সিলেট বিভাগের ঐতিহ্যবাহী দুটি উপজেলা বালাগঞ্জ ও রাজনগর। কুশিয়ারা নদীর তীরবর্তী এ দুই উপজেলার মানুষের মধ্যে রয়েছে শক্ত সামাজিক বন্ধন। কিন্তু এই বন্ধনটি আরো শক্তিশালী হতে পারতো এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে ও নতুন দ্বার উন্মোচিত হতো, যদি কুশিয়ারা নদীর উপর একটি সেতু নির্মিত হতো। এই একটি সেতুর অভাবে এই দুই উপজেলার মানুষ বিভিন্ন খাতে অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও তা কাজে লাগাতে পারছে না, এমনকি যাতায়াত ব্যবস্থায়ও নিত্য চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, এই একটি সেতুর অভাবে যুগের পর যুগ দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন রাজনগর ও বালাগঞ্জ উপজেলার প্রায় ১০ লাখ মানুষ। রাজনগরের কুশিয়ারা তীরবর্তী এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো দূরবর্তী হওয়ায় স্কুলগামী কোমলমতি শিক্ষার্থীরা কুশিয়ারা নদী পার হয়ে বালাগঞ্জের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়া-আসা করছে। বিভিন্ন সময় নৌকাডুবির মত মারাত্মক দুর্ঘটনাও ঘটছে। তাই অবহেলিত এ অঞ্চলের লোকজনের দাবি কুশিয়ারা নদীর উপর একটি সেতু। যে সেতুটি নির্মাণ হলে শুধু রাজনগর-বালাগঞ্জ নয় পার্শ্ববর্তী ফেঞ্চুগঞ্জ ও ওসমানীনগর উপজেলার মানুষও উপকৃত হবেন। এসব অঞ্চলের মানুষ সিলেট মৌলভীবাজার সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সাথে সহজে যোগাযোগ করতে পারবে। ব্যবসা-বাণিজ্যে ও নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে এই এলাকায়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, তৎকালীন বৃটিশ আমলে বাংলাদেশের নৌবন্দর গুলোর অন্যতম ছিল কুশিয়ারা ও কাউয়াদীঘি হাওর তীরবর্তী রাজনগর-বালাগঞ্জের মধ্যবর্তী বিলবাড়ি। বৃহত্তর সিলেটের ব্যবসা-বাণিজ্যের একমাত্র নৌবন্দর হিসেবে এর খ্যাতি রয়েছে দেশে-বিদেশে। দেশী-বিদেশী ব্যবসায়ীদের পদচারণায় দিন রাত মুখরিত থাকতো এ অঞ্চল। সে সময় রাস্থা-ঘাট ততটা উন্নত না থাকার কারণে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল নদী পথের লঞ্চ, ষ্টিমার ও ইঞ্জিনের নৌকা। তৎকালীন বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা কুশিয়ারা নদী তীরের এ বন্দর থেকে বিভিন্ন দ্রব্য সংগ্রহ করে ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। সে সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের পণ্য সংগ্রহের এক মাত্র কেন্দ্রই ছিল কুশিয়ারা-কাউয়াদীঘি হাওর তীরবর্তী রাজনগর-বালাগঞ্জ মধ্যবর্তী বিলবাড়ি অঞ্চল। কালের বিবর্তনে এবং দেশের স্থলপথের অভুতপূর্ণ উন্নয়ন হলেও এ অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসা-বাণিজ্য সহ সকল ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে। বছরের পর বছর চরম অবহেলিত এ অঞ্চলের হাজার হাজার পেশাজীবি মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন নৌকা যুগে কুশিয়ারা পার হয়ে তাদের জীবন জীবিকা নির্বাহ করছেন।
জানা যায়, এ অঞ্চলের মানুষের দাবির যথার্থতা বিবেচনা করে ২০১৪ সালে সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী মরহুম সৈয়দ মহসিন আলী সেতুর ব্যবস্থা হবার আগ পর্যন্ত ফেরি চলাচলের প্রতিশ্রুতি দিলেও সরকার তা আজ পর্যন্ত বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
সংশ্লিষ্ট বিভাগ সূত্রে জানাযায়, উভয় তীরের মানুষের দাবির প্রেক্ষিতে বিগত ২০১৩ সালের প্রথম দিকে কুশিয়ারা নদী তীরবর্তী বিলবাড়ি অঞ্চলে একটি ব্রীজ নির্মানের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য পরিদর্শনে এসেছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের প্রকৌশলী অধ্যাপক সুজিত কুমার বালা ও অধ্যাপক তারেকুল ইসলাম। তারা ব্রীজ নির্মানের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য কুশিয়ারা তীরবর্তী বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করে তাদের পরিদর্শন রিপোর্টটি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট পেশ করেন। পরিদর্শনের সময় তাদের সাথে ছিলেন বিশ্বনাথ-বালাগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুর রহমান, রাজনগর-মৌলভীবাজারের তৎকালীন সংসদ সদস্য ও সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী মরহুম সৈয়দ মহসিন আলীর প্রতিনিধি সৈয়দ মোস্তাক আলী, বালাগঞ্জ উপজেলার বর্তমান চেয়ারম্যান মোস্তাকুর রহমান মফুর, রাজনগর উপজেলার তৎকালীন প্রকৌশলী রুবাইয়াত জামান, বালাগঞ্জ উপজেলার তৎকালীন প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান সহ উভয় এলাকার বিভিন্ন স্তরের নেতৃবৃন্দ।
উল্লেখ্য যে, তৎকালীন সমাজকল্যাণ মন্ত্রী মরহুম সৈয়দ মহসিন আলী মন্ত্রী হবার পর গত ২০১৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারী রাজনগরে তাকে দেয়া এক সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে এলাকার মানুষের দাবির প্রেক্ষিতে তিনি ঘোষণা করেছিলেন তিন মাসের মধ্যে রাজনগর-বালাগঞ্জ সড়কে কুশিয়ারা নদীর উপর ফেরির ব্যবস্থা করা হবে এবং তিন বছরের মধ্যে ব্রীজের ব্যবস্থা করা হবে।
কিন্তু ঘোষণার প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও সরকার আজ অবদি ফেরি কিংবা ব্রীজের ব্যবস্থা করতে পারেনি। এছাড়াও বিগত ২০১৫ সালের ২৫মে রাজনগরে এক অনুষ্ঠানে কুশিয়ারা ব্রীজের নির্মাণ কাজ শীঘ্রই শুরু হবে বলে তৎকালীন সমাজকল্যাণ মন্ত্রী মরহুম সৈয়দ মহসিন আলী পূণরায় ঘোষণা দিলেও তার অকাল মৃত্যুতে ব্রীজটি বাস্তবায়নের মহৎ উদ্যোগ ব্যাহত হয়েছে বলে এলাবাসী মনে করছেন। তারা মনে করছেন সৈয়দ মহসিন আলী বেঁচে থাকলে হয়তো রাজনগরবাসীর এ স্বপ্ন এতদিনে বাস্থবায়িত হয়ে যেত। ওই সময় ব্রীজটি নিমার্ণের ব্যাপারে রাজনগর উপজেলার সাবেক প্রকৌশলী রুবাইয়াত জামান জানিয়েছিলেন, রাজনগর-বালাগঞ্জ রাস্থায় কুশিয়ারা ব্রীজের জরিপ কাজ শেষে ৪২ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছিল এবং ওই সময়ে তা একনেক সভার এজেন্ডাভূক্ত ছিল। একনেকে প্রস্তাবিত প্রকল্প অনুমোদন সাপেক্ষে যথাযত প্রক্রিয়া শেষে রাজনগর এলজিইডি বিভাগের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন হবার কথা।
এ ব্যাপারে বালাগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান মোস্তাকুর রহমান মফুর জানান, রাজনগর-বালাগঞ্জ রাস্থায় কুশিয়ারা নদীর উপর ব্রীজ নির্মাণের জন্য আমি নিজেও কাজ করছি। কুশিয়ারা নদীর উপর শুধুমাত্র একটি ব্রীজ অবহেলিত এ অঞ্চলের প্রায় ১০ লাখ মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, আর্থিক উন্নয়ন সহ সর্বক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন সৃষ্ঠি করবে। তিনি বলেন, অবহেলিত এ জনপদের মানুষের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে যত দ্রুত সম্ভব কুশিয়ারা নদীর উপর একটি ব্রীজ নির্মাণ করা প্রয়োজন।
রাজনগর উপজেলা চেয়ারম্যান শাজাহান খান বলেন, গুরুত্বপূর্ণ ভৌগলিক এলাকায় দুটি উপজেলা/জেলা পাশাপাশি। কুশিয়ারা নদীতে একটি ব্রীজ বদলে দিতে পারে উভয় এলাকার কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা-বাণিজ্য সহ সার্বিক অর্থনীতিকে। তাই যত দ্রুত সম্ভব এ ব্রীজটি বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
এ ব্যাপারে মৌলভীবাজার-৩ আসনের সংসদ সদস্য নেছার আহমদ বলেন, রাজনগর-বালাগঞ্জ সড়কে কুশিয়ারা নদীতে একটি ব্রীজ নির্মাণ অতি প্রয়োজন। এর প্রক্রিয়াটি কোন পর্যায়ে রয়েছে তা জেনে দুটি উপজেলার লাখো মানুষের স্বপ্ন পূরণে আমার সর্বোচ্চ প্রচেষ্ঠা অব্যাহত থাকবে।
এই দুই উপজেলার মানুষ তাই এক অজানা আশার প্রহর গুণছেন। তাঁরা আদৌ জানেন না কবে পূরণ হবে দুই উপজেলার লাখো মানুষের স্বপ্নের সেতু ‘কুশিয়ারা সেতু’।