
প্রথম লেখা প্রথম বই ছোটবড় প্রতিটি লেখকের জীবনেই এক অনন্য আনন্দের খোরাক, বিশেষ করে তা যখন প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়। প্রায় প্রতিটি লেখকের স্মৃতিতেই সে স্মৃতি জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকে। এর সাথে জড়িত থাকে নানা ঘটন-অঘটন, ঘাত-প্রতিঘাত। তাই এ স্মৃতি নিয়ে যখন কোনো লেখক লিখতে বসেন তখন স্বাভাবিকভাবেই তাঁর মনে এক অন্য ধরনের পুলক বা শিহরণ জাগরিত হয়। এহেন রোমান্টিক বা নষ্টালজিক বিষয়গুলোকে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করতে ব্যতিক্রর্মী প্রয়াস নিয়েছেন ‘আনোয়ারা’ সম্পাদক আব্দুর রশীদ লুলু। তাঁর সম্পাদনায় শিকড় সন্ধানী প্রকাশনা ‘আনোয়ারা’য় প্রথম সংখ্যা (নভেম্বর ২০০৪) থেকে বের হয়েছে বেশ কটি ‘প্রথম লেখা প্রথম বই’। যাতে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে বেশ ক’জন লেখকের প্রথম লেখা প্রথম বইয়ের পটভূমিসহ সংক্ষিপ্ত অথচ চমৎকার বর্ণনা। এতে প্রকাশিত হয়েছে বোরহান উদ্দিন খান, মোহাম্মদ মোশতাকুর রহমান, প্রফেসর মো: আব্দুল আজিজ, ঝর্ণাদাশ পুরকায়স্ত, প্রফেসর নন্দলাল শর্মা, আব্দুল হামিদ মানিক, সুমনকুমার দাশ, আব্দুল হালীম খাঁ, আমেনা আফতাব, প্রফেসর জাহানারা খাতুন, সাদিয়া চৌধুরী পরাগ, মহিউদ্দিন শীরু প্রমুখ লেখক-সাংবাদিকদের স্মৃতি রোমন্থনকৃত বিভিন্ন অভিজ্ঞতার বিচিত্র বর্ণনা।
লিখতে চাইলেই যে হুট করে লেখা হয়ে উঠেনা কিংবা লেখক হওয়া যায় না কিংবা লিখতে গেলেও যে কত ধরণের ঝুট ঝামেলা পোহাতে হয় তার একটা নমুনা পাওয়া যায় বোরহান উদ্দিন খান লিখিত ‘প্রথম লেখা প্রথম বই’ নিবন্ধের এই উদ্বৃতি থেকে- “একদিন ক্লাসের এক সহপাঠী আমার খাতায় একটি কবিতা দেখে ওটা আমার লেখা কি না জিজ্ঞেস করেছিল। তারপর সবাই মিলে কবিতাটি পড়েছিল। বাংলা টিচার আসতেই তারা আমি যে কবিতা লিখি সে কথা বলেছিল। তিনি আমার কবিতাটি পড়লেন এবং পরদিন ফ্রেশ কবিতা লিখে আনার জন্য বললেন। আমি বাসায় এসে একটি নাতিদীর্ঘ কবিতা লিখে মাদ্রাসায় নিয়ে গেলাম। স্যার আমার কবিতা পড়লেন। তারপর বললেন অন্যের লেখা কবিতা নিজে নকল করে আনলে কেউ কবি হয়ে যায় না। কথাটা বলেই আমার খাতা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। ক্লাসের সবাই হেসে উঠল। আমি চরম অপমানবোধ করলাম। অথচ আদৌ কবিতাটি নকল ছিল না। এখন বুঝুন একজন লেখকের প্রথম জীবনটা কী রকম হয়।
ঝর্ণাদাশ পুরকায়স্থ লিখেছেন “পড়ার বইয়ের নীচে গল্প-উপন্যাস রেখে অবিরত পড়ে গেছি। মা-বাবার পায়ের আওয়াজ পেলেই জোরে জোরে ইতিহাস-ভূগোল কিংবা ইংরেজি গ্রামার পড়া শুরু করতাম। মা অবশ্য সন্দেহের সুরে বলতেন, এতক্ষণ কি করেছ? পড়াতো শুনতে পাইনি। শোন একদম ফাঁকি দেবেনা।” প্রসঙ্গঃত এখানে উল্লেখ্য যে, আমাদের সমাজে সেকালে কিংবা একালে পাঠ্য বইয়ের বাইরে কিছু পড়াকে-লিখাকে অনেকে অহেতুক মনে করেন।
লেখালেখি করতে গেলে তৃতীয় নয়ন বা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়টা সজাগ থাকতে হয় বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি। কারণ, প্রতিটি লেখকের লেখার বিষয়বস্তু বা অন্তর্নিহিত গুঢ় তত্ত্ব আমাদের চোখের সামনে আমাদেরই পরিবেশ-পারিপার্শ্বিকতা থেকে সংগৃহীত। কিন্তু তা অনুধাবন করার মত দৃষ্টিভঙ্গী সবার থাকেনা। যার থাকে তিনিই লেখালেখিতে প্রয়াসী হন, ফলে হয়তো লেখক হয়েও উঠেন। তারই একটা চমৎকার বর্ণনা পাই সাদিয়া চৌধুরী পরাগের লেখায়। তিনি লিখেছেন ‘রোজ সকালে-বিকেলে বহির্বাটির শান বাধানো প্রশস্ত সিঁড়ির ধাপে শিল নুড়ি নিয়ে একা একা খেলাকালে চোখে পড়ে বাসার উল্টো দিকের চার্চের পাদ্রী সাহেবকে। সকাল সন্ধ্যা লাঠি ভর দিয়ে হয়তো স্বাস্থ্যগত কারণে নির্মল হাওয়ায় ঘুরে বেড়ান।” তাঁর ইচ্ছা জাগে তিনি কী করেন দেখে আসতে। কিন্তু মেয়ে হওয়ার কারণে যাওয়া আর হয়ে উঠেনা। কিন্তু তাঁর মনে কৌতুহল দানা বাঁধতে থাকে। শেষ পর্যন্ত শ্লেট পেন্সিলের সহযোগিতায় এর প্রকাশ ঘটে-
“পাদ্রী সাহেব! লাঠি হাতে যান বা কোথায়? পথটি একটু বলেন।
নদী তীরে? পাহাড় চুড়ায়? পিছলে পড়ে যাবেন।”
কী চমৎকার সেই ছোট্টবেলার অনুভূতি। এহেন অল্প বয়সে যার এরকম অনুভূতি আর তা প্রকাশ, তাঁর লেখক হওয়া ছাড়া আর উপায়ই বা কী! প্রতিটি লেখাতেই এভাবেই প্রতিজন লেখকেরই উল্লেখ্যযোগ্য বিষয়াবলীকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
আমার কাছে মনে হচ্ছে আব্দুর রশীদ লুলু সম্পাদিত পরিচ্ছন্ন প্রকাশনা ‘আনোয়ারা’য় প্রকাশিত ‘প্রথম লেখা প্রথম বই’ শীর্ষক লেখাগুলো সবারই বিশেষ করে নবীন লেখকদের পাঠ করা প্রয়োজন। কারণ এতে তারা বিভিন্ন লেখকের লেখা থেকে বুঝতে পারবেন যে, কোনো একটা লেখা লিখে ফেললেই তা সবার নজরে পড়ে যাবেনা কিংবা মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়ে যাবে না। এর জন্য পেরোতে হবে অনেক পথ, সইতে হবে অনেক অপমান-ঠাট্টা-বিদ্রুপ। কিন্তু ধৈর্য্য সহকারে লেগে থাকলে একদিন যারা ঠাট্টা-বিদ্রুপ-অপমান করে তারাই সম্মান-সমাদর করে- এই উপলব্ধিটুকু হুদয়ঙ্গম হবে, যা লেখালেখিতে অত্যন্ত জরুরী। এক কথায় অপরিহার্য।
যেমন রশীদ জামিল তাঁর লেখাটা শুরু করেছেন এভাবে-“বিখ্যাত লেখক এডগার এলেন পো’কে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল ভাল লেখক হতে হলে কী লাগে? তিনি জবাব দিলেন যে, “একটা বড় ডাস্টবিন লাগে। লেখা নামক যে আবর্জনা তৈরি হবে, সেগুলো ফেলে দেবার জন্যে।” তাহলে বুঝুন লেখকের অবস্থা।
‘আনোয়ারা’ সম্পাদক আব্দুর রশীদ লুলুকে অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাতে হয় এ জন্যে যে, তিনি এরকম একটি ব্যতিক্রর্মী প্রায়স নিয়ে যে এগিয়ে এসেছেন। তা কিন্তু নবীন লেখকদের প্রাণে আলো ও সাহসের সঞ্চার করবে যা একজন লেখকের মনোবল ধরে রাখার জন্য অত্যাবশ্যকীয়। লেখালেখি করতে গেলে একাধারে প্রয়োজন প্রচুর পড়াশোনা করা, অন্তর্দৃষ্টি প্রখর করা, ধৈর্য্য সৈর্য্য নিয়ে নীরবে সাধনা করে যাওয়া। যার উদ্দেশ্য হবে সমাজকে কিছু দেয়া কিছু নেয়ার উদ্দেশ্যে থাকলেই আর লেখালেখি হয়ে উঠেনা। কিন্তু বর্তমান নগদায়নের যুগে নগদ প্রাপ্তির আশাকে শিকে তুলে সাধনা চালিয়ে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। এই মনোবল ধরে রাখার জন্য প্রথম লেখা প্রথম বই শিরোনামের লেখাগুলো পঠন সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আমি মনে করি।
আশা করি, শিকড় সন্ধানী প্রকাশনা ‘আনোয়ারা’র সহযোগী প্রতিষ্ঠান আনোয়ারা হোমিও হল কিংবা আনোয়ারা ফাউন্ডেশন থেকে ‘প্রথম লেখা প্রথম বই’ অচিরেই বই আকারে প্রকাশিত হবে।



