জনাব আব্দুর রশীদ লুলু বাল্যকালেই তার জন্মদাত্রী মাকে হারান। তাই তিনি দশজনের মত মায়ের স্বাভাবিক আদর-স্নেহে বড় হয়ে উঠেননি। তাই তাঁর হৃদয়ে সবসময়ই মায়ের অভাববোধ প্রকট হয়ে উঠাটাই ছিল স্বাভাবিক। আর মায়ের অভাববোধ থেকে মায়ের স্মৃতিকে অমলিন করে রাখার প্রয়াসেই মায়ের নামে নামকরণ করে ‘আনোয়ারা’ প্রকাশনার দায়িত্ব হাতে নেয়া। সুতরাং এটুকু নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, মায়ের প্রতি এই যে অগাধ শ্রদ্ধা ও ভক্তির নিদর্শন ‘আনোয়ারা’ সেতো শত সংখ্যা প্রকাশিত হবে অনায়াসেই। তাঁর এই মহতি উদ্যোগের প্রতি ও তাঁর প্রতি রইল আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা।
আমি কোন লেখক বা কবি নই। সে ধরণের কিছু হওয়ার যোগ্যতাও আমার নেই। তবু ‘আনোয়ারা’য় নিয়মিত আমার লেখা প্রকাশিত হয়। সেটা কিভাবে সম্ভব তা একটু বলে নেয়া ভাল। তাহলেই ‘আনোয়ারা’ কি এবং তাঁর সম্পাদকই বা কে এবং কেমন লেখক তা জানতে আমাদের একটু সুবিধা হবে। আমার মাধ্যমিক শিক্ষালাভ আমাদেরই স্থানীয় নবগ্রাম হাজী মোঃ ছাইম উচ্চ বিদ্যালয়ে। অগ্রজ জনাব আব্দুর রশীদ লুলুও একই স্কুলের ছাত্র। আমাদের সময়ে উক্ত উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন মরহুম আব্দুল মন্নান সাহেব। আমাদের স্কুল জীবন শেষ হয়ে যাওয়ার কিছু দিন পর স্যারও নিজ এলাকায় একটি স্কুলের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়ে জকিগঞ্জে নিজ বাড়িতে চলে যান। আমি ১৯৯৪ খ্রীস্টাব্দে বাংলাদেশ ডাক বিভাগে চাকুরী পেয়ে সিলেট প্রধান ডাকঘরে নিয়োগপ্রাপ্ত হই এবং সিলেট শহরেই বসবাস শুরু করি। লুলু ভাই এবং মন্নান স্যার কারও সাথেই আর যোগাযোগ থাকেনি।
২০০৪ সালের কোন এক সময়। দিন তারিখ বা মাস ঠিক মনে নেই। হঠাৎ একদিন জনাব আব্দুর রশীদ লুলু সিলেট প্রধান ডাকঘরে উপস্থিত হয়ে আমাকে খুঁজে বের করেন এবং জানান যে, আব্দুল মন্নান স্যার ২৫শে ফেব্রুয়ারি ২০০৪ সালে ইন্তেকাল করেছেন এবং তাঁরই স্মরণে জনাব আব্দুর রশীদ লুলুর সম্পাদনায় একটি স্মরণিকা প্রকাশিত হতে যাচ্ছে এবং তিনি আমাকে জোর করে ধরেন আমি যেন তাতে একটি লেখা দেই। আমি তখন আমার শিক্ষাগুরুর উপর কিছু একটা লেখার সুযোগ পেয়েছি বলে রাজী হয়ে যাই এটা ভেবে যে, তাতে অন্তত আমার শিক্ষা ঋণ কিছুটা লাঘব হবে। যথাসময়ে আমি কাঁচা হাতের একটা ছোট নিবন্ধ লিখে দেই মরহুম আব্দুল মন্নান স্যারের উপর এবং যথারীতি প্রকাশিতও হয়।
পরবর্তীতে ২০০৬ সালের প্রথম দিকে তিনি আবার আমাকে বলেন যে, মরহুম আব্দুল মন্নান স্যারের উপর ইতোমধ্যে প্রকাশিত স্মারকগ্রন্থটি মানসম্পন্ন হয়নি এবং এজন্যে আরেকটি মানসম্পন্ন প্রকাশনা করতে চান। আমি তখন অনেক পীড়াপীড়ি করি যে, আমাকে যেন এসবের মধ্যে আর না জড়ান। কারণ যেহেতু আমি লেখক নই, সেহেতু আমার নিজের লেখাটাই মানসম্পন্ন নয় এবং আমি তাঁকে এটুকুও বলি যে, আমি মাঝে মধ্যে একটু আধটু গান লিখি। প্রবন্ধ-নিবন্ধ-কবিতা এসবে আমার হাত নেই। তাতে তিনি দ্বিগুণ উৎসাহিত হয়ে উঠেন এবং বলেন যে, যে গান লিখতে পারবে সে নিবন্ধও লিখতে পারে। একেবারে নাছোড়বান্দা। যাই হোক সেবারও একটি নিবন্ধ দিতে হল। তারপর তিনি আমাকে ধরেন ‘আনোয়ারা’য় নিয়মিত লেখা দেয়ার জন্য। সেই থেকে আজ অবধি আমার মনে হয়না ‘আনোয়ারা’র একটা সংখ্যাও আমার লিখা ছাড়া প্রকাশিত হয়েছে। ইতোমধ্যে ‘আনোয়ারা’য় আমার অনেক গান, ছড়া, কবিতা-প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। যদিও আমি বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভুক্ত গীতিকার হয়ে উঠতে পারিনি আজও। তবে বাংলাদেশ টেলিভিশন ২০০৭ সালে আমাকে তালিকাভুক্ত গীতিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে।
জনাব আব্দুর রশীদ লুলু এমন একজন সম্পাদক যার কাছে আমার ঋণের শেষ নেই। কারণ এমনও অনেক সময় গেছে, আমার লেখা প্রকাশনীতে দেয়া হয়নি বলে ‘আনোয়ারা’ বেরুতে সপ্তাহ/দু’সপ্তাহ বিলম্ব হয়েছে। কিন্তু আমার লেখা তাঁর চাই-ই চাই। এই যে একজন অখ্যাত অজ্ঞাত ব্যক্তির লেখা নেয়ার জন্য তার এত পীড়াপীড়ি তাতে এটুকু সহজেই অনুমেয় যে, যার লেখালেখিতে ভাল হাত আছে, তাঁর জন্য তিনি কতটা সময় ব্যয় করেন এবং নতুন লেখক সৃষ্টিতে তিনি কতটা আন্তরিক। সাহিত্যের প্রতি, সংস্কৃতির প্রতি, দেশের প্রতি সর্বোপরি মানুষের প্রতি কতটুকু শ্রদ্ধা ভালবাসা থাকলে শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সৃজনশীল ও ভাল কাজ করা যায় তার জ্বলন্ত প্রমাণ ‘আনোয়ারা’ তথা ‘আনোয়ারা’র সম্পাদক জনাব আব্দুর রশীদ লুলু।
‘আনোয়ারা’ মূলত: সাহিত্য প্রকাশনা হিসেবে প্রকাশের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করলেও তার পরিধি খুবই ব্যাপক। ‘আনোয়ারা’র সম্পাদক সাহেবের দূরদৃষ্টি ও আন্তরিকতার কারণে ‘আনোয়ারা’য় এমন সব বিচিত্র বিষয়াবলী সন্নিবেশিত হয়, যা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে খুবই প্রয়োজনীয় অথচ খুবই সূক্ষ্ম। এই যেমন উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় ‘জুলাই-সেপ্টেম্বর’ ২০১৫ সংখ্যার ৫ম পৃষ্ঠায় ‘প্রথম সরকারি হাসপাতাল’ শিরোনামে যে তথ্যটি তুলে ধরা হয়েছে তা আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। আমরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রায় প্রতিনিয়তই হাসপাতাল তথা চিকিৎসার সম্মুখীন হই। কিন্তু আমরা জানিনা হাসপাতাল কবে কোথায় কার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আমি অন্তত: ব্যক্তিগতভাবে এই প্রথম অবহিত হলাম যে, বিশ্বে প্রথম হাসপাতল প্রতিষ্ঠিত হয় মহতি সম্রাট অশোকের শাসনামলে।
এতো শুধু একটিমাত্র উদাহরণ দেয়া হল। ‘আনোয়ারা’য় এভাবে প্রতিটি সংখ্যায়ই আমরা বিচিত্র কিছু তথ্য পেয়ে থাকি, যা শুধুমাত্র আনোয়ারায়-ই পাওয়া যায়। তাছাড়া প্রবাদ-প্রবচন, ধাঁধাঁ, বিশ্বের প্রথম, বিশ্বের বড়, বিশ্বের ছোট, শাক-সবজি ও ফলমূলের গুণাগুণ, খনার বচন, কৃষি কণিকা, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগির খামার সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্য। মোট কথা জীবন যাপনের সাধারণ বিষয়বালীর কিছু না কিছু প্রায় প্রতিটি সংখ্যায়ই থাকে। তাছাড়া সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় যে বিষয়টি সেটি হচ্ছে হোমিওপ্যাথি। হোমিওপ্যাথির খুঁটিনাটি ছাড়াও প্রায় প্রতিটি সংখ্যায়ই হোমিওপ্যাথি নিয়ে কারো না কারো প্রবন্ধ/নিবন্ধ ছাপা হচ্ছে। এতে করে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার ইতিবাচক অনেক দিক আমাদের মত সাধারণের জানা হচেছ। জনাব আব্দুর রশীদ লুলু নিজেও একজন হোমিও চিকিৎসক বিধায় এর উপকারিতা সম্বন্ধে সাধারণকে অবগত করে তোলায় হোমিওপ্যাথি সম্বন্ধে সাধারণের আগ্রহ বাড়বে এবং এতে উপকারিতাও আসবে বলে আমার বিশ্বাস।
‘আনোয়ারা’ খুবই ছোট পরিসরে অনাড়ম্বরভাবে বিজ্ঞাপন বাহুল্য ব্যতিরেকে শুরু থেকেই যে গুরু দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে, তাতে আমি মনে করি ‘আনোয়ারা’ তার সঠিক দায়িত্ব সঠিকভাবেই পালন করে যাচ্ছে। তবে যে অর্থকষ্টের ভেতর দিয়ে প্রকাশনাটি দিনাতিপাত করছে, তা কাটিয়ে উঠতে সাহিত্যমোদি বিত্তবানরা সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে আসবেন এই প্রত্যাশা রইল।
লেখক: কবি-ছড়াকার, প্রাবন্ধিক ও সমালোচক।