রাজনীতিতে একদম শেকড় থেকে উঠে এসে যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতা দিয়ে দেশের উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছার কাহিনী দুনিয়ার অনেক দেশেই বিদ্যমান। যাকে নিয়ে আলোচনা করছি, তাঁর সাফল্য বলতে খোলা চোখে তেমন কিছু দেখা না গেলেও অনেক কিছুই করেছেন তিনি, যা তুলনাহীন। আরও অনেক কিছু করতে পারবেন বলে বিশ্বাস। সম্ভাবনার কোন কমতি ছিলো না তাঁর মধ্যে। দিগন্ত প্রসারী উজ্জ্বল প্রান্তরে পরিচর্যার অভাবে যেমন অনেক মূল্যবান গাছ বেড়ে উঠতে পারে না, তেমনি রাজনীতিতেও অনেক অমূল্য রত্ন হারিয়ে যায়, অথবা অনেক সম্ভাবনার মৃত্যু হয়।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতিতে চতুর্দিকে যেখানে দুর্নীতি, ঘুষ, চাঁদাবাজি ও অন্যায় অবিচার, সেখানে সততা নামক জিনিসটি পুঁজি করে বেঁচে থাকা মানুষ কয়জন আছে? এখন সিন্ডিকেট, ঘুষ, টেন্ডারবাজী আর পারসেন্টেজ নেয়া খুব স্বাভাবিক ব্যপার। অথচ নিজ দল ক্ষমতায় থাকাকালীন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, জেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরি কমিটির সদস্য থেকেও যাঁর পকেটে এক টাকাও নেই। বিদেশে থাকা ভাইদের দেয়া টাকায় এবং পৈত্রিক সম্পত্তির আয় থেকে তাঁর সংসার চলে। জীবনে একটানা ২৭ বছর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু প্রতিপক্ষের লোক অনেক খোঁজাখুঁজি করে এই দীর্ঘ সময়ে একটিও দূর্নীতির নজির বের করতে পারেনি। সততার জন্য পুরস্কৃত হয়েছেন বটে, মানূষের ভালোবাসাও পেয়েছেন যথেষ্ট। যার কথা বলছি, তিনি মোস্তাকুর রহমান মফুর। বালাগঞ্জের মফুর নামে দেশব্যাপী রয়েছে তাঁর ব্যাপক পরিচিতি, যাকে ‘তৃণমূল রাজনীতির কবি’ হিসেবে বর্ণনা করেন তাঁরই সতীর্থরা। যৌবনের সোনালী দিনগুলোতে তিনি টাকা পয়সা বা আখের গোছানোর পেছনে ব্যয় করেননি, বরং কাটিয়েছেন অগ্নিঝরা ভাষণে মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার কাজে। তাঁর মুখ থেকে শোনা দেশের কথা, স্বাধীনতার কথা, বঙ্গবন্ধুর কথা মানুষের কাছে কবিতার চরণের মতোই মনে হতো। তাই তিনি কবি, রাজনীতির একদম গ্রাম্য এক কবি। তাঁর বক্তব্য শোনার জন্য বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট সহচর আব্দুস সামাদ আজাদ তাঁকে লোক পাঠিয়ে ধরে নিয়ে যেতেন বিভিন্ন জনসভায়। পিতার সাথে সম্পর্কের সূত্রে তিনি অল্প বয়স থেকেই বঙ্গবীর এম এ জি ওসমানী, বঙ্গবন্ধুর সহচর দেওয়ান ফরিদ গাজী ও সামাদ আজাদ এবং কমরেড আখতার আহমদ, কমরেড আসাদ্দর আলীর মতো জাতীয় নেতাদের ঘনিষ্ট সান্নিধ্য পেয়েছেন। তাঁদের কাছ থেকে নিয়েছেন, বিশুদ্ধ রাজিনীতির পাঠ।
১৯৮১ সালে সামরিক শাসন চলাকালীন সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রী ভারত থেকে দেশে ফিরে আসেন। পিতৃহারা দু’বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সেদিন সিলেটে এসেছিলেন হযরত শাহ জালাল (র.) এর মাজার জিয়ারতের উদ্দেশ্যে। তখন আওয়ামী লীগ বলে পরিচয় দিয়ে সামনে দাঁড়ানোর মতো লোক সারা দেশের মতো সিলেটেও খুব কম ছিলেন। সেদিন শফিকুর রহমান লাল মিয়া, অহিদুল ইসলাম তোফা, আব্দুল খালিক মায়ন, ইফতেখার হোসেন শামীম এবং মোস্তাকুর রহমান মফুর এর মতো কয়েকজন যুবক নিজের প্রাণের বিনিময়ে প্রিয় নেত্রীর প্রাণ রক্ষার শপথ নিয়ে সেচ্ছাসেবক হিসেবে প্রাণপ্রিয় নেত্রীকে গার্ড দিয়েছিলেন। মাজার প্রাঙ্গনে মাত্র কয়েকজন লোকের এই বাহীনিকে প্রিয় নেত্রী সেদিন কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন – এখনও এই সিলেটে আমার বাবাকে, আমাদেরকে, আওয়ামী লীগকে তোমারা এতো ভালোবাসো? এই নিবেদিত মানুষেরাই ছিলো সেদিনের শেখ হাসিনার প্রিয়জন। আজ অনেক নেতা সৃষ্টি হয়েছেন, হাইব্রিড নেতাদের ভীড়ে এখন প্রকৃত নেতারা দিগ্বিদিক শূন্য বা অকার্যকর হয়ে পড়েছেন।
ছাত্রলীগ করতাম এখন প্রবাসে যুবলীগ করি। আফসোস করি, বঙ্গবন্ধুকে আমরা দেখিনি বলে। কিন্তু নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি যে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজিনীতির প্রকৃত ধারক একজন মোস্তাকুর রহমান মফুরকে দেখেছি। তাঁর কাছ থেকে যেমন শিখেছি, তেমনি জেনেছিও অনেক কিছু। চিনতে পেরেছি বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশকে। শত প্রতিকূল পরিবেশেও দূর্নীতির বিরুদ্ধে হিমালয়ের মতো অটল এই নেতার নেতৃত্বে রাজনীতি করেছি। কোন লোভ-লালসা, ক্ষমতার বাহাদুরি, মামলা-হামলা বা সামান্যতম দূর্নীতিকে প্রশ্রয় দিতে দেখিনি। জীবনে কোন দিন মামলার তদবীর করেননি বলে তাঁর দূর্ণাম আছে। ক্ষমতা তাঁর ছিলো, এখনও আছে। কিন্তু সিলেটের লক্ষ লক্ষ লোক জানে এবং স্বাক্ষী দেবে যে জনাব মফুর এই ক্ষমতার অপব্যবহার কোনদিন করেননি। ১৯৯৬ সালে দল ক্ষমতায় থাকার পরও আমরা মোস্তাকুর রহমান মফুরের নেতৃত্বে ক্ষমতাবান আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধ অবস্থানে ছিলাম, তখন প্রকৃত বিরুধীদল ছিলাম আমরা। ছাত্রলীগ-যুবলীগ তখন টেন্ডারবাজী, টিআর, কাবিখা এসব জিনিসে মগ্ন ছিলোনা, ছিলো শুদ্ধ রাজনীতির চর্চায় মগ্ন। এই শুদ্ধ রাজনীতির পাঠ গ্রহণ করেছি বলে আমি আজ গর্বিত।
বালাগঞ্জের প্রত্যন্ত এক গ্রামে জন্ম নেয়া আমার দেখা ‘তৃণমূল রাজনীতির কবি’ মফুর সাহেবের কথা বলতে গিয়ে প্রসঙ্গক্রমে অনেক কথাই বলে ফেলছি। তারপরও অতি সামান্যই বলতে পারবো বলেই মনে করি, কারণ তাঁর কথা স্বল্প পরিসরে বলা সম্ভব নয়। উনার পিতা মরহুম মখলিছুর রহমান সাহেব ছিলেন বালাগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে গঠিত সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক। আইয়ূব-ইয়াহইয়ার বিরুদ্ধে তথা স্বাধীনতা পূর্ব উত্তাল রাজনীতির সক্রিয় এই নেতার কাছেই মূলতঃ জনাব মফুর শুদ্ধ রাজনীতির পাঠ গ্রহণ করেন এবং সক্রিয় ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৮৩ সালে তৎকালীন বালাগঞ্জ থানা যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক হিসেবে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে দীর্ঘ ১৪ বছর দিন-রাত পরিশ্রম করে যুবলীগকে অত্র এলাকার একটি শক্তিশালী তথা অপ্রতিরোধ্য সংগঠনে পরিণত করেন। বালাগঞ্জ থানা যুবলীগ এবং জেলা যুবলীগের সফল নেতা হিসেবে সিলেটের যুব সমাজের মডেল স্বরূপ এক অবিচ্ছেদ্য নাম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত মোস্তাকুর রহমান মফুর ১৯৮৭ সালে মাত্র ২৬ বছর বয়সে বালাগঞ্জ সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং টানা ২২ বছর তিনি ৪টি নির্বাচনে একাধারে নির্বাচিত হন। মানুষের ভালোবাসা তাঁর প্রতি দিন দিন কীভাবে বেড়েছে এর নজির পাওয়া যায় তাঁর নির্বাচনের ধারাবাহিক বিজয়ের চিত্র দেখে, প্রতিটি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সাথে তাঁর ভোটের ব্যবধান বেড়েছে। উল্লেখ্য যে, প্রথম নির্বাচনে মাত্র ৯৮ ভোটের স্বল্প ব্যবধানে তিনি বিজয়ী হন এবং শেষ ইউনিয়ন নির্বাচনে (২০০৩ সালে) ব্যবধান দাঁড়ায় প্রায় ২৬০০ ভোট। ১৯৯৬ সালে তিনি সিলেট জেলার শ্রেষ্ঠ চেয়ারম্যান হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে স্বর্ণপদক লাভ করেন। একই সালে তৎকালীন বালাগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হন। ২০০৩ সালে বালাগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। একই সালে বাংলাদেশ ইউনিয়ন পরিষদ ফোরাম (বিইউপিএফ) এর মহাসচিব নির্বাচিত হয়ে তিনি সারা বাংলাদেশ ব্যাপী ইউপি চেয়ারম্যানদের এই সংগঠন পরিচালনায় তাঁর যোগ্যতা, দক্ষতা, মেধা ও সততার পরিচয় দেন।
উল্লেখ্য যে, আমি উনার সাথে অনেকবার ঢাকায় গিয়েছি। তখন দেখতাম মানবাধিকার সংগঠনের নেতা-নেত্রীরা তাঁর সাথে দেখা করে বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁদের মধ্যে বদিউল আলম মজুমদার, এডভোকেট সালমা আলীসহ অনেক প্রখ্যাত ব্যক্তিবর্গকে দেখেছি, সবার নাম আমার জানা নেই। ‘ইউএসএইড’ নেতৃবৃন্দসহ বিদেশী বিভিন্ন মিশনের নেতৃবৃন্দের সাথে বিইউপিএফ এবং স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করতে দেখেছি। তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এর প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্থানীয় সরকারের বেশ কিছু প্রশিক্ষণ কর্মশালা, সেমিনার ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করেন। তন্মধ্যে ইন্দোনেশিয়া, ভারত, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাজ্য অন্যতম।
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার বিষয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা, সততা ও যোগ্যতার মূল্য সারা দেশের ও অন্যান্য দেশের মানুষ করলেও বিগত ২০১৪ সালের উপজেলা নির্বাচনে তাঁর পরাজয় হয় নিজ দলীয় কিছু নেতার কারণে। ২০০৯ সালের উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী হিসেবে জনাব মোস্তাকুর রহমান মফুর প্রায় ৩০ হাজারেরও অধিক ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হন। যদিও তখন নিজ দলের বিদ্রোহী একজন প্রার্থী ছিলেন এবং ঐ প্রার্থীর পেছনে দলের অনেক নেতা গোপনে কাজ করে ছিলেন । ঐ বিদ্রোহী প্রার্থী প্রায় ৯০০০ ভোট পেয়েছিলেন তারপরও জনাব মফুর রেকর্ড সংখ্যক ভোটের ব্যবধানে পাশ করেন। কিন্তু তাঁর ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও জনভিত্তিই তাঁর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। বিধায় ২০১৪ এর নির্বাচনে জেলা এবং থানার অনেক নেতা সেদিন প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে সিঁদ কেটে নিজ ঘরে নিয়ে আসেন অন্য দলের লোক। হাজার হাজার লোক সেদিন মফুর ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে কেঁদেছে। নির্বাচনে পরাজিত কারও জন্য এত মানুষের কান্না আগে কোথাও দেখিনি বা শোনিনি। কিন্তু সেদিন আমাদেরই অনেক নেতা মফুর ভাইকে একনজর দেখতে যাননি। আমি কাউকে অপবাদ দেয়ার জন্য লিখছি না। রাজনীতির চোরাগলিতে অনেক অঘটন ঘটে, আমরা সময়ের পরিক্রমায় অনেক কলঙ্কময় সত্যকে মেনে নেই। যা সচরাচর মেনে নেয়ার বা ভুলে যাওয়ার কথা নয়।
১৯৯২ সাল থেকে আমি সক্রিয় রাজনীতি করি। আমাদের রাজনীতি মফুর ভাইয়ের হাত ধরে শুরু হয়েছে বলে তাঁর পক্ষ নিয়ে লিখছি, এমনটা অনেকেই ভাবতে পারেন। কিন্তু আমি যদি অতিরঞ্জিত কিছু বলি, তাহলে যে কেউই আমাকে কৈফিয়ত করতে পারেন। আমি শুধু আমার বিবেকের দংশন থেকে এখানে সামান্য কয়েকটি কথা লিখলাম। লেখা লম্বা হবে বলে অনেক কিছু লিখিনি। সুদীর্ঘ চলার পথে সহস্র কথা আছে, সহস্র ঘটনা আছে লেখার মতো। কিন্তু কথা বাড়াবো না। শুধু বলতে চাই, আমার প্রিয় স্বদেশ এবং আমার নাড়িপোতা মাটি বালাগঞ্জ যেন এমন একজন সৎ, যোগ্য, পরীক্ষিত, প্রশিক্ষিত এবং পরিশুদ্ধ মানুষকে তাঁর উপযুক্ত সম্মান দেয়। আমাদের সম্মানিত নেতৃবৃন্দ যেন এই আলোকিত মানুষকে মূল্যায়ণ করেন। সত্যিকার অর্থে গণমানুষের রাজনীতি যিনি করেন, হাজার হাজার ছাত্রলীগ-যুবলীগ তৈরির কারিগর, ‘তৃণমূল রাজনীতির কবি’ প্রিয় এই নেতার জন্য আমাদের আজ হয়তো কিছুই করার নেই। তাঁর জন্য শুধু করতে পারি নিরন্তর শুভ কামনা। দৃঢ়তার সাথে শুধু আজ বলতে পারি, রাজনীতির দূর্বৃত্তায়ণের এই যুগে মোস্তাকুর রহমান মফুর সুবিধাভোগীদের কাছে মূল্যহীন হলেও উনার স্থান আমাদের মতো হাজার হাজার যুবকের হৃদয়ের মণিকোঠায় চির ভাস্বর থাকবে।
লেখক : সাবেক সভাপতি
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, বালাগঞ্জ উপজেলা শাখা।