মুসলিম যারা রোযা বা সাওম পালন করেন তাদেরকে যদি বিভাজন করে দুই ভাগ করা হয় তাহলে এ রকম হবে:
(১) একদল তাঁরা, যারা রামাদ্বান মাস ছাড়াও অপরাপর মাস ও দিনগুলিতে সুন্নাত ও নাফল বা মুস্তাহাব রোযাসমূহ রাখতে অভ্যস্ত।তাঁরা প্রতি মাসে আইয়ামে বীয/বীদ্ব অথবা মাসের যে কোন তিনদিন,শা’বান মাসে অপরিমিত,সাপ্তাহে শনি ও রবিবার,সোম ও বৃহস্পতিবার সহ কমবেশি আরো অনেক সাওম সাধনা যথার্থ করে থাকেন।
এই তাঁরা যদি রামাদ্বানের আগের মাস অর্থাৎ শা’বান মাসের মধ্য তারিখের পর অথবা শা’বানের শেষ দিনগুলিতে যা অবিচ্ছিন্ন ভাবে রামাদ্বানের প্রথম দিবসটির সাথে মিলিত হয়ে যায়—রোযা রাখেন, তাঁদের ক্ষেত্রে ইসলামের উদারনীতি হল, তাঁদের এই রোযাগুলো বৈধ, ন্যায্য, গ্রহণযোগ্য। এ রোযাতে দোষের কিছু নেই উপরন্তু তাতে পুণ্য পাওয়া যাবে এবং ছাওয়াবের অধিকারী হওয়া যাবে।
রামাদ্বানকে স্বাগত জানিয়ে অগ্রিম যে রোযা রাখা মানা, সেটার আওতায় এ সিয়াম পড়বে না কারণ এ রোযা বাহ্যত অথবা আপাতদৃষ্টিতে আগাম রোযা হলেও কার্যত অথবা প্রকৃতপক্ষে এগুলো অভ্যাসের তথা নিয়মিত রোযা। আর এ কারণে শারীআহ’র পক্ষ থেকে তাতে কোন বাঁধা নেই অধিকন্তু শারীআহ এ জাতীয় নাফল রোযাকে সমীহ করে।
তবে অবশ্যই খেয়াল ও লক্ষ্য রাখতে হবে যে,এসব রোযা রাখতে যেয়ে শারীরিক ভাবে যেন কেউ দুর্বল ও কমজোর না হয়।যাতে করে রামাদ্বানের ফরদ্ব রোযা রাখতে স্বাচ্ছন্দ্য উবে যায় কিংবা উৎসাহ কমে যায় অথবা কষ্টকর হয়ে যায়। কারণ, এমনটি হওয়ার সম্ভাবনা প্রকট হলে পর এসব রোযা রাখাই মানা হয়ে যাবে।
সেক্ষেত্রে, এসব নাফল রোযা না রেখে বরং রামাদ্বানের রোযার জন্য শারীরিক প্রস্তুতি নেয়াই কর্তব্য হবে।
(২) অপর দল তাঁরা,যারা রামাদ্বানের পুরো মাসের অত্যাবশ্যকীয় সিয়ামই শুধু পালন করে থাকেন,কোন কারণে রামাদ্বানের কোন রোযা বাকি থাকলে তা হয়ত অন্য সময়ে পুরা করেন কিন্তু সচরাচর বছরে আর কোন রোযা রাখেন না। তাঁরা অন্যান্য সুন্নাত অথবা নাফল রোযা রাখতে অভ্যস্ত নন।
এ শ্রেণীর মুসলিমদেরকে রামাদ্বান মাস শুরু হওয়ার আগেই রোযা শুরু করতে শারীআহ্ নিষেধ করেছে। তাঁরা যেন সরাসরি রামাদ্বানের প্রথম দিনই রোযা রাখা আরম্ভ করেন, রামাদ্বানের পূর্বে কখনো নয়।
প্রশ্ন যদি করা হয় যে,রামাদ্বান শুরুর কত দিন আগ থেকে রোযা রাখা যাবে না? এ প্রশ্নের নিষ্পত্তির জন্য খোলাখুলি হাদীস রয়েছে।
তবে হাদীসে দু ধরণের বিবরণ রয়েছে।
(ক) কিছু হাদীসে বিবৃতি দেয়া হয়েছে যে,রামাদ্বান শুরুর এক অথবা দুদিন পূর্বে থেকে রোযা রেখে, রোযাকে আগাম টেনে যেন না হয়। (বুখারীঃ ১৯১৪, মুসলিমঃ ১০৮২)
এ আদেশ অকাট্য। প্রামাণ্য বিধান। এমন কেউ যারা নাফল রোযায় অভ্যস্ত নন তাঁদের জন্য এ রোযা পরিত্যাজ্য।নিষিদ্ধ। নাফল নিয়তে এ ভাবে রোযা রাখা হারাম অথবা মতান্তরে ‘মাকরূহ-তাহরীমী’ তথা হারাম পর্যায়ভুক্ত অথবা এমন অপছন্দনীয় যা হারামের কাছাকাছি।এবং তা অন্যায় ও পাপ।
তার মানে—রামাদ্বানকে স্বাগত জানিয়ে আগাম রোযা, যা নাফল নিইয়াহ/নিয়তে এক অথবা দুদিন পূর্বেই শুরু করা হয়, তা সাধারণ্যের জন্য মানা।
রামাদ্বান শুরু হওয়ার আগে, এক/দুই দিন পূর্বে,আগাম রোযায় একজন মুসলিম কি ভাবে উদ্বুদ্ধ,প্রবুদ্ধ অথবা প্রলুব্ধ হতে পারে, তা খতিয়ে দেখলে যে তত্ত্ব পাওয়া যাবে, তার অন্যতম তিনটি হেতু এখানে প্রণিধানযোগ্য :
(ক) অহেতুক ভয়।
রোযা রাখায় অভ্যস্ত না থাকায় প্রতি বছর যখন রামাদ্বান আসে তখন অনেকে ভাবতে পারেন যে, ‘প্রথম দিনের ফারদ্ব/ফরজ রোযাটি প্রচন্ড কষ্টসাধ্য হতে পারে তাই এক/দুদিন আগেই রোযা শুরু করা যাক। তাতে রামাদ্বানের রোযা স্বাভাবিক হয়ে আসবে।’
(খ) অমূলক সংশয়।
চাঁদের উপর নির্ভর করে প্রতি বছর রামাদ্বান যখন সমাগত হয়, তখন কিছু মুসলিম ভাবতে পারেন যে, হয়ত চাঁদের গণনা বা র্নিণয়ে ভুল হয়ে থাকতে পারে, সেক্ষেত্রে হয়ত রামাদ্বান আগেই শুরু হতে যাচ্ছে অথচ আমাদের কোন অদূরদর্শিতা জন্য আমরা হয়ত বুঝতে পারছি না তাই বরং আমরাই কিছু আগে রোযা আরম্ভ করে দেই তাতে রামাদ্বান ছুটে যাওয়ার সম্ভাবনাই থাকবে না।আর সতর্কতার দাবিই হল—আগে ভাগে রোযা রাখা।
(গ) অতিশয় ঔৎসুক্য বা আগ্রহ।
প্রবল পুণ্যকাল রামাদ্বান যখন উপনীত তখন অনেকে ভাবতে পারেন যে,রামাদ্বানকে স্বাগত জানাতে নিজেই স্বপ্রণোদিত হয়ে স্বাগতিকের ভূমিকা পালন করতে হবে আর এজন্য, এক-দুটি অতিরিক্ত রোযা রেখে রোযাকে রোযা দিয়েই বরণ করা শ্রেয়।
উপরের তিনটি রহস্যময়,বিচিত্র ও অদ্ভুত ভয়, সংশয় এবং অতি-আগ্রহ—শারীআহ বা ইসলামের চোখে অপ্রয়োজনীয়,অনাবশ্যক এবং অনর্থক।
তাই ইসলামের বিধি স্পষ্ট ও পরিষ্কার যে, রোযা স্বকীয় ভাবে নির্দোষ ও নির্মল ইবাদাত হওয়া সত্ত্বেও এসব কারণে ঐ রোযা রাখা মানা।
উল্লেখ্য, ফারদ্ব/ফরজ ও নাফল রোযা সমূহের নির্দিষ্ট সীমারেখা ও নীতিমালা রয়েছে। সেহেতু যথাযথ সময়ে যথোচিত ভাবে তা শুরু ও শেষ করতে হয়। যাতে ফারদ্ব ও নাফলের পার্থক্য যেন পরিস্ফুট বিদ্যমান থাকে।
ইসলামের বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্য্য এই যে,কোনরূপ ভয়,সংশয় অথবা অতি-ঝোঁকের ভিত্তিতে যেমন কোন ইবাদাতকে প্রতিষ্ঠিত করে না তেমনি রামাদ্বানের রোযার মত এত উত্তম ইবাদাতকেও এসব উটকো প্রসঙ্গের উপর প্রতিষ্ঠা করার প্রশ্রয় দিতে পারে না।
যথা, অনভ্যস্ত কেউ যদি এসবের বশবর্তী হয়ে রোযা রাখে তবে প্রতি বছর তাঁর এই ভয় অথবা সংশয় কিংবা অতি-ঔৎসুক্যের মত মনোগত এক ধরণের গুপ্ত রোগ অবারিতভাবে আরো বাড়তেই থাকবে।
পক্ষান্তরে, যখন এক-দুটি নাফল রোযা, রামাদ্বানের পূর্বে রেখে ফরদ্ব রোযার সূচনা করা হবে তখন জনমনে অথবা সাধারণ অপরিপক্ক মুসলিমদের মাঝে রামাদ্বান শুরু হওয়া নিয়ে দ্বিধা ও বিভ্রাটের সূত্রপাত ঘটবে যা মোটেই কাম্য নয় কারণ কুরআনে (কুরআনঃ২/১৮৫) রামাদ্বান মাস আগত হলে পর রামাদ্বানের সাওম শুরু করতে বলা হয়েছে।
এবং হাদীসে চাঁদ দেখে রোযা ধরতে আর চাঁদ দেখে রোযা ছাড়তে বলা হয়েছে। (বুখারীঃ ১৯০৯,মুসলিমঃ ১০৮১)
এখানে আরো উল্লেখ্য যে;
যথা সময়ে ফরদ্ব আদেশ পালন করতে যেয়ে কষ্ট হলেও এই কষ্ট পুষিয়ে দেয়া হবে ছাওয়াব ও মর্যাদায় উন্নতি প্রদান করে এবং আবহমান কালের জান্নাতের পথ সুগম করে দিয়ে অথবা চিরকালের জান্নাতের আরো উন্নত অনুগ্রহ ও নেয়ামত এবং স্বাচ্ছন্দ্য বাড়িয়ে দিয়ে।
(খ) রামাদ্বান শুরুর কত দিন পূর্ব থেকে সাধারণত রোযা রাখা যাবে না—এ নিয়ে অপর যে বর্ণনা হাদীসে এসেছে তাতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যে, মধ্য শা’বানের পর থেকে অর্থাৎ শা’বান মাসের ষোল তারিখ থেকে রোযা রাখা মানা।
(সুনান আবু দাউদঃ ২৩৩৭,জামে’ আত-তিরমিযীঃ ৭৩৮,সুনান ইবনু মাজাহঃ ১৬৫১)
এ হাদীসটি স্বতন্ত্র ও বিচিত্র হওয়ায় এ হাদীসের কিছু বিষয় নিয়ে কিছু মনীষী আপত্তি তুললেও মূলত এ হাদীস নির্ভরযোগ্য ও প্রামাণিক। এবং আদেশ সক্রিয় ও কার্যকর।তবে হাদীসটির আদেশ সর্বত্রই উন্মুক্ত নয়। বরং সংশ্লিষ্ট বোদ্ধা মনীষীদের অভিমত হচ্ছে—এ হাদীসের নির্দেশনা তাঁদের জন্য যারা শা’বানের প্রথম অর্ধেকে কোন রোযা রাখেননি।তার মানে এই যে,যারা ১৫ শা’বান অবধি কোন রোযা রাখার কসরত করেননি তাঁরা যেন হঠাৎ করে শা’বানের ষোল তারিখ থেকে রামাদ্বান শুরু হওয়া পর্যন্ত নাফল কোন রোযা আর না ধরেন কারণ তাতে করে তাঁদের শারীরিক ভাবে দুর্বল হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিবে এবং রামাদ্বানের একটানা একমাস রোযা রাখা তখন কষ্টসাধ্য হয়ে যেতে পারে।
এ বিধান হারাম নয়। মাকরূহ-তাহরীমি নয়।শুধু মাকরূহ তানযীহি যা ইসলামের দৃষ্টিতে অপ্রিয়। অপছন্দনীয়।
ইসলাম চায়,ফরদ্ব/ফরজ দায়িত্ব গুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মনোযোগী হয়ে যেন আদায় করা হয়।নাফল দ্বারা যেন ফরদ্ব দুর্বল না হয়। ফরদ্ব আদায়ে যেন উৎসাহ,উদ্দীপনার ঘাটতি না হয়।
যথা,আরাফার দিবসে অন্যান্য মুসলিমের জন্য রোযা রাখা অতি উত্তম হওয়া সত্ত্বেও যারা হাজ্ব পালনরত তাঁদের জন্য এ কারণে উত্তম নয় যে, তাতে করে হাজ্ব-সংক্রান্ত অপরাপর জরুরি কাজ দুরুহ হয়ে যেতে পারে।
এতে ইসলামের সৌন্দর্য ও মাহাত্ম্যই ফুটে উঠে।
ইসলামের ছোট ছোট বিধানেও রয়েছে অনেক প্রজ্ঞা। প্রভূত হিকমাহ। পর্যাপ্ত কল্যাণ।
লেখক, মুফতি।