আজ ২০মে গালিম পুর গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা কার্যক্রম অপারেশন সার্চলাইটের অধীনে ২৬মার্চ থেকে পূর্ব-পরিকল্পিতভাবে পরিচালিত হয়েছিল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের স্বাধিকারের দাবিকে চিরতরে নির্মূল করতে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এ কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সংঘটিত ঘটনাসমূহ গণহত্যা হিসেবে পরিচিতি পায়। আর এমন নির্মম পৈশাচিক হত্যাকান্ডের ঘটনা থেকে বাদ যায়নি বালাগঞ্জের গালিমপুর ও। ১৯৭১ সালের ২০মে পাক-হনাদার বাহিনীর এমন পৈশাচিক হত্যাকান্ড আজ ও কাঁদায় গালিমপুর তথা বালাগঞ্জবাসীকে। পৈশাচিক হত্যাকান্ডের স্বীকার স্বজন হারানোর পরিবাররা আজও কান্নায় ব্যাকুল হয়ে উঠেন।
স্বজন হারানো এসব পরিবারের সাথে রক্তঝরা ৭১’এর ২০মে বালাগঞ্জের ভাটেরা-গালিমপুর গণহত্যায় অনেকের মতো কানাই লাল চক্রবর্তী ও হারিয়েছিলেন তাঁর পিতা অশ্বিনী চক্রবর্তীকে।
তিন বোন, দুই ভাই আর মা-বাবাকে নিয়ে ছিলো কানাই বাবুদের সংসার। পিতা অশ্বিনী চক্রবর্তী ছিলেন পুরোহিত। পৌরহিত্য করে যা আয় হতো তা দিয়েই চলতো পরিবারের ভরণ-পোষণ। অশ্বিনী বাবু পুত্র জায়াকে ভালোবাসতেন খুব। মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয় কানাই বাবু তখন এসএসসি পরীক্ষার্থী। এপ্রিলে যখন পাকবাহিনী শেরপুরে বোমা হামলা চালায় তখন অনেকেই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যেতে চাইলে অশ্বিনী বাবু আপত্তি জানান। কুশিয়ারার এতো পানি ডিঙিয়ে ভাটেরা গালিমপুরে পাকবাহিনী আসতে পারে তা ছিলো তার ভাবনাতীত।
কানাই লাল চক্রবর্তী বলেন, ১৯৭১সালের ১৫ মে ধান কাটাকে কেন্দ্র করে ভাটেরা-গালিমপুর আর বল্লভপুর গ্রামবাসীর মধ্যে ঝগড়া হয়। ঝগড়াকে কেন্দ্র করে বল্লভপুরের কয়েকজনের মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া হয়। ওই ছেলেরা প্রতিশোধ নিতে চকেরবাজার শান্তি বাহিনীর ক্যাম্পে নালিশ জানায়। তারা অভিযোগ করে ভাটেরা-গালিমপুরে মুজিব বাহিনীর অনেক কর্মী লুকিয়ে আছে। ১৬মে ভাটেরা গালিমপুরে খবর আসে ধান কাটা নিয়ে যে সালিশ হয়েছে এতে পাকবাহিনী নাখোশ। তারা গ্রামে আসতে চায়। এতে নিরুপায় হয়ে এলাকার লোকজন স্থানীয় দালাল মদরিছ আলীর শরণাপন্ন হন। মদরিছ আলী জানান, ৫হাজার দিতে পারলে পাকবাহিনী গ্রামে ঢুকবে না এবং গ্রামবাসীতে শান্তি কার্ড দেওয়া হবে। ১৮মে সকালে এলাকার লোকজন টাকার বিনিময়ে সাদিপুর শান্তি বাহিনীর ক্যাম্প থেকে শান্তি কার্ড সংগ্রহ করে। কার্ড পেয়ে গ্রামের লোকজনের আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে। কিন্তু সেটা তেমন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কানাই বাবু অনেকটা সময় থম ধরে বসে থাকেন। আবার বলা শুরু করেন, ২০মে সকাল তখন ঘড়িতে সোয়া এগারোটার কাছাকাছি। কানাই বাবুর মা রান্না ঘরে ভাত রাঁধতে ব্যস্ত। এমন সময় খবর এলো খোকা দাসের বাড়ির পাশে নৌকা লাগিয়ে পাকবাহিনী গ্রামে ঢুকেছে। যে যেদিকে পারে পালাচ্ছে। আমাদের রান্না হয়ে আসা ভাত চুলোয় পড়ে থাকলো। পরিবারের সবাই লুকিয়ে পড়েন স্থানীয় সুধাংশু দাসের বাড়ি পেছনের জঙ্গলে। আমি কুশিয়ারা নদীর সামনে গিয়ে পাক সেনাদের দেখে গ্রামের পার্শ্ববর্তী ভৈরবতলীর পাশের একটি বড় গর্তে ঢুকে পড়ি। সে গর্তে আগ থেকেই নারী-পুরুষ-শিশুসহ অসংখ্য ভয়ার্ত মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন। এক সময় পাক সেনারা ভৈরব মূর্তিতে গুলি করলে প্রায় সাড়ে তিন ফুট উচু মূর্তি বিকট শব্দে ভেঙ্গে পড়ে। এতে ভয় পেয়ে গর্তে লুকিয়ে থাকা শিশুরা কান্না জুড়ে দেয়। এ সময় কান্না বন্ধ করতে অনেক মা তার সন্তানের মুখে কাপড় গুজে দেন। এরপর চারদিক থেকে শুধু গুলির শব্দ আর আগুনের ধোঁয়া দেখা যাচ্ছিলো। প্রকৃতপক্ষে কি ঘটছে তা গর্তের ভেতর থেকে অনুমান করা কঠিন। বিকাল প্রায় ৫টার দিকে গুলির শব্দ কমে এলে আমি গর্ত থেকে বের হয়ে কুশিয়ারা নদী সাতরে ওপারে চলে যাই। সন্ধ্যা ৬টার দিকে পাকবাহিনী চলে গেলে আমি আবারো নদী পাড়ি দিয়ে ভাটেরা গালিমপুরে জানতে পারি বাবা মারা গেছেন। পাকবাহিনী স্থানীয় গুনমনি দাসকে ধাওয়া করে জঙ্গলে ঢুকে এলোমেলো গুলি ছুঁড়ে। ওই জঙ্গলে আমার বাবাসহ আরো অনেকেই ছিলেন।’
কিছুটা সময় নিয়ে আবারো থেমে থেমে কানাই লাল চক্রবর্তী বলেন, সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় আমি ওই দিন বাবার লাশ উন্মুক্ত ফেলে রেখে মা ও ভাই-বোনদের নৌকাযোগে কুশিয়ারা নদীর ওপারে এক আত্মীয় বাড়িতে এনে রাখি। পরের দিন সকালে আবার ঘটনাস্থলে এসে দাহ করা বিপজ্জনক ভেবে বাবুল নামের এক ব্যক্তির সহায়তায় বাবার লাশ কুশিয়ারা নদীতে ভাসিয়ে দেই। বাবার লাশ বাসী হবার কারণে ফুলে গিয়েছিলো। কুশিয়ারা নদীর স্রোতে লাশ ভেসে যাচ্ছে-এ দৃশ্যটা একবার দেখে আর পিছু ফিরে তাকাইনি।
কষ্টের স্মৃতি আর কান্নাকে সঙ্গী করে হাঁটতে থাকি। উপলব্দি করি করুণ বাস্তবতা। আগের দিন এমন সময় আমরা ভাত খাওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম। অথচ এখন প্রাণহীন একটা দেহকে ভাসালাম। এমন কঠিন নিষ্ঠুর বাস্তবতার কথা বলতে বলতে নিজের মুখটা দু-হাতে ঢেকে পিতৃশোকের কষ্টটা আড়াল করতে চাইলেন কানাই লাল চক্রবর্তী। রক্তঝরা ৭১’এর ২০মে বালাগঞ্জের ভাটেরা-গালিমপুর গণহত্যায় অনেকের মতো তাঁর পিতা অশ্বিনী চক্রবর্তীকে হারানোর এমন নির্মম গল্প শুনতে শুনতে এই প্রতিবেদকের ও চোখের কোণে বেদনার অশ্রু এসে জমা হয়েছিল অজান্তে। পিতা-পুত্রের চিরস্থায়ী বন্ধনের প্রতি এখনো কানাই লাল টান অনুভব করেন। আর তাই জীবনের শেষ অধ্যায়ে এসেও শহীদ পিতার কথা বলতে গিয়ে চোখের পানি আড়াল করতে পারেন না কিছুতেই।