শনিবার, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৩ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আব্দুর রশীদ লুলু

চাষাবাদ বিষয়ক টুকিটাকি-১২



~ কাঁচা বা পাকা অবস্থায় খাওয়া যায় এবং আচার-চাটনি হিসেবে সমাদৃত জলপাই চাষাবাদের জন্য সারা দেশের মাটিই বলা যায় উপযোগি। অন্য কথায়, জলপাই দেশের প্রায় সর্বত্র যত্নে-অযত্নে চাষাবাদ হয়ে থাকে। তবে গভীর দোআঁশ বা উর্বর মাটি জলপাই চাষাবাদের জন্য অত্যন্ত উপযোগি। খরার মৌসুম ব্যতিত প্রায় সারা বছরই জলপাই-এর চারা রোপণ করা গেলেও উপযুক্ত সময় বর্ষাকাল। গাছে/বাগানে বর্ষাকালে পানি নিষ্কাশন ও খরা মৌসুমে পানি সেচের ব্যবস্থা করতে হয়। এ ছাড়া গাছের গোড়া আগাছামুক্ত রাখা দরকার। গাছ ঝোপালো হওয়ার জন্য ৫/৬ ফুট লম্বা হলে আগা কেটে দেয়া যেতে পারে। এছাড়া বড় আকারের ফলন পেতে হলে ফল আসার পর প্রতি থোকা থেকে ছোট আকারের কিছু ফল পেড়ে ফেলতে হবে। উল্লেখ্য, প্রায় সারা বিশ্বেই জলপাই এর আচারের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। ফলে পারিবারিক চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি জলপাই বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে।

~ করলার চাষাবাদের জন্য বীজ রোপণের উপযুক্ত সময় মধ্য মাঘ থেকে মধ্য চৈত্র পর্যন্ত। সাধারণত: বন্যার পানি ওঠে না এবং বৃষ্টির পানি জমে না- এমন জমি করলা চাষাবাদের জন্য উপযোগি। বীজের অঙ্কোরোদগম তরান্বিত করতে বীজ রোপণের আগে ২৪ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। মাটি ঝুরঝুরে করে মাদা প্রতি ৪/৫টি বীজ রোপণ করতে হয়। বীজ গজানোর পর মাদা প্রতি ২/৩টি সুস্থ-সবল চারা রেখে বাকীগুলো তুলে ফেলতে হয়। গাছ বড় হওয়ার সাথে সাথে বাউনির ব্যবস্থা করতে হয়। উপযুক্ত পরিচর্যায় রোপণের ৫০-৬০ দিনের মধ্যে ফল আসতে শুরু করে এবং ফল ধরার ১৫-২০ দিন পর সাধারণত: সংগ্রহের/খাওয়ার উপযোগি হয়। করলা কচি অবস্থায় সংগ্রহ করতে হয়। শক্ত হয়ে গেলে করলা খাওয়ার অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে এবং বাজার মূল্য কমে যায়। উল্লেখ্য, পুষ্টিগুণ (এবং ভেষজ গুণ) এর ফলে করলা সবজি হিসেবে দেশে ক্রমান্বয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করছে।

~ শিম দেশের একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় সবজি। এক সময় শুধু শীতকালীন সবজি হিসেবে দেশে শিমের প্রচলন থাকলেও এখন প্রায় সারা বছরই শিম পাওয়া যায়। তবে ইপসা/বারোমাসি শিম চাষাবাদে একটু বিশেষ সর্তক থাকতে হয়, বিশেষ যত্ন ও পরিচর্যা করতে হয়। ইপসা বা বারোমাসি শিমের চারা সহজেই বিভিন্ন নার্সারীতে পাওয়া যায়। ইপসা/বারোমাসি শিম প্রায় সারা বছরই চাষাবাদ করা গেলেও সংশি¬ষ্টরা বলেন, শ্রাবণ মাসে লাগানো ভাল। মাদা প্রতি বীজ/চারা ২/৩ টা লাগানো যেতে পারে। সাধারণত: রোপণের দু’মাসের মধ্যে ইপসা/বারোমাসি শিম ফলন দিতে শুরু করে। উল্লেখ্য, দেশি শিম আলোক সংবেদনশীল বলে দিন ছোট না হওয়া পর্যন্ত ফুল ও ফল আসে না। অনেকে আলোক সংবেদনশীলতা ছাড়াও দেশি শিমের সাথে কুয়াশারও একটা সম্পর্ক আছে বলে মনে করেন। অনেক কৃষি বিজ্ঞানী পর্যবেক্ষণের আলোকে বলছেন, শিম ঠান্ডা ও শুষ্ক আবহাওয়ায় ভালো ফলন দেয়।

~ অনেক যৌক্তিক কারণে পৃথিবীব্যাপী চাষাবাদে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সার জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। বিভিন্ন উপাদানে জৈব সার তৈরী করা হয়। এর মধ্যে অন্যতম একটা হলো কচুরিপানা এর মাধ্যমে তৈরী জৈব সার নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়াম পুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ। কেননা কচুরিপানা প্রাকৃতিকভাবে পানি থেকে যথেষ্ট পরিমাণে উল্লেখিত উপাদান সমূহ পরিপোষণ করে থাকে। সঙ্গত: কারণে চাষাবাদে কচুরিপানাকে সম্পদ বিবেচনা করে এর উপযুক্ত ব্যবহার করা উচিৎ। উল্লেখ্য, কচুরিপানা থেকে উৎপাদিত জৈব সার চাষাবাদে ব্যয় সাশ্রয়ের পাশাপাশি নি:সন্দেহে কৃষি ও কৃষকের জন্য মঙ্গলজনক।

~ মালয়েশিয়া প্রথম পাম গাছের ফল থেকে ভোজ্য তেল উৎপাদনের কৌশল আবিস্কার করলেও অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ভোজ্য তেলের চাহিদা মেটাতে ব্যাপক হারে পাম গাছ চাষাবাদ সম্ভব। অনেকে বলেন, পরিবার প্রতি ১০টি পাম গাছ লাগিয়ে দেশের ভোজ্য তেলের চাহিদা পূরণ অনায়াসে সম্ভব। পাম গাছের চারা তৈরী করতে প্রায় ১৮ মাস সময় লাগে এবং সাধারণত: চারা রোপণের ৪ বছর পর থেকে ফল আসতে শুরু করে। একটি গাছ ২০-২৫ বছর পর্যন্ত ফল দিয়ে থাকে। ধান বা পাট চাষের জমি নষ্ট না করে বাড়ির আশে-পাশে বা পতিত জমিতে পাম চাষাবাদ করা যেতে পারে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পাম চাষাবাদে চারা থেকে চারার দূরত্ব হবে ১৮-২০ ফুট এবং চারা লাগানোর জন্য গর্তের আকার হবে ২দ্ধ২দ্ধ২ ফুট। পাম গাছের পাতা গরু-ছাগলের খুব প্রিয় খাবার, তাই গরু-ছাগলের আক্রমণ থেকে গাছকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। উল্লেখ্য, দেশের মাটি ও জলবায়ু পাম গাছের চাষাবাদের জন্য খুবই উপযোগী। এছাড়া ইউরোপ আমেরিকাসহ সারা বিশ্বেই পাম ওয়েলের চাহিদা বাড়ছে।

~ প্রায় সব ধরণের মাটিতে চাল কুমড়ার চাষাবাদ সম্ভব হলেও পানি নিষ্কাশনের সুবিধা সম্বলিত দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটিতে এর উৎপাদন ভালো হয়। চাল কুমড়ার বীজ ফেব্রুয়ারী-এপ্রিল পর্যন্ত রোপণ করা যেতে পারে। বাণিজ্যিক ভাবে চাষাবাদের জন্য সাধারণত: বিঘা প্রতি ৩০০-৪০০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন। বীজ রোপণের জন্য জমি ৩/৪ বার চাষ মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হয়। জমি তৈরীর পর সারি করে বীজ রোপণ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব ২ মিটার এবং বীজ থেকে বীজের দূরত্ব ১ মিটার বা আরেকটু বেশীও দেয়া যেতে পারে। ঘরের আশে-পাশে চাষাবাদের জন্য ভালো করে মাদা তৈরীর পর মাদা প্রতি ৪/৫ টি বীজ রোপণ করা যেতে পারে। চারা গজানোর পর ২/৩ টি সতেজ-সবল চারা রেখে বাকি গুলো তুলে ফেলতে হবে। এ ছাড়া চাল কুমড়া গাছের জন্য অবশ্যই বাউনির ব্যবস্থা করে দিতে হয়। উল্লেখ্য, চাল কুমাড়া কচি এবং পাকা অবস্থায় খাওয়া ও সংগ্রহ করা যায়।তবে কচি অবস্থায় বাজারজাত করা লাভজনক বলে চাষাবাদ সংশ্লিষ্ট অনেকে মনে করেন।

~ বেগুনের অনেক গুলো জাতের মধ্যে উত্তরা অন্যতম। এটি একটি উচ্চ ফলনশীল জাত। চাষাবাদে দেশে উত্তরা বেগুন যথেষ্ট জনপ্রিয়তাও অর্জন করেছে। এ জাতের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে- গাছ খাটো ও ছড়ানো হয়ে থাকে, পাতা ও কান্ড হালকা থাকে, বেগুন এর রং এবং পাতার শিরা গুলো গাঢ় বেগুনী, পাতার নীচের দিকে সামান্য নরম কাটা, ফলের ত্বক খুব পাতলা, শাঁস মোলায়েম এবং খেতে সুস্বাদু। সর্বোপরি, পোকা-মাকড় ও রোগ-বালাই প্রতিরোধ ক্ষমতা এ জাতটির অনেক বেশি। বাজারে চাহিদা থাকায় উত্তরা বেগুন চাষাবাদ লাভজনক। দেশের প্রায় সব ধরণের মাটিতে এর চাষাবাদ হয়। তবে গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুমে এর উৎপাদন কম হয়। পক্ষান্তরে শীত মৌসুমে এর উৎপাদন ভালো হয়। শীত মৌসুমে চাষাবাদের জন্য মধ্য শ্রাবণ-মধ্য আশ্বিন পর্যন্ত বীজতলায় বীজ বপন করতে হয়। উল্লেখ্য, সরাসরি মূল জমিতে বীজ বপন না করে বীজ তলায় চারা উৎপাদন করে, পরবর্তীতে প্রস্তুতকৃত মূল জমিতে বেগুন চাষাবাদ বিভিন্ন দিক থেকে লাভজনক। বীজ বপনের ৩৫-৪৫ দিন পর অথবা প্রতিটি চারা ৫/৬টি পাতা দেয়ার পর মূল জমিতে রোপণ উপযোগি হয়। সাধারণত: রোপণের ৩ মাসের মধ্যে ফসল সংগ্রহ করা যায়। উল্লেখ্য, বেগুন এমন পর্যায়ে সংগ্রহ করতে হবে যাতে ফল যথেষ্ট বড় হয়, অথচ এর ভেতরের বীজ শক্ত না হয়।

লেখক, সম্পাদক- আনোয়ারা (শিকড় সন্ধানী অনিয়মিত প্রকাশনা)।

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!