সংক্ষিপ্ত পরিচিতি: কবি ও সমালোচক আবু সুফিয়ান খান মৃন্ময় পৃথিবীর স্পর্শ লাভ করেন ১৪ মে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর মূল শেকড় ফরিদপুর জেলার ফরিদপুর সদর উপজেলার কমলাপুর গ্রাম। বর্তমানে হোসেন মঞ্জিল, ৪২/১-এ, লালবাগ, ঢাকায় তাঁহার বসবাস।
তিনি জনক মোঃ শরাফত আলী খান ও জননী মোছা: নুরজাহান বেগমের সন্তান। সাংসারিক জীবনে সহধর্মিণী রোকেয়া সুলতানা এবং দুই মেয়ে সোফিয়া খান তুলতুল ও মুন মুন খান তাঁহার সন্তান। মেয়ে দু’জনই উচ্চ শিক্ষিত (বিবাহিত)।
কবি আবু সুফিয়ান খান একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। পেশাগত জীবনে ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন ও পরবর্তীতে ব্যবস্যা করেন।
কৈশোর থেকেই তিনি কবিতা লিখছেন এবং দেশের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় তাঁর লেখা ছাপা হয়ে আসছে। এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ – হৃদ্য (১৯৮০), কবিতায় স্বদেশ দেখি (যৌথ), আশির দশকের কবিতা (যৌথ) ও লুট (১৯৯২)। এছাড়াও তাঁর অনেকগুলো পাণ্ডুলিপি প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।
লেখালেখির পাশাপাশি একজন সমাজকর্মী ও দক্ষ সংগঠক কবি আবু সুফিয়ান খান – কমলাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও উচ্চ বিদ্যালয় , শেখ শাহাবুদ্দীন প্রাথমিক বিদ্যালয়, এবং কমলাপুর পূবালী ক্লাব প্রতিষ্ঠিত করণের উদ্যোক্তা ছিলেন। সাহিত্য জগতে তিনি ফরিদপুর সাহিত্য ও সংস্কৃতি উন্নয়ন সংস্থার সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে একাধারে ২০ বছর, ঢাকা সূফি মোতাহার হোসেন সাহিত্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা অগ্নিবীণা সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য এবং ছড়া সংসদের উপদেষ্ঠা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
কবি আবু সুফিয়ান খান এর কবিতাঃ
কঞ্জুস
ঢেউ খেলা ফুল বাগে প্রভাত গঙ্গা বয়ে চলে
আঙ্গুল ডগা ছুঁলে আরক্তে নীলজবা হয়
কানধরে টান দিয়ে দুষ্টু মৌপবনী ভোর
রূপের ঠোঙ্গা ছিঁড়ে তার গরব সামলে রাখে
অতি কষ্টে নাগালে তিলক-ডুমুড়-তাল-বেল
ধরা-ছোঁয়ার বাইরে কঙ্কণা রাতুলী কাঁচুল।
ভয়ে ভৃঙ্গ কুঁচকে পাখির পালক ঝরে যায়
গোলাপী পরাগরেণু আকাশ মুখে ছড়ায়ে পড়ে
গা পেতে দেই মাখবো ইশারায় বলে না না যাও
বীজাধারে জমা মধু বুক ফাটা বৃষ্টির ফোঁটা
গাল বেয়ে পড়ে যায় ভালোবাসা দেয়না আর্থে
সন্ধ্যায় ঝরে যায় কুক্ষিতে পড়ে থাকে বোঁটা।
মাধবীলতা শুঁকায় উঁচুকরে শিরমূল প্রণয় না সিঞ্চনে
কঞ্জুস প্রেমাদ্রী পঞ্চরসে মরণ মদনকাঁটা দংশনে।
অন্ধকারের চিৎকার
মাটির ঘন গভীর অন্ধকারে বীজের অঙ্কুরোদ্গম হয়
মানুষের ভ্রূণ ফোটে সুনিবিড় রক্ততামস পদ্মযৌনে।
জন্মের জন্য চাই লোলায়িত আঁধার ঘেরা ভেজা ভূমিন
ঘুম থেকে জাগে সব
আঁধার থেকে জাগে।
জন্মের জন্য নয়—
বাঁচার জন্য আলোর প্রয়োজন
আলো তাহলে কী মৃত্যুর কারণ?
মেদিনী জঠরে
মাতৃ পদ্মগহরে
জন্ম উৎসারে এক মায়াদ্র অন্ধকারে।
সূর্য মুছে গেলে পৃথিবী থেকে
আঁধারে থাকে না কোনো প্রভুত্বের লড়াই
আলোতে এসেই দেয় জন্মের চীৎকার
অহংকারে লাফিয়ে ওঠে ক্ষমতা বিস্তারে
মাথা প্রলম্বিত কোরে আকাশটা ফাঁড়ে।
মানুষ আল্লাই জাত
মাটির মানুষকে তাই জ্বীন ফেরেস্তা সেদা করে
মানুষ সেই ধৃষ্টতায় প্রতিবাদী হয়
জগৎ ঘুরে দেখো সবে পৃথিরী শাসন করে।
অহংকারে মানুষেরা আজ ডুবছে তিমিরে
শশীকলা ভুলে গেছে মানবতার দ্বারে
অস্তিত্বের লড়াইয়ে ব্যাস্ত অস্ত্রের চিৎকারে।
পৃথিরীর জন্ম ছিলো নিকষ আঁধারে
সূর্য দেহ ভরা আলো ঘর্ষণের কণা
ঘর্ষণ ঘর্ষণ ছাড়া আলো জন্মে না
বারুদও জ্বলে নাকো ইস্পাতে পাথরে
বিপ্লব জন্মে সেই পুড়ে যাওয়া হৃদয়ে
সেখানেও অন্ধকার
বিপ্লবী অন্ধকারের চিৎকার।
অন্ধের কন্যা দর্শন
আজানু লম্বিত চুল দুই হাতে বিলি দিয়ে দেখে
সীমন্তিনী কন্যাকে —
কুঞ্চিত আঙ্গুলে ছুঁয়ে অনুভবে গ্রীবা গণ্ডি মুখ
নাসিকার কোমলতা করণের বক্রিম কারুকাজ
ওষ্ঠাধর জোড়ভুরু ঢালবাহী হস্তপ্রান্ত মূল
পরশে পরশে পিতা শ্বাস ফেলে বুক টান করে
ধীরে ধীরে বুকে নিয়ে জড়িয়ে বলে- মা, তুই মা-আ।
আমার নিকট তুই লজ্জাটা পাসনে- লজ্জা পাসনে
তোর মাও এই মতো ছিলো শোন- শোন- শোন মা তুই
বুকের ভেতর টেনে আদরে বলে, কিছুই লুকোবি না
তোর মারও যা ছিলো, তোর তাই তাই আছে আমি চিনি
আজ থেকে অসংকোচে প্রকাশ করবি সব প্রয়োজন
আমি তোর সেই পিতা যে জানে জন্মের সব দর্শন।
বিমূর্তি
কাপড় আলগে দেখো জগৎ সেরা শিল্পকর্ম সৌম্য মূর্তিমান
জলচোখে দাঁড়ানো সে গন্ধম পঙ্কিল লাজে সমুন্নত শিরে
উর্বর বীর্যকান্তিতে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে পুষ্পজঙ্ঘায়
জন্ম থেকে জন্মস্থূল সুরঙ্গ পথে প্রত্যহ চলে উর্ধাক্ষে
কালান্তর থেকে কালে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে অহর্নিশ
বদলে যায় না দম হাওয়া বদলায় না বিমূর্ত আকার
সুদীর্ঘ মহাকালের পথে বদলেছে সব মানুষের শৈলীপনা
শুভ্র তাজমহল দেখো, দেখো নাই কামাদ্রীত মমতাজের মমতা
— যার রূপ রতিকাম সৌন্দর্য সৌকর্যে
সম্রাট শাজাহান অলিন্দে শিল্পীত করে কালজয়ী নকশাটি
— পৃথিরীর সেরা কারু শিল্পকর্ম।
সৃজন গন্ধম হয়ে আদমে লুকায় গিয়ে হাওয়ার পদ্মযোনি মণিকোঠায়
বিশ্বের সেরা আশ্চর্য ভালোবাসা বিনিময় ঠায় কথা কয় কথা কয়
মানুষ সেই ভাস্কর্য শিল্প অণ্ডবীজে জন্মে চির উর্বর চির বীর্যোপহার
এর চেয়ে সেরা কিছু বিমূর্তি আশ্চর্য নাই কিছু নাই তাবৎ ব্রহ্মাণ্ড পাথার।
জন্ম-মৃত্যু খেলা
নর্দমার মুখে জল ঠেকালে
বৃষ্টি এসে ভাসিয়ে দিলো।
লাভ কী হলো?
জন্মের আগেই মৃত্যুকল্পনা
দীঘিতে পদ্ম ফুটল।
পরাগ কী ধুয়ে গেলো?
সাপের মুখে জন্মনিরোধক
আশীবিষ বিষ ঢাললো।
জন্ম না-কী মৃত্যু হলো?
প্রবেশ দ্বারে আগল রাখা
আঘাত করে শাবল।
আগল কী ভাঙলো?
ভাঙলো বাঁধ মরলো সাপ
খুললো প্রবেশ দ্বার
নাভির নিচে জোর ছিলো।
ভাত
ক্ষুধা পেটে ভাতের গন্ধ
শাপলা ফুলের বাস
উনুন পরে ফুটছে চাউল
গরম ভাঁপ বাতাস
হরেক রকম রসনা স্বাদ
জীভ লোলে জাগে
ভর দুপুরে খাওয়ার সময়
কার-না মিষ্টি লাগে।
আচ্ছা করে খাবো এবার
থালা চেটে-পুটে
ভাতেরা সব শিউলি গাছে
অাছে ফুটে ফুটে।
তরল আগুন
হায় এ-কী হলো, ফুলের আগে পাঁপড়ি ঝরে গেল
বীজ পাবো কোথায়?
মেঘের আগে বৃষ্টি নামে চোখে
ভালোবাসার তরল আগুন দিলো উপহার
পুড়ে গেলো বাসর ঘরের সকল অলংকার।
অন্ধকারে বজ্রপাতের সারা
সবকিছু ভাঙে ঝনাৎ-ঝন
অগ্নিগিরি চেপে রেখে বুক করে দীঘল
পিঙল লাভা ছড়ায়ে পড়ে
জ্বলামুখ বিফল
ফুল হাসি মুক্ত দানা
হাত মুখ কাঁধ ভোলানা
কী দোষ করে বেগানা
ভালোবাসার ফাগ না জানা
সমতলে বাঘের থাবা পড়ে
মনের ভেতর বাঁদর নাচে
গাছের পাতা যায় ঝরে।
ফলের আশা দূরাশা বৃক্ষই বাঁচে না
ঝড় নাই তুফান নাই বন ভাঙে মড়াৎ মড়াৎ
শীরিষ শাখা কান্না করে পায়না সোহাগ হাত
প্রেমের আগে বিয়ে করে প্রতিমা ভেঙে যায়
তার না-কী প্রেম ছিলো তরল আগুন ভাঁড়
মধ্যযুগের বিয়ে এখন চড়ক গাছে ঘোরে
সন্ন্যাসী যজ্ঞ দেয় মন্ত্র আগুনে পোড়ে।
বসন্ত যৌবন
ঝোপের আড়ালে বসে
দেহের আলমারি থেকে
গোপন জায়গা হোতে
তুলে নিলো মণিমুক্তা।
ভাঁজে ভাঁজে সাজানো ছিলো
সযত্নে বাঁধানো কঠিন বাঁধনে
বিশ বসন্তে জমানো ধন
পৃথ্বীরাজের সংযুক্তা।
আবেগ আনন্দ আনমনে
ইস্পাত কঠিন তরল স্বপ্নে
মুহূর্তেই বেহাত হলো সব
কালিগঞ্জের বাগানে।
কেও বলে উৎফলন
কেও বলে গণিকা উত্তোন
কেও বলে অপার্থ ধর্ষণ
মরার কথা বলে সর্বখানে।
একটি কথা হয় না বলা
ওটা ছিলো ঝোপের মায়া
দু’জনের ছিলো আলাপন
বসন্ত যৌবনের বাড়ন।
সাধক পুরুষ
যুগল চাঁদের ঝলমলে অবিরাম কাঁপে নয়ন তারা
একখানা চাঁদ মুঠোয় পুরা একখানা ওষ্ঠকিনারা
খোলা নদীর স্রোতে ভাসে সাড়ে তিন হাত নাও
ভাটি থেকে উজান দেশে লগি বেয়ে বেয়ে যাও
নদীর দুই পাড়ে সুন্দরী বন বাঘ ভাল্লুকের বাসা
খাঁড়ি পারি দিতে লাগে কাঁটা কম্পাসের ভাষা।
তিন দিকে চর জাগা মাঝখানে স্বচ্ছ হ্রদের নীরা
ত্রিবেণীর ঘাট চিনে চিনে ওতে সোনার তরী ভীড়া
যুগেযুগে সাধক পুরুষ ডুবে ডুবে মণিমুক্তা পেলো
গুরুবিহীন শিষ্য সব অন্ধকূপে বেহাতরায়ে গেলো।
যোগী ঋষি মুনি শশী চন্দ্র কলায় কলায় অাসে
স্বর্গ-মর্ত্য শিব শংকর লোদে ঘোলায় প্রতি মাসে
মানব জনম কারো কী হতো মরে জ্যান্ত না হলে
বাহাত্তর ঘন্টা নিগুম থেকে পুনর্জনমে বিষফলে।
এক সাথে থাকি কিছুক্ষণ
কিছুক্ষণ একসাথে থাকি
এই নিরিবিলি সন্ধ্যায়
আকাশ মুখর হোক বিচিত্র রঙছোপে
নদী বইছে ধীরে বয়ে যাক
দু’জনার ছায়াটুকু মিলায়ে যায় যাক
থেমে যাক সব কোলাহল
যে শ্বাস নিলাম ভেতর সেটা যাবে না বিফল
বাতাসে উড়ছিলো দু’জনার কুন্তল
তার ঘ্রাণে মোহিত হলাম, থাকি কিছুক্ষণ।
অদূরে নামিছে সন্ধ্যা ধীরে
আসিবে না এ সন্ধ্যা ফিরে
স্পর্শের স্মৃতি ঘিরে
কাঁদিব নয়ন নীরে
শূন্য হৃদয় গেহ
দেখিবে না কেহ
কাঁদিছে পানকৌড়ি জলে
ছায়া নিয়ে তার বুকের তলে
মায়া বলে আছি আমি তোমারই অধঃস্থলে।
সময়ের গা ঘেঁষে সময় পার হলো
কেও না স্পর্শ পেলো
দু’জনারর স্পন্দনে জাগে প্রেমের টান
কুলায় ফিরে যায় সান্ধ্য পাখিরা
আঁধারে স্থির হয় শান্ত আঁখিরা
চারিধার ঘিরে ধরে যামিনী চাদরে
এই বুঝি আঙুলের কাঁটা কম্পাস মেপে দিবে
কপালের লিখন
এক সাথে থাকি কিছুক্ষণ।