
দুপুর প্রায় বারোটা। সিলেট শহরস্থ সাপ্তাহিক ‘বাংলার আলো’ অফিসে পা রাখতেই মনটা আশ্চর্য্য রকম ভালো হয়ে যায়। সুন্দর সকালটা প্রিয়জনের সাথে মনোমালিন্যে মাটি হওয়ার পর মনের খুতখুত ভাবটা সহসা দূর হয়ে যায়। অফিসে একা অনুজ প্রতীম কাজী হেলাল-‘বাংলার আলো’র নির্বাহী সম্পাদক, তরুণ কবিতাকর্মী, আমার বিবেচনায় ছড়া-কবিতায় যার হাত শক্ত-সাবলীল।
হেলাল হাসি মুখে অভ্যর্থনা জানালো। বসলাম অনেকক্ষণ। দু’জন মিলে প্রুফ দেখলাম ‘বাংলার আলো’য় প্রকাশিতব্য আমার গল্প ‘দুরন্ত যৌবন সংযত প্রেম’- এর। কথা হলো অনেক, সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পর্কে। প্রকাশিতব্য বিশেষ গল্প সংকলন ‘স্মৃতির আকাশ’ সম্পর্কেও।
কথার ফাঁকে ফাঁকে মনটা আমার আক্ষেপে ভরে ওঠে- ইশ্! কতটা দিন লেখালেখি থেকে দূরে। এই চার/পাঁচ বছরে পাঠক ও সাহিত্যকর্মীদের সাথে আমার কেমন একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। যদিও প্রত্যন্ত অঞ্চলে পড়ে থেকে বার বার আমার মনে হয়েছে- ‘দিগন্তে দাঁড়িয়ে / দু’বাহু বাড়িয়ে / কে যেন আমায় / ডেকে নিতে চায় ….।’
ওখানে বসেই হেলালের সৌজন্যে টেলিফোনে আলাপ হলো জনৈক সাহিত্য ও ইন্সুরেন্সকর্মীর সাথে। যার সাথে যৌথ সম্পাদনায় “স্মৃতির আকাশ”-এর কাজ করার কথা। আমন্ত্রণ জানালেন তার ইন্সুরেন্স কোম্পানীর অফিসে। এক পর্যায়ে ওঠে বাইরে চা খেয়ে বিদায় নিলাম কাজী হেলালের কাছ থেকে। চলতে চলতে আমি হারিয়ে যাই স্মৃতির অতলে- সেই ছিয়াশী-সাতাশীর রঙ্গীন দিনগুলোতে। যখন আমি দু’হাতে লিখেছি। লিখেছি গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, ছড়া, আলোচনা-সমালোচনা …….।
অফিসে বেজায় কাজ। তারপরও ওই সাহিত্য ও ইন্সুরেন্সকর্মী কিছু সময় দিলেন। চা খাওয়ালেন। “স্মৃতির আকাশ”-এর সাথে সাথে আমাদের নিজেদের সাহিত্য কর্ম সম্পর্কেও ঠুকঠাক কথা হলো। ওঠার পথে তাদের কন্ট্রোলার সাহেবের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন, চমৎকার বিনয়ী মানুষ। যদিও লক্ষ্য করলাম, এই সামান্য সৌজন্য বিনিময়ের সময়টাতেও তিনি তার পেশাগত দায়িত্বের কথা ভুলেননি।
শীতের দিন বেলা দ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি করে ছুটলাম চৌধুরী প্রিন্টিং- ‘সুর’ অফিসে। আগে দেখা করতে হবে ষাটের দশকের কথাশিল্পী অগ্রজ মোহাম্মদ আব্দুল হামিদের সাথে। রিক্সায় বসে বার বার ভেসে ওঠে সুপ্রিয়-শ্রদ্ধেয় হামিদ ভাই’র স্মৃতি। যে হামিদ ভাইকে আমি দীর্ঘদিন দূরে থেকে কাছে থেকে অনেক দেখেছি। যে হামিদ ভাই’র সাক্ষাৎকার (‘সুর’-এ) নিয়েছি। যে হামিদ ভাই সম্পর্কে দৈনিক মিল্লাত (ঢাকা), দৈনিক সিলেটের ডাক ও সাপ্তাহিক সুর-এ লিখেছি।
চৌধুরী প্রিন্টিং-এ ওহীদুজ্জামান চৌধুরীর সাথে কুশল বিনিময় হলো। এখান থেকে প্রকাশিত হতো সুপ্রিয় ‘সুর’। এক সময় যে ‘সুর’ আমাকে অফার দিয়েছে নিয়মিত লিখতে, নিজস্ব প্রতিনিধি হতে। যে ‘সুর’-এ আমার অসংখ্য লেখা প্রকাশিত হয়েছে। সাহিত্যাঙ্গনে আমাকে পরিচিতির ব্যাপ্তি দান করেছে। উল্লেখ্য, তখন আমি মোহাম্মদ আব্দুর রশীদ নামে লিখতাম।
ওহীদ ভাই নিজে লেখালেখি না করলেও সাহিত্য ও সাহিত্যকর্মীদের প্রতি অত্যন্ত আন্তরিক। ‘সুর’ সম্পাদক কবি সিরাজ চৌধুরী দেশের বাইরে। হামিদ ভাই’র সাথে এখানে দেখা হওয়ার কথা। তিনি রেডিও-তে আছেন, এখনও ফেরেননি।
অগত্যা অপেক্ষার পালা। ‘সুর’ অফিসে বসে স্মৃতি হাতড়াই। যখন-তখন এখানে আড্ডা মেরেছি, সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে আলোচনা করেছি। অনেক প্রতিষ্ঠিত ও প্রতিশ্রুতিশীল সাহিত্যকর্মীর সাথে এখানেই আলাপ পরিচয় হয়েছে। ইশ্ কোথায় যে হারিয়ে গেলো- ‘সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলো …..।’
নাহ্, হামিদ ভাই আসছেন না। শেষ পর্যন্ত যেতে হলো তাঁর বাসায়। আমার আশঙ্কাই সত্য হলো। সরাসরি তিনি চলে এসেছেন বাসায়। হামিদ ভাই অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করলেন। অনেক দিন পর দেখা। খুটিয়ে খুটিয়ে তিনি সাহিত্যাঙ্গন থেকে আমার নির্বাসিত জীবন সম্পর্কে জানতে চাইলেন। সিলেটের কথাসাহিত্য সম্পর্কে অনেক কথা হলো। ফাঁকে ফাঁকে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন সম্পর্কে বললেন। চা পর্বের পর সবিনয় আন্তরিকতায় তুলে দিলেন তাঁর চার চারটি বই।
পড়ন্ত বিকেলে হামিদ ভাইসহ কবি-গীতিকার লাভলী চৌধুরীর বাসায় গিয়ে হাজির। বসলাম খানিকক্ষণ। ‘স্মৃতির আকাশ’- সম্পর্কে প্রয়োজনীয় কথা হলো। চা’র অফার রক্ষা করা সম্ভব হলো না। সময় নেই। ‘যুগভেরী’তে কবি-সাংবাদিক শ্রদ্ধেয়া শামসাদ হুসামের সাথে দেখা করতে হবে। যে শামসাদ আপা আন্তরিকতার সাথে আমার সম্পাদিত অনিয়মিত সাহিত্য পত্র “প্রগতি”তে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তাঁর হাত দিয়ে ‘যুগভেরী’র শাপলার মেলা থেকে আরম্ভ করে সাহিত্য বাসরে আমার অনেক লেখা প্রকাশিত হয়েছে। যিনি বিগত ১৫ই অক্টোবর’৯৩ অনুষ্ঠিত ‘বৃহত্তর সিলেট শাব্বীর শিশু সাহিত্য সম্মেলন’-এ অংশ গ্রহণের জন্য সেমিনার উপ-পরিষদ-এর আহবায়ক শামীমা চৌধুরীর পক্ষে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। যার আন্তরিকতায়- ভালোবাসায় আমি অনেক ঋণী। কিন্তু দূর্ভাগ্য, তাড়াহুড়া করে ‘যুগভেরী’ অফিসে পৌঁছে দেখা গেলো অফিস বন্ধ। শামসাদ আপার সাথে দেখা হলো না। বাসায় যাওয়া যায়। কিন্তু হাতে অতো সময় নেই।
অগত্যা ফিরতে হলো বাড়ীর পথে। যে পরিকল্পনা নিয়ে বালাগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সিলেট শহরে বেরিয়েছিলাম, তা কতক বাস্তবায়িত হলো, কতক রয়ে গেলো। তবে নিঃসন্দেহে সাহিত্যাঙ্গন ও সাহিত্যকর্মীদের মাঝে এই দিন আমার জীবনের স্মৃতির আকাশে উজ্জল হয়ে আছে- থাকবে।
আব্দুর রশীদ লুলু: ইসলাম ধর্ম, হোমিওপ্যাথি ও কৃষি বিষয়ক লেখক ও গবেষক।



