শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
Sex Cams

সুন্দরবনের শুটকি মৌসুমকে সামনে রেখে শুরু হয়েছে মৎস্য আহরণ



সুন্দরবনের শুটকি মৌসুম শুরু হয়েছে ১ নভেম্বর থেকে। জীবিকার তাগিদে জীবননের ঝুঁকি ও ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে ইতোমধ্যে খুলনার পাইকগাছার জেলেরা পাড়ি জমিয়েছে সমুদ্রের সুন্দরবন উপকূলের বিভিন্ন চরে। করোণায় মানবেতর জীবন-যাপনের পর সাগরে মৎস্য আহরণকে ঘিরে নতুন করে বাঁচার স্বপ্নে বাপ-দাদার পেশা আঁকড়ে প্রতি বারের ন্যায় এবারো দূর সাগরে পাড়ি জমিয়েছে তারা।

এরআগে শেষ মূহুর্তের ব্যস্ততায় উপকূলের জেলে-মহাজনরা সাগরে যেতে প্রস্তুত করে নিয়ে গেছেন প্রয়োজনীয় জাল, দড়ি, নৌকা-ট্রলার। এলক্ষে অনেকেই গড়ছেন নতুন ট্রলার, কেউবা আবার পুরাতনটিকে মেরামত করে ব্যবহার উপযোগী করেছেন। অনুমতি সাপেক্ষে প্রস্তুতি অনুযায়ী সাভার করতে অনেকেই বেরিয়ে পড়েছেন সাগরের পথে। অনেকেই ঢুকে পড়েছেন চরে। সেখানে প্রস্তুত করছেন যার যার সাভার।

কাল-ক্রমে উপজেলার বিভিন্ন নদ-নদীগুলোতে ক্রমান্বয়ে পলি জমে নাব্যতা হ্রাস পাওয়ায় জেলে সম্প্রদায়ের জীবিকার পথ সংকুচিত হয়েছে আগেই। শুধুমাত্র বাপ-দাদার পেশা আঁকড়ে সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল অধিকাংশ পরিবার মৌসুমি মৎস্য আহরণে নিজেদের সম্পৃক্ত রেখেছেন। তার উপর অধিকাংশ জেলে পরিবার অস্চ্ছল হওয়ায় জাল-বোট ও নৌকাসহ পুঁজির অভাবে গভীর সমুদ্রে মৎস্য আহরণে যায় শুধুমাত্র শ্রম বিক্রি করতে। যারা সাভার করতে যায় তারাও আবার মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে শ্রমিক নিয়োগ করেন। এর উপর আবহাওয়ার প্রতিকূল পরিবেশে সাগরে পর্যাপ্ত মাছ নাপড়লে গুণতে হয় লোকসান। এভাবে অধিকাংশ পরিবার কোন রকম টিকে আছে ভাগ্যের উপর ভর করে। দীর্ঘ দিনেও যাদের অনেকে সাবলম্বি হতে পারেননি। বরং দিন দিন তলানিতে ঠেকেছে অর্থনৈতিক অবস্থা। অভাবের তাড়নায় অনেকেই জাল-বোট বিক্রি করে সংসারের ভরণ-পোষণ যুগিয়েছেন। অনেকেই নানা প্রাকৃতিক দূর্যোগ কিংবা পুরনো হয়ে পড়ায় জাল-বোটসহ উপকরণ হারিয়ে আর তৈরি করতে পারেননি। এভাবে ক্রমান্বয়ে অনেক পরিবার পেশা বদলে চলে গেছেন ভিন্ন পেশায়।

আবার অনেকে চড়াহারে মহাজনদের সুদ গুণে এ পেশায় টিকে থাকার জন্য প্রতি মূহুর্তে কঠোর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। উপজেলার বোয়ালিয়া, হিতামপুর, মাহমুদকাটী, নোয়াকাটি, কপিলমুনি, কাশিমনগর, নগর শ্রীরামপুর, কাটিপাড়া, রাড়ুলী, শাহাপাড়া, বাঁকাসহ বিভিন্ন এলাকার জেলে পল্লী থেকে অন্তত দু’ শতাধিক ট্রলার সমুদ্রে মাছ ধরার জন্য যাত্রা করেছে। যাদের অধিকাংশরাই পৌছে গেছেন যথাযথ গন্তব্যে।

গভীর সমুদ্রে সাভারের ইতিহাস ও জলে পল্লীর বাসিন্দাদের কাছ থেকে জানাযায়, ব্রিটিশ শাসনামল থেকে চলে আসা শুটকি পল্লীতে প্রথমত মগ বা সন্দীপবাসী ও চট্রগ্রামের উপকূলীয় জেলেরা সুন্দরবনের চরে অস্থায়ী বাসা তৈরি করে মৎস্য আহরণ করতো। এরপর মূলত আশির দশক থেকে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা ও পটুয়াখালীর জেলেরা সুন্দরবন এলাকায় শুটকির জন্য বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকায় মৎস্য আহরণ শুরু করেন। সেই থেকে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে জেলেরা মৎস্য আহরণ করে আসছেন। ডাঙ্গায় বাঘ, জলে কুমির-হাঙ্গর, বনদস্যু-জলদস্যুর উৎপাত ও বনরক্ষীদের হয়রানির মধ্যেও তাদের বাপ-দাদার পেশা টিকিয়ে রেখেছেন।

পরিসংখ্যান থেকে তথ্যানুসন্ধানে জানাযায়, ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে শুটকী পল্লীর ৭ হাজার ৩২৫ জন জেলেদের কাছ থেকে ২ কোটি ৪৬ লাখ ৬৭ হাজার ৮১৯ টাকা রাজস্ব আদায় করে বনবিভাগ। ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে প্রায় ২৭ লাখ টাকা বেড়ে ৭ হাজার ৭৮৭ জনের কাছ থেকে ২ কোটি ৭৩ লাখ ৯৮ হাজার ৪৮ টাকা আদায় হয়। ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩ কোটি ২২ লাখ টাকা। অঅবহার অনুক’ল পরিবেশ বিদ্যমান থাকলে চলতি মৌসুমেও সমপরিমাণ কিংবা তার চেয়ে বেশী পরিমাণ রাজস্ব আদায় সম্ভব হবে বলে জানিয়েছে বনবিভাগ সূত্র।

জেলে পল্লীর নিয়মিত বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানাযায়, গত কয়েক বছরে সরকার ও বনবিভাগের দৃশ্যমান তৎপরতা মনিটরিং বৃদ্ধি পাওয়ায় সুন্দরবনের দস্যুমুক্ত ও বনবিভাগের অসাধু সদস্যদের হয়রানি বহুলাংশে বন্ধ হওয়ায় সুন্দরবন ও উপকূলীয় শুটকিপল্লী থেকে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন অঞ্চলের পাশাপাশি পাইকগাছা উপজেলার প্রায় ২ শতাধিক বহরদার নৌকা নিয়ে সুন্দরবনাঞ্চলীয় এলাকা থেকে মৎস্য আহরণ করে থাকেন।

জেলেদের জীবন চক্র ও দীর্ঘ দিন যাবৎ সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের দাবির প্রেক্ষিতে বিভিন্ন ব্যাংক ঋণদান কার্যক্রম চালু করলেও বিভিন্ন শর্তের নীচে চাপা পড়ে গেছে ব্যাংকের ঋণদান কার্যক্রম।

জেলে পল্লীর বাসিন্দারা জানান, প্রতি বছর তারা বিভিন্নভাবে উৎস্য থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে সমুদ্রে যান মাছ ধরতে। সেক্ষেত্রে সরকারিভাবে তারা তেমন কোন সাহায্য বা সহযোগিতা পাননা বলেও অভিযোগ তাদের। তবে সরকারি তৎপরতায় সাভারে সুন্দরবনের দস্যুদের উৎপাত ও মুক্তিপণ আদায়সহ আসাধু বনরক্ষীদের দৌরাত্ম্য কিছুটা বন্ধ হলেও সীমাহীন সমস্যায় জর্জরিত রয়েছেন তারা।

অনেকেই ক্ষোভের সাথে জানান, প্রতিবছর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের সমুদ্র থেকে মাছ আহরণের মাধ্যমে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় করলেও মূলত তাদের স্বার্থ সুরক্ষায় সহজ শর্তে ঋণদানসহ নানা প্রতিক’লতায় সরকার সঠিক পদক্ষেপ নেয়না।

এ বিষয়ে সেভ দ্যা সুন্দবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ লায়ন ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, সুন্দরবন আমাদের প্রাকৃতিক রক্ষা কবজ। দীর্ঘদিন ধরে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে মায়ের মত আমাদের আগলে রেখেছে। কিন্তু আমাদের লোভের বলি হয়ে মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে ইউনেস্কো ঘোষিত ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সুন্দরবন।

বন সংশ্লিষ্ট সকলের সচেতনতায় বনকে রক্ষায় এগিয়ে না আসলে আগামীতে এ এলাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশ মারাত্মকভাবে পির্যস্ত হতে পারে বলেও আশংকা তার। এজন্য বনের বাস্তুতন্ত্র বা ইকোসিস্টেম রক্ষায় সরকারি-বেসরকারিভাবে সকলকে এগিয়ে আসারও আহ্বান জানান তিনি।

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!