১.
আবুইয়া! কিছুক্ষণ তোমার চোখ দুটো বন্ধ রাখো।
নিউ ইয়র্ক ফিরত জিবরান আমাকে এই বলে অনুরোধ করল।
আমি জিবসকে জিজ্ঞেস করলাম কেন বাবা? কি সারপ্রাইজ দিতে চাও?
আমি আঁখি যুগল রুদ্ধ করে প্রতীক্ষা করতে থাকলাম।
জিবস তাঁর রাকসাক (Rucksack) হাতড়িয়ে কিছু বের করল। অতঃপর সে হাঁটু-ভাঁজ আধো দাঁড়িয়ে বলল;
এবার তাকাও, আবুইয়া!
আমি নয়ন খুলে দেখি—তাঁর দু হাতে দুটি ফ্ল্যাগ। ছোট মিনি অফিস ডেস্ক পতাকা।
বাংলাদেশের অবচূড়। লাল-সবুজ ঝান্ডা। হরিৎ-লোহিত নিশান। সম্ভবত ১৪x২১সেমি. হবে কেতনগুলি। নাইলন প্লাস্টিকের কালো ধারক (holder) সহ।
আমি মাশা-আল্লাহ বলে তাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, জাযাকাল্লাহু খাইরা বাবা, এ চমৎকার souvenir সূভানিআ(র্) গিফট নিয়ে আসার জন্য।
সে বলল, আমি জানি তুমি এটি পছন্দ করবে তাই আমেরিকান সূভানিআ(র্) এর পরিবর্তে এই memento (স্মারকচিহ্ন) এনেছি।
এবার আমি সবিস্ময়ে তাকে প্রশ্ন করলাম, আমেরিকায় তুমি এগুলি পেলে কোথায়?
সে বলল, “আমরা নিউ ইয়র্ক জাতিসংঘ সদর দপ্তর দেখতে গিয়েছিলাম, সেখানে এ ফ্ল্যাগগুলো দেখামাত্রই আমি তোমার জন্য কিনে নিয়েছি।”
জিবরান আরো যোগ করে বলল, “আমার ইংলিশ বন্ধুরা এই প্রথম বাংলাদেশী পতাকা ছুঁয়ে দেখে এটির নান্দনিকতার প্রশংসা করেছে।”
দুই হাজার সতেরো সালের ফেব্রুয়ারির নয় তারিখের বরফ-ঢাকা রাতে, জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে, জিবরানদের বহনকারী আমেরিকান এয়ারলাইন্সটি বিরূপ আবহাওয়ার কারণে ল্যান্ডিং-এ ঘন্টাখানেক দেরি করে। এর আগে বিমানটি আকাশে চক্কর কাটতে থাকে। অবতরণের পরও অনেকক্ষণ অবধি প্লেনে তাঁদেরকে বসে থাকতে হয়েছে। ভারী তুষারপাতের জন্য নিরাপদ সময়ের অপেক্ষায় করছিল তাঁরা। ঐ রাতে ঐ ফ্লাইটের আগের এবং পরের ফ্লাইটগুলো বিপদজনক বিবেচনায় বাতিল করা হয়েছিল। পাঁচ দিনের geography school trip এ জিবরান তাঁর কিছু শিক্ষক এবং সহপাঠীদের সাথে গিয়েছিল সেখানে। আর এটি ছিল তার প্রথম পরিবার ছাড়া দেশান্তর বা যাত্রা।
তার এই স্মরণীয় ভ্রমণের একটি স্মর্তব্য অংশে রেকর্ড হয়ে থাকল তাঁর আনীত বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিক। বাংলাদেশের ধ্বজা সবুজ জমিতে লাল সূর্যোদয়।
লাল-সবুজের এই পতাকা একটি প্রতিক, এক পরিচয়। এক বিশাল পরিচয়।
লাল-সবুজের এই ধ্বজা এমন এক জাতির প্রতীকী প্রতিক। যে জাতি এক মহান বিজয় রচিত করেছিল উনিশ শ’ একাত্তরের ষোল ডিসেম্বর।
২.
এই কাহিনীর কিছু দিন পর জিবরান বলল, আবুইয়া! স্কুলে আমার একটি প্রেজেন্টেশন আছে। এশিয়ার একটি দেশ নিয়ে ব্রিফ আলোচনা করতে হবে। বাংলাদেশকে বেছে নেওয়া যায় তবে টপিক হিসেবে আমার কাছে বাংলাদেশ তেমন আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে না। বিষয়ের জন্য এমন একটি দেশ হলে ভাল হয় যে দেশের আছে সমৃদ্ধ ঐতিহ্য।
তারপর সে জিজ্ঞেস করে—তোমার ধারণায় কোন দেশটি ভাল হবে,আবুইয়া!
আমি বললাম, এটি তোমার অভিরুচি। যে দেশ তুমি আকর্ষণীয় মনে কর তাই বাছাই কর।
কিছুক্ষণ পর মৌনতা ভেঙে আমি বললাম, আমাদের ইংল্যান্ডের কোন স্বাধীনতা দিবস নেই। আবার ইংল্যান্ডের নিজস্ব কোন বিজয় দিবসও নেই।
কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস যেমন আছে তেমনি বিজয় দিবসও আছে। আর এ সবের পিছনে যেমনি আছে আনন্দ-বেদনার অজস্র গল্প তেমনি আছে এক মহাসাগর ঘাম ঝরা আর এক সাগর রক্ত ঝরার কাহিনী। তাই তুমি বাংলাদেশ নিয়ে আরো সার্চ কর। আরো কিছু পড়াশোনা কর। তারপর সিদ্ধান্ত নাও।
পরদিন সে জানাল আমি সেই দেশ নিয়ে কথা বলব, ইতিহাস আর ঐতিহ্যের পাশাপাশি যে দেশে আছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, আরো আছে পৃথিবীর দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সমুদ্র সৈকত এবং সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ বন।
আমি আরো যোগ করে বলে উঠলাম, আর যে দেশের আছে লাল-সবুজ পতাকা। যেমন তুমি নিউ ইয়র্ক থেকে সূভানিআ(র্) হিসেবে নিয়ে এসেছো।
৩.
আমার ছেলেদের এবং তাঁদের উম্মির (মা) জন্মভূমি যদিও বাংলাদেশ নয় কিন্তু তবুও তাঁদের লাল হৃদয়ের কোথাও যেন লুকিয়ে আছে একেক টুকরো করে সবুজ বাংলাদেশ। ৫৬ হাজার বর্গমাইল আয়তনের বাইরে গ্লোউব্ (globe) জুড়ে আছে এমনি অগণন মানব বাংলাদেশ।
(অসমাপ্ত)