সোমবার, ৭ অক্টোবর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২২ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রাজনীতির সময়-অসময় : বর্তমান কাল (পর্ব-২)



লেখক

মুক্তিযুদ্ধ উত্তরকালে আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, জেঁকে বসা মিলিটারি শাসন-স্বৈরশাসন, তার বিরুদ্ধে গণআন্দোলন, গণতন্ত্রের ফসল তুলতে ব্যর্থতা ও মৌলবাদ বিরোধী ক্রমাগত লড়াই মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে বেড়ে ওঠা প্রজন্মের জীবনিশক্তি প্রায় নিঃশেষ করে ফেলে এবং তারা হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েন। তাই কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের সমাজ-রাষ্ট্র গড়ে তুলতে মননশীলতা ও আত্মশক্তি নিয়োজিত করতে সর্বশক্তি প্রয়োগের মানসিক সামর্থ্য তলানিতে চলে যায়।

ব্যক্তি জীবনের অবহেলায় সৃষ্ট সংকট মোকাবিলা ও বাস্তব রাজনৈতিক অবস্থার জটিল আবহ কুলিয়ে রাজনীতিতে নির্ণায়ক শক্তি প্রয়োগ সম্ভবপর হয়নি; বরং অনেকেই সময়ের স্রোতে ভেসেছেন, আবার কেউ কেউ তাল মেলাতে না পেরে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গিয়েছেন।

১৯৮০-১৯৯০ সময়কালে বাংলাদেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্প্যাস ছিল সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক বিকাশের সৃজনশীল ক্ষেত্র। সামরিক শাসন-মৌলবাদী বিরোধী সংগ্রাম, গণতান্ত্রিক অধিকারহীনতার বিরুদ্ধে জ্বলন্ত তরুণদের দ্রোহী হয়ে ওঠায় দেশের গোটা শিক্ষায়তনগুলো হয়ে উঠেছিল কিউবার সিয়েরা মায়েস্ত্রা।

সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতিকে তুমুলভাবে প্রভাবিত করা সে সময়ের চেতনাকে নেতৃত্ব দিয়েছিল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদ। ছাত্রসংসদ নেতাদের নেতৃত্বে যে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তার মধ্যদিয়ে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রাধান্য তৈরী হয়েছিল। ছাত্র আন্দোলনের পথরেখায় গড়ে উঠেছিল তিন জোটের রূপরেখা এবং তারই পথ ধরে স্বৈরাচারের পতন হয়েছিল। ছাত্র আন্দোলনের ফসল তিন জোটের রূপরেখার আলোকে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার অঙ্গীকার ভেঙেছিল কারা? রাজনীতিবিদরা।

বাংলাদেশের রাজনীতির জন্যে ইতিবাচক বিকাশমান ধারা ছাত্র আন্দোলনকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করা হলো। যেখান থেকে বাংলাদেশের পরবর্তী গণতান্ত্রিক চেতনার রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরী হতে পারত সে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদ নির্বাচন বন্ধ করে দিয়ে ক্যাম্পাসগুলোতে গণতান্ত্রিক চর্চা, সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চাসহ সকল সৃজনশীলতার পথ পরিকল্পিতভাবে রুদ্ধ করে দিয়ে বন্ধ্যা ও কলুষিত ছাত্র রাজনীতির পথ খোলে দেয়া হয়। এটা পরিকল্পিতভাবেই করা হয়েছে এবং তা করতে দিয়ে রাজনীতিবিদরা নিজ পায়েই যে কুড়াল মেরেছেন ইতিহাস সে স্বাক্ষ্য দিয়ে যাচ্ছে।

একই পথে গিয়েছে থিয়েটার আন্দোলন, সামাজিক আন্দোলনসহ সকল নাগরীক সৃষ্টিমূখর কর্মকাণ্ড ও মুভমেন্ট। এখন সংগঠক মনে এতো যে হতাশা দেখি, যেখানে এককালের লড়াকু মানুষকে তোষামোদী হতে দেখা যায়; সব হলো বন্ধ্যা-কালের বিকার এবং সে গণবিচ্ছিন্নতার নিসঙ্গতা হতে উৎসারিত। ক্রমশ……

রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সৃজনশীল ক্রিয়াকলাপ অনুপস্থিতির কারণে অন্ধ আনুগত্যবাদী অরাজনৈতিক ক্রিয়াকর্ম বেড়ে চলেছে। যার ফলে সৎ কর্মীদের কর্মকাণ্ড আড়াল পড়ে যাচ্ছে। তারই সুযোগে বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে ও এক্টিভিটিতে ‘fifth forces’ আনাগোনা বেড়েছে, যাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ‘রাজনৈতিক ক্ষমতা’ পরিসরে একসেস তৈরী করা। তা করতে গিয়ে ক্ষমতা কেন্দ্রের মনমতো রাজনৈতিক ইতিহাস বয়ান হাজির করছে। সুযোগ সময়ের পরিবর্তন এলে তারা তাদের ‘নেসেসারী অবজেক্ট’ স্বার্থে ‘কালার’ পরিবর্তন করে নেয়।

এসব কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক মনস্তত্ত্বে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করবে এবং ‘উপনিবেসিক আলোকায়ন’ প্রক্রিয়ায় দাসত্বের সংস্কৃতি শক্তিশালী হবে জনসমাজের ঐতিহাসিক বিকাশকে ব্যাহত করে। ব্যক্তি হিসেবে তারা সমাজ স্তরে নগণ্য ও ঐতিহ্যিক শিকড়হীন হলেও বিভ্রান্তবর্গ ও এজেন্টবর্গের সামষ্টিক ‘অভিযান’ নতুন প্রজন্মের মধ্যে ব্যাপক ‘সংগঠিত/organised’ লিটারিলি বিভ্রান্তি সৃষ্টির ব্যাপক ঝুঁকি তৈরী করছে।

গণতান্ত্রিক রাজনীতি-সংস্কৃতির ভিত্তিতে আঘাত হানার মধ্যদিয়ে পুঁজিবাদী প্রক্রিয়ার প্রতিক্রিয়ার শক্তিকে শক্তিশালী করার আয়োজন চলছে। ফেনাটিক অর্গানাইজেশনগুলোর তত্ত্বায়ন যে ভয়ের সম্ভাবনা সৃষ্টি করে, এইসব ‘বিকৃত ও উদ্দেশ্যমুখীন’ তত্ত্বায়ন ও ‘এক্টিভিটি’র ঝুঁকির পরিমাণ তার থেকে কম নয়।

লেখক : রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট।

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!