বৃহস্পতিবার, ৫ ডিসেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রাশিয়া বিশ্বকাপে দাপুটে ফুটবলে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স



রাশিয়া বিশ্বকাপের চমক ক্রোয়েশিয়া তাদের প্রথম ফাইনালে কোনও পাত্তাই পেলোনা ফ্রান্সের কাছে। ক্রোয়েটদের ৪-২ গোলে হারিয়ে ২০ বছর পর বিশ্বের শ্রেষ্ঠত্ব ফিরে পেল ফ্রান্স। ১৯৯৮ সালে প্রথমবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল তারা ব্রাজিলকে হারিয়ে। ২০০৬ সালে ফাইনালে উঠেও ইতালির কাছে টাইব্রেকারে হেরে যায় লে ব্লুরা। এক যুগ পর আবার শিরোপার লড়াইয়ে উঠে সেই আক্ষেপ মুছে ফেলে দ্বিতীয় শিরোপা জিতলো দিদিয়ের দেশমের দল।

দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করলো ফ্রান্স। ছবি : রয়টার্স

খেলায় প্রথম ১৫ মিনিটে ফ্রান্সকে খুঁজেই পাওয়া না গেলেও মারিও মানজুকিচের আত্মঘাতী গোলে ফ্রান্স এগিয়ে যায়। পরে অবশ্য সমতা ফেরাতে সক্ষম হন ইভান পেরিসিচ।

গোল করে সমতা ফেরান পেরিসিচ। ছবি : রয়টার্স

প্রথমার্ধেই পেনাল্টি থেকে ফ্রান্সকে আবার এগিয়ে দেন অঁতোয়ান গ্রিজমান। দ্বিতীয়ার্ধে দারুণ দুই গোলে ব্যবধান বাড়ান পল পগবা ও কিলিয়ান এমবাপে। গোলরক্ষক উগো লরিসের মারাত্মক ভুলে বল জালে পাঠিয়ে ক্রোয়েশিয়াকে আশা দেখিয়েছিলেন মানজুকিচ। তবে নক-আউট পর্বের আগের তিন ম্যাচের মতো শেষ পর্যন্ত আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি ক্রোয়াটরা।

শুরু থেকে বল দখলে রেখে আক্রমণে এগিয়ে ছিল ক্রোয়েশিয়া। তবে ভালো কোনো সুযোগ তৈরি হয়নি। খেলার ধারার বিপরীতে এগিয়ে যায় ফ্রান্স। ১৮তম মিনিটে ডি-বক্সের অনেক বাইরে থেকে গ্রিজমানের ফ্রি-কিক হেডে বিপদমুক্ত করতে চেয়েছিলেন সেমি-ফাইনালের জয়সূচক গোলদাতা মানজুকিচ। বল তার মাথায় ছোঁয়া লেগে জালে ঢোকায় কিছুই করার ছিল না গোলরক্ষক দানিয়েল সুবাসিচের।

মারিও মানজুকিচ ফাইনালে গোল করেছেন, তারও আগে করেছেন আত্মঘাতী গোল! ছবি: রয়টার্স

বিশ্বকাপের ইতিহাসে ফাইনালে এটাই প্রথম আত্মঘাতী গোল।

নক-আউট পর্বের তিনটি ম্যাচেই আগে গোল খেয়ে ম্যাচে ফিরেছিল ক্রোয়াটরা। এবারও ফিরতে দেরি হয়নি। ২৮তম মিনিটে ডি-বক্সের ভেতর থেকে দুর্দান্ত শটে গোল করেন পেরিসিচ। ফ্রি-কিক থেকে ডি-বক্সে আসা বল জটলা থেকে দোমাগোই ভিদা কাটব্যাক করেছিলেন। ডান পা দিয়ে বল আয়ত্তে নিয়ে বাঁ পায়ের জোরালো শটে লরিসকে ফাঁকি দেন সেমি-ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষেও সমতা ফেরানো পেরিসিচ। টুর্নামেন্টে এটি এই মিডফিল্ডারের তৃতীয় গোল।

দশ মিনিট পর আবার এগিয়ে যায় ফ্রান্স পেনাল্টি থেকে। কর্নার থেকে ডি-বক্সে আসা বলে লেগেছিল পেরিসিচের হাতের ছোঁয়া। রেফারি মাঠের বাইরে গিয়ে ভিডিও রিপ্লে দেখে সিদ্ধান্ত দেন স্পট-কিকের। ঠাণ্ডা মাথায় টুর্নামেন্টে নিজের চতুর্থ গোলটি করেন গ্রিজমান।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই আবার সমতা ফিরতে পারতো। ইভান রাকিতিচের বাড়ানো বল ধরে আন্তে রেবিচের নেওয়া শট দুর্দান্তভাবে ঠেকান লরিস।
৫২তম মিনিটে ম্যাচে প্রথমবারের মতো জ্বলে উঠেন এমবাপে। পাল্টা আক্রমণে পগবার বাড়ানো বল ধরে দুর্দান্ত গতিতে ভিদাকে পেছনে ফেলে ডি-বক্সে ঢুকে শট নিয়েছিলেন পিএসজির এই ফরোয়ার্ড। পা দিয়ে ঠেকান সুবাসিচ।

দ্বিতীয়ার্ধেও অনেকটা খেলার ধারার বিপরীতে গোল পেয়ে যায় ফরাসিরা। ৫৯তম মিনিটে বাঁ দিক থেকে দুই ডিফেন্ডারকে ফাঁকি দিয়ে ডি-বক্সে এমবাপের বাড়ানো ক্রস ধরে গ্রিজমান বল পাঠান পেছনে থাকা পগবাকে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের এই মিডফিল্ডারের ডান পায়ের প্রথম শট ফেরে রক্ষণে। ফিরতি বলে বাঁ পায়ের শট যায় জালে।

তৃতীয় গোল করে পগবা’র উদযাপন। ছবি : রয়টার্স

ছয় মিনিট পর দুর্দান্ত গোলে ব্যবধান আরও বাড়ান এমবাপে। বাঁ দিক থেকে লুকা এরনঁদেজের পাসে প্রায় ২২ গজ দূর থেকে নিচু শটে করেন টুর্নামেন্টে তার চতুর্থ গোল।

মাত্র উনিশেই বিশ্বকাপ শিরোপায় চুমু খাবার সৌভাগ্য হলো এমবাপে’র। ছবি: রয়টার্স

পেলের পর প্রথম টিনএজার হিসেবে বিশ্বকাপের ফাইনালে গোল পেলেন ১৯ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ড।

এরপরই লরিসের মারাত্মক ভুল। ব্যাকপাসে বল পেয়ে অযথা এগিয়ে আসা মানজুকিচকে কাটাতে চেয়েছিলেন। পারেননি, মানজুকিচের বুটের টোকায় বল চলে যায় জালে। নির্ধারিত সময় শেষের তখনও ২১ মিনিট বাকি। আশা জাগে ক্রোয়াট শিবিরে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর ইতিহাস গড়া হয়নি মদ্রিচ-রাকিতিচদের।

১৯৯৮ বিশ্বকাপে নিজেদের অভিষেক আসরে সেমি-ফাইনালে ফ্রান্সের কাছে হারতে হয়েছিল তাদের; আর এবার ফাইনালে। ফরাসিদের বিপক্ষে জয়টা অধরাই রয়ে গেল ক্রোয়াটদের। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত দুই দলের দেখা হয়েছে ছয়বার। ফরাসিদের চার জয়ের সঙ্গে দুটি ড্র।

ব্রাজিলের মারিও জাগালো ও জার্মানির ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের পর খেলোয়াড় ও কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জয়ের কীর্তি গড়লেন দেশম। ১৯৯৮ সালে ফ্রান্সের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি।

দেশমকে মাথায় তুলে শূন্যে ছুড়ছেন গ্রিজমান-পগবারা। ছবি : রয়টার্স

দেশমকে মাথায় তুলে তাই কয়েকবার শূন্যে ছুড়লেন গ্রিজমান-পগবারা। লাল-সাদা-নীল পতাকা নিয়ে ছুটলেন মাঠের বিভিন্ন প্রান্তে। ক্রোয়েশিয়ার নেতা লুকা মদ্রিচের চোখে তখন নির্লিপ্ত দৃষ্টি। সতীর্থদের বেশিরভাগের চোখে জল। কিন্তু আশ্চর্য শান্ত তাদের কোচ জ্লাতকো দালিচ। শিষ্যদের নিয়ে গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়িয়ে সবার হাতে হাত রেখে দিলেন প্রেরণা অথবা নিলেন নতুন কোনো শপথ।

এরপর ক্রমেই বাড়তে থাকা বৃষ্টির মধ্যে কেবল অপেক্ষা; সান্ত্বনার রূপার পদক গলায় ঝোলানোর জন্য ক্রোয়াটদের। ট্রফি উঁচিয়ে ধরার জন্য মধুর অপেক্ষা ফরাসিদের। প্রায় ছয় কেজি ওজনের সোনার ট্রফিটা হাতে পেতেই উড়ল সোনালী কনফেত্তি। বুনো উল্লাসে মেতে উঠল ফ্রান্সের তরুণরা। বৃষ্টিতে আতশবাজির ডিসপ্লে তেমন ফুটল না, কিন্তু ভেজা মাঠে আনন্দ যেন বহুগুণে বেড়ে গেল শিরোপাজয়ীদের।
টানা তিনটি বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন বিদায় নিয়েছে গ্রুপ পর্ব থেকে। তরুণ এই ফরাসি দলের সামনে চার বছর পর কাতার বিশ্বকাপে বড় সম্ভাবনার পাশাপাশি থাকল তাই চ্যালেঞ্জও।

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!