রবিবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৮ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

স্যামুয়েল হ্যানিম্যান।। আনিসুল আলম নাহিদ



স্যামুয়েল হ্যানিম্যান। ছবি: ইন্টারনেট

হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা বিজ্ঞানের আবিষ্কারক মহাত্মা স্যামুয়েল হ্যানিম্যানের জন্ম ১৭৫৫ সালে ১০ এপ্রিল জার্মানির স্যাক্সনী রাজ্যে, এলবে নদীর তীরে অবস্থিত ছোট্ট শহর মাইসেনে। তাঁর পিতার নাম ক্রিশ্চিয়ান গটফ্রায়েড হ্যানিম্যান ও মাতার নাম জোহানা ক্রিশ্চিয়ানা স্পিয়েস। হ্যানিম্যানের পিতামহ, পিতা ও পিতৃব্য সবাই পেশাগতভাবে চিত্রশিল্পী ছিলেন।

হ্যানিম্যানের প্রথম পড়ালেখার হাতেখড়ি তাঁর বাবার কাছে। ছেলের প্রতি বাবার একটি উপদেশ ছিল- ‘জীবন-যাপনে ও নিজের কাজে কখনও মিথ্যা বা প্রতারণার আশ্রয় নেবে না।’ তারপর তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু করেন মাইসেন সরকারি টাউন স্কুলে। শিক্ষাজীবনের শুরুতেই তিঁনি অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দেন। হ্যানিম্যান মাত্র বারো বছর বয়সে একাধিক ভাষায় বিশেষ করে গ্রিক ভাষায় দারুণ পান্ডিত্য অর্জন করেন। কিন্তু লেখাপড়ায় অসাধারণ অগ্রগতি থাকার পরও অর্থাভাবে তাঁর শিক্ষা অর্জন বাধাগ্রস্থ হয়। তারপর বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহযোগিতায় এবং তাঁর অদম্য ইচ্ছায় পড়ালেখা চলতে থাকে। প্রিন্স’স স্কুলের শিক্ষা শেষে ১৭৫৫ সালে তিনি জার্মানির বিখ্যাত লাইপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালীন সময়ে তিনি ফাঁকে ফাঁকে নিম্নোক্ত বর্ণিত বইগুলো অনুবাদ করেন:
১) ‘ফিজিওলজিক্যাল এক্সপেরিমেন্টস এ্যান্ড অবজার্ভেশন উয়িদ কপার’।
২) ডা: ন্যুগেন্টের ‘হাইড্রোফোবিয়া’।
৩) ‘মিনারেল ওয়াটার্স এ্যান্ড ওয়ার্ম বাথস’।
৪) ডা: বলের দু’খন্ডে রচিত ‘নিউ আর্টস অব হিলিং’।

ছাত্র জীবনের শুরু থেকে নিয়ামানুবর্তী হ্যানিম্যান কোন প্রতিকূল অবস্থাতেই ভেঙ্গে পড়েননি। নানা প্রতিকূল অবস্থা অতিক্রম করে ডক্টর অব মেডিসিন (এম.ডি) ডিগ্রি লাভ করেন এবং প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতিতে খ্যাতিম্যান হয়ে উঠেন। এতদসত্বেও প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা, ব্যর্থতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করে তিঁনি প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতি পরিত্যাগ করে পরিবার-পরিজনের ভরণপোষণে অনুবাদ কর্মে নিযুক্ত হন। এরই এক পর্যায়ে ১৭৯০ সালে খ্যাতিম্যান ব্রিটিশ চিকিৎসা বিজ্ঞানী উইলিয়াম কালেনের মেটেরিয়া মেডিকা অনুবাদ কালে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা নীতির আভাষ পান। এরই সূত্র ধরে এই সময় তিনি সিনকোনা সেবন করে হোমিওপ্যাথির দ্বার খোলেন। ক্রমাগত গবেষণার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান নিয়ে ১৮১০ সালে প্রথম লিখেন অর্গানন (হোমিওপ্যাথির আরোগ্যের নিয়মনীতি)। হোমিওপ্যাথির প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় হ্যানিম্যান প্রচুর দুঃখ-কষ্ট ও ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করেন। স্বপরিবার যাযাবর জীবন যাপন করেন এবং এক শহর থেকে অন্য শহরে ঘুরে বেড়ান। তাঁর বিরুদ্ধপক্ষ নানাভাবে হয়রানি করে কিন্তু হোমিওপ্যাথিতে তাঁর সত্যনিষ্ঠার ফলে অনড়ভাবে ঠিকে থাকেন।

হ্যানিম্যান ১৭৮২ সালে প্রথম বিয়ে করেন। তাঁর প্রথমা স্ত্রীর নাম জোহানা হেনরিয়েট লিউপোল্ডিন। তাঁর দুঃখ কষ্টের দিনের সহযাত্রী ১১ সন্তানের জননী জোহানা ১৮৩০ সালের ৩১ মার্চ মারা যান। পরবর্তীতে ১৮৩৪ সালের ৮ অক্টোবর ফরাসী তরুণী মেরী মেল্যানী ডি’হার্ভিলি গহিয়ের হ্যানিম্যানের কাছে চিকিৎসা নিতে আসেন, যখন হ্যানিম্যান ক্যুথেনে অবস্থান করছিলেন। আশ্চর্যজনক ভাবে মেরী মেল্যানী তখন হ্যানিম্যানের চিকিৎসায় সুস্থ্য হয়ে উঠেন। তারপর ১৮৩৫ সালে ১৮ জানুয়ারি হ্যানিমেনের সাথে মেল্যানীর বিয়ে হয়। এই বিয়ের পর হ্যানিম্যান তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি সন্তানদের মধ্যে ভাগ করে ফ্রান্সের প্যারিসে দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। কোন কোন গবেষক দাবি করেন তিঁনি এই সময়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।

প্যারিসে হ্যানিম্যান দ্বিতীয় স্ত্রীর সহায়তায় নির্বিঘ্নে জমজমাট হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা ব্যবসা পরিচালনা করেন এবং প্রচুর অর্থকরী অর্জন করতে সক্ষম হন। বলাবাহুল্য, শিষ্য ও অনুরাগীদের সহায়তায় তাঁর জীবদ্দশায় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতি সুদূর ভারতবর্ষ থেকে আমেরিকা এবং ইউরোপে বিস্তার লাভ করে।

ধৈর্যশীল, কষ্টসহিঞ্চু ও প্রচুর কার্যক্ষমতার অধিকারী হ্যানিম্যান প্রচুর পড়াশোনা করতেন এবং তাঁর প্রিয় বিষয় ছিল রসায়ন। মূলত চিকিৎসা বিজ্ঞান ও রসায়ন সংক্রান্ত প্রচুর বই অনুবাদে তিঁনি ব্যাপক সময় ব্যয় করেন। উল্লেখ্য, কৃষি বিষয়েও একটি বই অনুবাদ করেন। অনুবাদের পাশাপাশি হ্যানিম্যান বহু মৌলিক (বই ও প্রবন্ধ-নিবন্ধ) লেখালেখি করেছেন। হোমিওপ্যাথি বিষয়ে ভক্ত-অনুরাগীদের অনেক চিঠিপত্রও লিখেছেন। হোমিওপ্যাথিতে বহুল ব্যবহৃত ও সমাদৃত তাঁর তিনটি বই- অর্গানন, মেটেরিঢা মেডিকা পিউরা ও ক্রনিক ডিজিজ।

অবিরাম গবেষণা ও পরীক্ষা নিরীক্ষার ফলশ্রুতিতে অর্গানন ১৮১০ সাল থেকে ১৮৪২ সাল পর্যন্ত ৬টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ৬ষ্ঠ ও শেষ সংস্করণ প্রায় পূর্ণাঙ্গ ও নিখুঁত বলে হ্যানিম্যান নিজে মতামত ব্যক্ত করে গেছেন। যদিও এ সংস্করণটি হ্যানিম্যানের মৃত্যুর ৭৭ বছর পর প্রকাশিত হয়। এর কারণ হিসেবে অনেক গবেষক হ্যানিম্যানের দ্বিতীয় স্ত্রীর অর্থলিপ্সাকে দায়ী করেন। উল্লেখ্য, পারিসে অবস্থান কালীন সময়ে হ্যানিম্যান প্রচুর রোগীর চিকিৎসা করে ব্যস্ত সময় কাটান, এতে তাঁর বেশ আয়-রোজগার হলেও হোমিওপ্যাথি বিষয়ক গবেষণা ও লেখালেখি ব্যাহত হয়। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এই সময় সন্তান-সন্ততি ও আত্মীয়-স্বজন থেকে দূরে থাকার কারণে তিঁনি মানসিক কষ্টে ছিলেন। ক্রমে হ্যানিমেনের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকে। শেষদিকে তিনি শ্বাসনালীর শ্লেষ্মাস্রাবে আক্রান্ত হন এবং শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। এরই এক পর্যায়ে ১৮৪৩ সালের ২ জুলাই ভোর ৫টার দিকে প্যারিসে এই মহান চিকিৎসা বিজ্ঞানী পরলোক গমন করেন। মৃত্যুকালে তিঁনি তৃপ্তির সাথে উচ্চারণ করে গেছেন- ‘আমি বৃথা জীবন ধারণ করি নি।’ ২ জুলাই মৃত্যু বরণ করলেও ১১ জুলাই হ্যানিম্যানকে মন্টমার্ট্ররে একটি পুরোনো ব্যবহৃত সমাধিতে অনাড়ম্বরভাবে সমাহিত করা হয়, যা রহস্যজনক। তারপর ১৯৯৮ সালের ২৪ মে হ্যানিম্যানের ভক্ত-অনুরাগীদের উদ্যোগে মন্টমার্ট্রের সাধারণ সমাধি থেকে শবদেহ উত্তোলন করে ফ্রান্সের পেরে লাকাসে খ্যাতিমান ব্যক্তিদের সাথে পুনরায় সমাধিস্ত করা হয়। সেখানে আন্তর্জাতিক হোমিওপ্যাথিক কংগ্রেসের উদ্যোগে সমাধিতে কারুকার্য খচিত তাঁর ভাস্কর্য ও স্থাপত্যশৈলীর সমন্বয়ে দৃষ্টিনন্দন স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়।

হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে হ্যানিম্যানের মূল্যবান ৫টি বাণী-
১. বিজ্ঞান একদিন হোমিওপ্যাথিক সব বিষয়ের ব্যাখ্যা দেবে তবে সেদিনের অপেক্ষায় না থেকে রোগ আরোগ্যে হোমিওপ্যাথি ব্যবহার করে যাও।
২. অভিজ্ঞতায় যদি দেখ আমার পদ্ধতিই (হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতি) শ্রেষ্ট, তবে তা মানবকল্যাণে ব্যবহার কর। আর যা কিছু গৌরব ঈশ^রকেই দাও।
৩. আমার পদ্ধতি অনুসরণ করতে চেষ্টা করো, কিন্ত অন্ধ অনুসরণ করো না, সাফল্যটুকু গ্রহণ করবে এবং বিফলতা নির্ভিক চিত্তে প্রকাশ করে দাও।
৪. হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞান বুদ্ধি-বিবেচনাহীন বর্বরদের জন্য সৃষ্টি হয়নি, সৃষ্টি হয়েছে জনকল্যাণের জন্য।
৫. আমার বিশ^াস এই চিকিৎসা বিধান (হোমিপ্যাথি)-এর সুযোগ মানবজাতি ধন্যবাদের সাথে একদিন গ্রহণ করবে, তখন হয়তো আমি এ পৃথিবীতে থাকবো না।

লেখক: হোমিওপ্যাথি ও কৃষি বিষয়ক লেখক।

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!