকেরা অপেক্ষা করতে অনিচ্ছুক হতে পারেন। কিন্তু তারা এই আশা করবেন না যে আপনি তাঁদের কাজের চাপে নিজেকে অসুস্থ করে ফেলবেন এবং আপনার স্ত্রীকে বিধবা করে, সন্তানদের অনাথ করে কবরে শায়িত হবেন। প্রচুর শারীরিক শ্রমের থেকেও ক্রমাগত মানসিক চাপ আপনার বেশি ক্ষতিকর। আপনার ক্লান্ত মনই আপনার শরীরের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকারক। আপনি যদি শান্ত এবং কিছুটা উদাসীন থাকেন, যদি প্রথমে নিজের জন্য, পরে অন্যের জন্য বাঁচার পন্থা অবলম্বন করেন, তবে আপনার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা প্রবল। মানুষ সর্বদাই নিজের প্রয়োজন মতো বস্ত্র পরিধান করবে, সেটা তার রুচিসম্মত না হলেও।

দার্শনিকের মানসিকতা নিলে আপনি সুস্থ শরীরে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত বাঁচতে পারবেন। যদি কোনও কিছু আপনাকে অসস্তুষ্ট করে তোলে, তবে সেটাকে অবজ্ঞা করবেন। যদি কোনও কিছু আপনার সাধ্যাতীত হয়, তবে তা করা থেকে বিরত থাকুন। যদি অন্যরা আপনাকে চালনা করতে চায়, তবে ধীরে চলুন এবং যে সব মুর্খরা আপনাকে চিন্তান্বিত দেখতে চেয়েছিল, তাদের দেখে হাসুন। যা আপনি অনায়াসে করতে পারেন সেটাই করুন। যা আপনি করতে পারবেন না সেটা নিয়ে নিজেকে পীড়িত করবেন না। কারণ আমরা আমাদের অধিক শ্রম দিয়েও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির পরিবর্তন করতে পারি না। নিজের পরিবারকে বেশি সময় দিন। এইভাবে অর্থনৈতিক স্থিরতা, সীমাবদ্ধ প্রয়োজনীয়তা আমাদের অধিক আরাম, অধিক বুদ্ধিমত্তা, যুক্তিবাদিতা এবং অধিক আনন্দ ও শান্তি দিয়ে স্বাস্থ্যকরভাবে প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাঁচতে সাহায্য করে। তাই আমাদের আরও বিচার-বিবেচনা করে বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নিয়ে কাজ করা উচিত, যাতে এই শ্বাসরোধকারী ব্যস্ততা, স্নায়ুর চাপ, আমাদের জীবনের দুটি সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ – শান্তিপূর্ণ মন ও সুস্থ শরীরকে নষ্ট না করে দিতে পারে। আরও বিবেচক হন। নিজেকে ছাড়া অন্য কিছুকে অধিক গুরুত্ব দেবেন না। যদি কোনও কিছু আপনার মানসিক ও শারীরিক শক্তির ঊর্ধ্বে গিয়ে কাজ করাতে বাধ্য করে, তা হলেও নিজের হিতের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনও কিছু করবেন না। প্রশংসার প্ররোচনাতে কান দেবেন না। জ্ঞানী ও বিবেচক মানুষের মতো শাস্ত ও ধীরস্থিরভাবে নীরবে নিজের কাজ করে যান। মানুষ পৃথিবীতে এসেছে শান্ত মনে এবং সুস্থ শরীরে জীবনকে উপভোগ করতে এবং ততটাই কাজ করতে, যতটা তার উপভোগ্য বস্তুকে লাভ করার জন্য প্রয়োজন। নিজেকে কাজের চাপে শ্রান্ত, জীর্ণ করে তোলা তার উদ্দেশ্য নয়।

দুরদৃষ্টিহীন মানুষের চিরন্তন চেষ্টা হল আরও এবং আরও বেশি লাভ করার জন্য, আরও সম্মান পাওয়ার জন্য নিজের হিত না বুঝে কঠোর পরিশ্রম ও চেষ্টা করে যাওয়া। অনেক যুবক-যুবতীর অকালবার্ধক্য ও অকালমৃত্যুর কারণ এটাই। শান্ত, শীতল মস্তিষ্কের ব্যক্তি তিনিই, যিনি সব কিছুকেই সহজভাবে নেন। তিনি কিন্তু ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছান এবং শান্তিপূর্ণ ও সুস্থ জীবন যাপন করেন। এই আপাতদৃষ্টিতে অলস ব্যক্তিই কিন্তু সময় বিশেষে তাঁর মৌলিক ভাবনার ফলশ্রুতি হিসেবে এমন কিছু চিন্তাভাবনা জনসমক্ষে আনেন যা তাঁর পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিকে পরিবর্তন করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়। এ রকম চিন্তাভাবনাকে একত্রীকরণের সময় কিন্তু কর্মক্লান্ত মানুষের থাকে না।

জীবনের দৌড়ে জিততে হলে গতিই যথেষ্ট নয়। চেষ্টা করুন সামান্য উদাসীন, শান্ত ও শীতল থাকতে। তা হলেই আমি যেমন বলতে চাই আপনি সে রকমই হয়ে উঠবেন। আপনি বিস্মিত হয়ে দেখবেন যে আমার পরামর্শ মেনে আপনি কত সুস্থ হয়ে উঠেছেন। তখন আপনার রক্ত আপনার শরীরের ধমনীর মধ্য দিয়ে কোনও বিশেষ প্রচেষ্টা ছাড়াই শান্ত ভাবে বয়ে যাবে। যাঁরা শীতল স্নায়ুর মানুষ, তাঁরা কখনও ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখেন না। যিনি সর্বদা চিন্তামুক্ত থাকেন, তিনি কোনও রকম পেশাগত দুশ্চিন্তা ছাড়াই সকালে ওঠেন। জীবনে সুখের চেয়ে কোনও কিছুই তাঁর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। নতুন উৎসাহের সঙ্গে তিনি নিয়ন্ত্রিত কর্মসূচির দিকে এগিয়ে যান। কোনও কাজকেই তিনি অযথা পরিশ্রমসাধ্য করে গড়ে তোলেন না। আবেগ, উচ্ছ্বাসের আধিক্য, আয়াসসাধ্য কর্ম, মানসিক উৎকণ্ঠা, অস্বস্তি কখনওই তাঁকে জীবনের যা কিছু উপভোগ্য তার থেকে বঞ্চিত করে না। এভাবেই শান্তিতে দিনের পর দিন কেটে যায়। তারপর একদিন বার্ধক্য এসে তাঁর জীবনের সমাপ্তি ঘোষণা করে। যেভাবে সেই ব্যক্তি ইহজগতে তাঁর দিনগুলি কাটিয়ে গিয়েছেন অন্য জগতেও তাঁর জীবন পরিপূর্ণ শাস্তিতে সেভাবেই বিরাজ করতে থাকে।

এটাই কি যুক্তিযুক্ত বা সুবিবেচিত পন্থা নয়? অস্থিরমতি মানুষকে এভাবেই অবিবেচকের মতো কাজ করতে, নিজেদের ক্ষতি নিজেরাই করতে দিন। ওরা মুর্খের মতো আচরণ করলেও আপনি জ্ঞানী ব্যক্তির মতো আচরণ করুন। আমার এই শিক্ষাকে নিজের জীবনে বিফল হতে দেবেন না ।

বিদায়। আমার পরামর্শ শুনে চলবেন এবং সব কিছু সঠিকমতো চললে মনে রাখবেন আমাকে।
পুনশ্চ : আপনি যদি আপনার সঞ্চয়ের শেষ সীমাতেও পৌঁছে থাকেন, তা হলেও আনন্দ থাকুন। ঈশ্বর সব কিছু দেখছেন এবং ভাগ্যক্রমে পাওয়া একটা সুযোগই আপনার জীবনে আবার সবকিছু ঠিক করে দেবে। বেঁচে থাকতে, খাদ্য-পানীয় গ্রহণ করে শক্তি সঞ্চয় করতে, নিজেদেরকে উষ্ণতা ও শীতলতার থেকে রক্ষা করতে আমাদের কতটাই বা প্রয়োজন হয় ? শুধু দরকার একটু সাহসের। যদি সেটা থাকে, তা হলেই আমরা জীবনের বাকি সব প্রয়োজন মেটানোর সামর্থ রাখব। একজন জ্ঞানীর জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস খুব অল্প হয়। ভিতরের শক্তিকে জাগিয়ে তোলার জন্য অন্য কোনও চিকিৎসার দরকার পড়ে না।

 আনোয়ারা হোমিও হল গ্রন্থাগার ও আর্কাইভে সংরক্ষিত ডাঃ দিলীপ ভট্টাচার্যের নতুন আলোয় হোমিওপ্যাথি বই থেকে সংকলিত
সংকলক: আনিসুল আলম নাহিদ (হোমিওপ্যাথি ও কৃষি বিষয়ক গবেষক), আনোয়ারা হোমিও হল, দেওয়ান বাজার, ডাক: গহরপুর-৩১২৮, সিলেট।

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!