শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
Sex Cams

‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে প্রতিদিন গড়ে তিনটি করে মামলা হচ্ছে’



ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এখন প্রতিদিন গড়ে তিনটি করে মামলা হচ্ছে। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রগুলো বলছে, গত বছরের তুলনায় চলতি বছর এই মামলার সংখ্যা ৬০ ভাগ পর্যন্ত বেশি হতে পারে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘কটূক্তিমূলক’ পোস্ট দেওয়া, পোস্ট শেয়ার করা, কার্টুন বা ব্যঙ্গাত্মক চিত্র আঁকা, ই-মেইলে যোগাযোগ করা এবং নিজেদের মধ্যে চ্যাট করার দায়ে শিশুসহ বিভিন্ন শ্রেণি, পেশা ও বয়সের মানুষ এ বছর গ্রেপ্তার হয়েছেন। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে কমপক্ষে ৩৮ জন সাংবাদিক।

পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক মো. সোহেল রানা মিডিয়াকে বলেন, মামলাগুলো হয়েছে অনলাইন বা ডিজিটাল প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করা, গুজব রটানো ও মিথ্যাচার করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি চেষ্টার মতো সাইবার অপরাধের অভিযোগে। গত বছর এই আইনে ৭৩২টি মামলায় ১ হাজার ১৩৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে ১৬৫ মামলায় ৩৩৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এই হিসাবে গড়ে প্রতিদিন প্রায় তিনটি মামলা হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশ সদর দপ্তরের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা মিডিয়াকে বলেন, এখনো পরিস্থিতি একই রকম। এই হারে মামলা হলে বছর শেষে মামলার হার গত বছরের তুলনায় ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে।

মানবাধিকার সংগঠন ও আইনজীবীরা বলছেন, মামলাগুলো হচ্ছে মূলত আইনের ২৫, ২৬, ২৯ ও ৩১ ধারায়। এই ধারাগুলোয় সরাসরি নারীদের সুরক্ষা সম্পর্কে কিছু বলা নেই। কোনো তথ্য প্রকাশ বা প্রচারের কারণে কেউ অপমানিত বা অপদস্থ বোধ করলে মামলা করতে পারবেন। রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণ্ন করা, বিভ্রান্তি ছড়ানো, জেনেশুনে মিথ্যা বলা, সম্পূর্ণ বা আংশিক বিকৃত করাও আইন অনুযায়ী এই ধারার অভিযোগ। মানহানি হলে বা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর আশঙ্কা থেকে মামলা করতে পারবেন যে কেউ। অন্য কারও তথ্য সংগ্রহ, বিক্রি, দখল, সরবরাহ ও ব্যবহারের অভিযোগেও মামলা হচ্ছে। আইনের ২৬ ধারায় এগুলোকে অপরাধ বলা হয়েছে।

কাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, কী অভিযোগ

চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দায়ের হওয়া ৫০টি মামলা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এ বছরের প্রথম ছয় মাসে জাতির পিতা, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর নামে ‘কটূক্তি’র অভিযোগে মামলা হয়েছে ছয়টি। অপরাধের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের তালিকায় আছে ময়মনসিংহের ভালুকার তারাগাঁও উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। মামলার বাদী হানিফ মোহাম্মদ নিপুণ। তাঁর অভিযোগ, মো. ইমন নামের ফেসবুক আইডি থেকে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে অশালীন ভাষায় কটূক্তি করা হয়েছে। বাদী ভালুকা থানায় করা মামলায় অভিযুক্তের বয়স লিখেছেন ২৬। যদিও পুলিশ গ্রেপ্তারের পর জানতে পারে তার বয়স ১৫। আদালতে উপস্থাপনের পর শিশুটিকে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

ভালুকা থানার উপপরিদর্শক মতিউর রহমান মামলাটির তদন্ত করছেন। তিনি মিডিয়াকে বলেন, ছেলেটি মোবাইলে ১০০ টাকা রিচার্জ করলে ২৫ টাকা কাটার সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রধানমন্ত্রীকে জড়িয়ে কটূক্তি করে। পরে ফেসবুক থেকে পোস্টটি সরিয়ে ফেলে সে ক্ষমা চায়। তার কাছ থেকে একটি সিম্ফোনি ফোন উদ্ধার করা হয়েছে। ফোনটি সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে আসলেই এমন কিছু পোস্ট করেছিল কি না, তা ওই প্রতিবেদন পাওয়ার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে। ছেলেটির বাবা পেশায় কৃষক।

বিএনপি নেতাদের সমন্বয়ে কল্পিত মন্ত্রিসভার ছবি পোস্ট করায় মামলা হয়েছে পঞ্চগড়ে। সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অনুমতি না নিয়ে ইউটিউব চ্যানেলে খবর প্রচারের অভিযোগেও মামলা হয়েছে।

করোনাকালীন মামলা হয়েছে ত্রাণ বিতরণ ও চিকিৎসার ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলা, লকডাউনের মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠানের বাস চলা ও ও কৃষকের মাঠ নেমে কাঁচা ধান কাটার ছবি তুলে শেয়ার করার জন্য। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রয়াত মো. নাসিমকে নিয়ে কটূক্তি করায় মামলা হয়েছে চারটি। মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং সাতক্ষীরার এক ব্যক্তি।

মামলা করছেন কারা

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যাঁর বিরুদ্ধে লেখা বা আঁকা হচ্ছে, তাঁকেই মামলা করতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। সংক্ষুব্ধ যে কেউ মামলা করতে পারেন। সরকারের শীর্ষ পর্যায়, মন্ত্রী বা সাংসদের ‘মানহানি’তে মামলা করছেন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা, সাংসদ, মন্ত্রী বা সাংসদের পক্ষে তাঁদের বেতনভুক কর্মকর্তা-কর্মচারী বা অনুগতরা।

ভালুকায় নবম শ্রেণির ছাত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন ১০ নম্বর হবিবাড়ী ইউনিয়ন শাখা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হানিফ মোহাম্মদ নিপুণ। বছরের শুরুর দিকে, গত ৭ জানুয়ারি জাতীয় অর্থনীতি পত্রিকার সম্পাদক এম জি আকবরের বিরুদ্ধে মামলা করেন নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি ও তমা গ্রুপের মালিক আতাউর রহমান ভূঁইয়া। মানবজমিনের সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, প্রতিবেদক আল আমিন ও শফিকুল ইসলাম কাজলসহ ৩২ জনের বিরুদ্ধে সাংসদ সাইফুজ্জামান শিখর নিজেই মামলা করেছেন। তা ছাড়া যুব মহিলা লীগের দুই নেত্রী আলাদাভাবেও মামলা করেছেন শফিকুল ইসলাম কাজলের বিরুদ্ধে। সাভারে চুল বিক্রি করে বাচ্চার দুধ কিনলেন নারী শিরোনামে ‘ভুয়া’ খবর ছড়ানোর দায়ে স্থানীয় সাংবাদিকসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন ছাত্রলীগ নেতা রমিজউদ্দীন মিশু।

তবে, মামলাগুলোর পর্যালোচনায় দেখা যায়, বাদীর তালিকায় বিচারক ও র‌্যাব-পুলিশের সদস্যরা আছেন। এ বছরের প্রথম মামলাটি করেন বিচারক শওকত হোসেন। নেসারউদ্দীন নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে হত্যার হুমকি ও অশ্লীলতা ছড়ানোর দায়ে এই মামলাটি হয়। পুলিশের সঙ্গে কথা না বলে পুলিশকে উদ্ধৃত করার অভিযোগ তুলে তিন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে নরসিংদীতে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ জহিরুল ইসলাম মামলা করেন। কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে র‌্যাব।

সাংবাদিক মাহবুবুল আলম লাবলুর বিরুদ্ধে অনুমতি না নিয়ে ইউটিউব চ্যানেলে খবর প্রচারের অভিযোগেও মামলা হয় এ সময়। ওই মামলার বাদী হোসেনি দালান নিবাসী জনৈক ‘দেশপ্রেমিক নাগরিক’ আশিকুর রহমান।

এ তালিকায় সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সিরাজাম মুনিরার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বাদী হয়ে তাজহাট থানায় মামলা করেন। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাহির চৌধুরীর বিরুদ্ধেও বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মুহাম্মদ ইশফাকুল হোসেন। শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন নাগরিক সংগঠনের সমালোচনার মুখে মাহির হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের আবেদন জানায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ইশফাকুল সাংবাদিকদের বৃহস্পতিবার বলেন, জালালাবাদ থানায় তাঁরা মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেছেন।

পুলিশ কী বলছে

ডিজিটাল প্রযুক্তি আইনে মামলা গ্রহণের ক্ষেত্রে পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশনা আছে। এতে বলা হয়েছে, মামলা নেওয়ার আগে পুলিশ সদস্যদের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে হবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কমপক্ষে তিনজন পুলিশ কর্মকর্তা মিডিয়াকে বলেছেন, পুলিশ মাঝেমধ্যে নিরুপায় হয়ে মামলা নিচ্ছে। সরকারের শীর্ষ পর্যায়, সাংসদ বা নেতাদের মানহানি হয়েছে, এই অভিযোগ নিয়ে কেউ এলে তাঁরা মামলা নিতে অনেক সময় বাধ্য হন। পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক সোহেল রানা বলেছেন, মামলা নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় শর্তগুলো পুলিশ সব সময় পূরণ করার চেষ্টা করে থাকে। কখনো এর ব্যত্যয় ঘটলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ খতিয়ে দেখতে পারে।

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!