তাঁর ছিল প্রশস্ত বুক আর পেশীবহুল শরীর। (সহীহ বুখারী ৩৪৩৮)। এবং উচ্চতা ছিল তাঁর মাঝারি। (বুখারী ৩৩৯৪ ও আবু দাউদ ৪৩২৪)। গায়ের রং ছিল তাঁর লালচে ফর্সা। (বুখারী ৩৩৯৪ ও আবু দাউদ ৪৩২৪)। তবে ঠিক তেমন লালচে ফর্সা ছিল না বরং মনকাড়া বাদামী (মিশ্রিত) ছিল। (বুখারী ৩৪৪১ ও ৩৪৪০)। কাঁধ অবধি চুল যখন তাঁর ঝুলত তখন চুলগুলো সোজা মনে হত। (বুখারী ৩৪৪১ ও ৩৪৪০)। তাঁর চুল (আদপে) কোঁকড়ানো ছিল। (সহীহ বুখারী ৩৪৩৮)। তাঁর মাথার চুল ভিজা নয় তবুও (মোহনীয়তা এমন যে দেখলে) মনে হবে চুল থেকে যেন বিন্দু বিন্দু পানি টপকাচ্ছে। (আবু দাউদ ৪৩২৪)।
ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের বংশধরদের মধ্যে তাঁর সঙ্গে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেহারার মিল সবচেয়ে বেশি। (বুখারী ৩৩৯৪)। তিনি হলেন ঈসা আলাইহিস সালাম। কুরআন আর মুসলিমদের কাছে তিনি ঈসা। খৃষ্টানদের কাছে তাঁর নাম জীযেয। যেমন কুরআন খৃষ্টান নামের পরিবর্তে নাসারা বলে।
বিশ্বে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী লোক সবচেয়ে বেশি। তাঁদের কাছে তিনি মানবজাতির ত্রাণকর্তা। এ সময়ে তাঁর অনুসারীর সংখ্যা প্রায় ২৪০ কোটি। তাঁর কাছে অবতীর্ণ ইনজিল কিতাব, অধুনা যা বাইবেল খ্রিস্টানদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ। এটি পৃথিবীর সব চেয়ে বেশি বিক্রিত গ্রন্থ।
ফিলিস্তিনের একটি শহর বেথেলহেম (Bethlehem), আরবি بيت لحم, বাইত লাহাম। পুরনো জেরুসালেম থেকে ১০ কি.মি তথা ৬ মাইল দক্ষিণে, পশ্চিম তীরের এ ছোট শহরে জন্ম ঈসা আলাইহিস সালামের।
২.
কুরআনের ৬১ নাম্বার সূরা হলো—আছ-ছাফ।সূরাটির ৬ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে :
وَإِذْ قَالَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ يَا بَنِي إِسْرَائِيلَ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُم مُّصَدِّقًا لِّمَا بَيْنَ يَدَيَّ مِنَ التَّوْرَاةِ وَمُبَشِّرًا بِرَسُولٍ يَأْتِي مِن بَعْدِي اسْمُهُ أَحْمَدُ فَلَمَّا جَاءَهُم بِالْبَيِّنَاتِ قَالُوا هَٰذَا سِحْرٌ مُّبِينٌ
“(স্মরণ কর,) যখন মারইয়ামের ছেলে ‘ঈসা বলেছিলেন, ‘হে বানী ইসরাঈল! আমি তোমাদের আল্লাহর রাসূল, আমার পূর্বের তাওরাত কিতাবের আমি সত্যায়নকারী এবং আমি, আমার পরে আসন্ন একজন রাসূলের সুসংবাদদাতা, যার নাম আহমাদ।’ অতঃপর সেই (আহমাদ) রাসূল যখন তাদের কাছে সুস্পষ্ট নিদর্শন নিয়ে আসলেন, তখন তারা বলল, এটা তো সুস্পষ্ট যাদু।
উল্লিখিত আয়াতের ‘আহমাদ’ নামটি, আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামেরই আরেকটি নাম। যা কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
আহমাদ মানে যিনি বেশি প্রশংসিত।আবার অন্য অর্থে আহমাদ মানে যিনি বেশি প্রশংসাকারী।
উপরের আয়াত বলছে;
ক.
ঈসা আলাইহিস সালাম একজন রাসূল ছিলেন।
খ.
তিনি বানী ইসরাঈলের শেষ রাসূল।
গ.
শেষ রাসূলের মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাবের পূর্বে যে রাসূলের আগমন পৃথিবীতে হয়েছিল তিনি ঈসা আলাইহিস সালাম ছাড়া আর কেউ নন।
৩.
ঈসা আলাইহিস সালাম হলেন সেইসব নাবীদের একজন যাদের নাম ও কথা মহান আল্লাহ কুরআনে বহুবার আলোচনা করেছেন। আর এ উল্লেখ করার কারণ হলো, বিশ্বাসীরা যেন তাঁর গল্প ও কাহিনী থেকে অনেক কিছু শিখতে পারে। আর বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়া অপ মতবাদের বিপরীতে প্রকৃত বিষয় অনুধাবন করা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা, কুরআনে ২৫ বার তাঁর কথা উল্লেখ করেছেন।
সূরা মারইয়াম কুরআনের উনিশ নাম্বার সূরা। এ সূরা কুরআনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি অধ্যায়। কুরআনের এই অধ্যায়ের নামকরণ করা হয়েছে ঈসা আলাইহিস সালামের মায়ের নামে।
মারইয়াম আলাইহাস সালাম ছিলেন ঈসা আলাইহিস সালামের মা। তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে আশীর্বাদপুষ্ট নারীদের একজন। মহীয়সী এই মহিলা ছিলেন স্রষ্টার জন্য নিবেদিতপ্রাণ।
৪.
ঈসা আলাইহিস সালাম আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাসূলদের একজন। ইসলামে তিনি পরম সম্মানিত। কুরআন তাঁকে “সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি নিদর্শন” হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
আল-আম্বিয়া হলো কুরআনের ২১ নাম্বার সূরা। এ সূরার ৯১ নাম্বার আয়াত বলছে :
وَ الَّتِیۡۤ اَحۡصَنَتۡ فَرۡجَهَا فَنَفَخۡنَا فِیۡهَا مِنۡ رُّوۡحِنَا وَ جَعَلۡنٰهَا وَ ابۡنَهَاۤ اٰیَۃً لِّلۡعٰلَمِیۡنَ
“(আর স্মরণ কর) সেই নারীকে যে তাঁর সতীত্ব সুরক্ষা করেছিল এবং আমি তাঁর মাঝে আত্মা ফুঁকে দিয়েছিলাম এবং তাঁকে ও তাঁর ছেলেকে করেছিলাম বিশ্ববাসীর জন্য (অনন্য) নিদর্শন।”
ঈসা আলাইহিস সালামের কোন পিতা নেই।এ জন্য কুরআন তাঁকে সাধারণত ঈসা ইবন মারইয়াম অর্থাৎ মা মারইয়ামের সন্তান হিসেবে সম্বোধন করে থাকে।
আদাম আলাইহিস সালাম অনন্য নিদর্শন কারণ তাঁর নেই বাবা ও মা।
হাউয়া (حَوَّاء) আলাইহাস সালাম আরেক নিদর্শন কারণ তাঁরও নেই বাবা ও মা তবে একজন পুরুষের পাঁজরের হাড় থেকে তাঁকে সৃষ্টি করা হয়েছিল।
এ কারণে কুরআনের তৃতীয় সূরা, আলি ইমরানের ৫৯ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে :
اِنَّ مَثَلَ عِیۡسٰی عِنۡدَ اللّٰهِ کَمَثَلِ اٰدَمَ ؕ خَلَقَهٗ مِنۡ تُرَابٍ ثُمَّ قَالَ لَهٗ کُنۡ فَیَکُوۡنُ
নিঃসন্দেহে, আল্লাহর কাছে “ঈসার উদাহরণ আদামের অনুরূপ, তিনি আদাম বানালেন মাটি দিয়ে, তারপর (মাটিকে) বললেন (জ্যান্ত) হও,অতঃপর তাতেই (সে) হয়ে গেল।”
৫.
খ্রিস্টানদের সাধারণ ধর্মমত অনুসারে ঈসা হলেন ঈশ্বরের পুত্র। সাধারণ খ্রিস্টানদের বিশ্বাস ত্রিত্ববাদে। খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্বে ত্রিত্ববাদের দ্বিতীয় চরিত্র হলো পুত্র ঈশ্বর। যেখানে ঈসাকে দেখা হয় ঈশ্বরের অবতার হিসেবে।ত্রিত্ব মতবাদে পিতা ঈশ্বর হলেন প্রথম এবং (একটি) পবিত্র আত্মা হলো ঈশ্বরের তৃতীয় ব্যক্তি।তাঁরা সত্ত্বাগতভাবে স্বতন্ত্র হলেও নাকি সারবস্তুতে একতাবদ্ধ (সমসংহত)।
এর বিপরীতে ইসলাম বিশ্বাস করে ঈসা আলাইহিস সালাম একজন মহান নাবী ও রাসূল ছিলেন যিনি জাতিকে একত্ববাদ এবং আল্লাহর আনুগত্যের সরল পথে পরিচালিত করার জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন।
ইসলামে আল্লাহ এবং ঈসার মধ্যে পরিষ্কার পার্থক্য করা হয়েছে।একজন স্রষ্টা আরেকজন সৃষ্টি। একজন ইলাহ আরেকজন বান্দা।
একত্ববাদে ইসলামে সংমিশ্রণ ও শরিক কিছুই নেই।
এক আল্লাহই অস্তিত্বের সবকিছুর স্রষ্টা এবং একচ্ছত্র প্রভু।
৬.
উপরন্তু, মুসলিম বিশ্বাস হলো, ঈসা আলাইহিস সালাম ক্রুশবিদ্ধ হননি। খ্রিস্টান বিশ্বাসের সাথে এটি একটি আমাদের অন্যতম প্রধান পার্থক্য।
কুরআনের ৪ নাম্বার সূরা আন-নিসার ১৫৭ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেন:
وَّ قَوۡلِهِمۡ اِنَّا قَتَلۡنَا الۡمَسِیۡحَ عِیۡسَی ابۡنَ مَرۡیَمَ رَسُوۡلَ اللّٰهِ ۚ وَ مَا قَتَلُوۡهُ وَ مَا صَلَبُوۡهُ وَ لٰکِنۡ شُبِّهَ لَهُمۡ ؕ وَ اِنَّ الَّذِیۡنَ اخۡتَلَفُوۡا فِیۡهِ لَفِیۡ شَکٍّ مِّنۡهُ ؕ مَا لَهُمۡ بِهٖ مِنۡ عِلۡمٍ اِلَّا اتِّبَاعَ الظَّنِّ ۚ وَ مَا قَتَلُوۡهُ یَقِیۡنًۢا
এবং তাদের কথা হলো যে, ‘আমরা আল্লাহর রাসূল মারইয়াম পুত্র ঈসা মাসীহকে হত্যা করেছি’। অথচ তারা ঈসাকে হত্যা করেনি এবং তাঁকে শূলেও চড়ায়নি।বরং তাদেরকে ধাঁধায় ফেলা হয়েছিল।(ঈসার সদৃশ আরেকজনকে করা হয়েছিল)।
তারা এ বিষয়ে নানা রকম কথা বলে, তারা এক্ষেত্রে সন্দেহের মধ্যে পড়ে আছে, শুধুমাত্র অনুমান করা ছাড়া এ বিষয়ে (প্রকৃত) কোন জ্ঞানই তারা রাখে না।আর এটা নিশ্চিত যে, তারা তাঁকে হত্যা করেনি।
এ সূরার উল্লিখিত আয়াতের পরের ১৫৮ নাম্বার আয়াত বলছে :
بَل رَّفَعَهُ اللَّهُ إِلَيْهِ وَكَانَ اللَّهُ عَزِيزًا حَكِيمًا
বরং তাঁকে আল্লাহ তা’আলা নিজের কাছে উঠিয়ে নিয়েছেন। আর আল্লাহ হচ্ছেন মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
৭.
পরিশেষে যোগ করছি আবূ হুরাইরাহ্ রাদ্বি আল্লাহু আনহু বর্ণিত একটি হাদীস।
হাদীসটি আছে সাহীহ বুখারীর ২২২২ (এছাড়াও ২৪৭৬ ও ৩৪৪৮) এবং সাহীহ মুসলিমের ১৫৫ এবং সুনান তিরমিযীর ২২৩৩ নাম্বারে।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ “ وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَيُوشِكَنَّ أَنْ يَنْزِلَ فِيكُمُ ابْنُ مَرْيَمَ حَكَمًا مُقْسِطًا فَيَكْسِرَ الصَّلِيبَ وَيَقْتُلَ الْخِنْزِيرَ وَيَضَعَ الْجِزْيَةَ وَيَفِيضَ الْمَالُ حَتَّى لاَ يَقْبَلَهُ أَحَدٌ ”
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
যাঁর হাতে আমার প্রাণ, তাঁর কসম, মারইয়াম পুত্র তোমাদের মধ্যে (একসময়) ন্যায়পরায়ণ শাসক হিসেবে অবতীর্ণ হবেন এবং (তখন) ক্রুশ ভেঙ্গে ফেলবেন এবং শূকরকে হত্যা করবেন এবং জিজিয়া কর বাতিল করে দিবেন। (ঐ সময়) সম্পদের প্রাচুর্য এমন হবে যে কেউ দাতব্য উপহার গ্রহণ করতে চাইবে না।
৮.
জুমুআ’র খুতবা বেশ লম্বা করা যাবে না তবে অনুরোধ থাকবে, ঈসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কে, কুরআন ও হাদীস থেকে সঠিক বিষয়গুলো যেন আমরা শিখার চেষ্টা করি। বিশেষ করে ক্রিসমাসের এ সময়ে যখন তাঁকে নিয়ে পুরো বিশ্বের সবদিকে অনেক রকম আলোচনা ও পর্যালোচনা চলছে।
[এ নিবন্ধ মূলত বিগত জুমুআ’য় প্রদত্ত আমার ইংরেজী বক্তব্যের অনুবাদ।]
লেখক: মুফতি