রবিবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৪ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাবীব নূহ

সন্দেহ দিবস



মুসলিম দুনিয়ায় একটি দিন এমন রয়েছে যাকে সন্দেহ দিবস অথবা সংশয়ের দিন বলা হয়।মুসলিমদের কাছে এ দিনটি অঘোষিত আঞ্চলিক অথবা আন্তর্জাতিক সংশয়ের দিন।আরবিতে যাকে ইয়াওমুশ শাক (يوم الشَّكِّ) বলা হয়।হাদীসেও এ নাম ব্যবহার করা হয়েছে।

তবে কোন মানব ও দানবের আচরণের ভিত্তির উপর এ দিন নয় বরং দিনটি শা’বানের নাকি রামাদ্বানের-এই সংশয়ের কারণে ইয়াওমুশ শাক।

ইসলামী ক্যালেন্ডার তথা চাঁদের হিসেবে অষ্টম মাস শা’বান এবং নবম মাস রামাদ্বান।আর প্রতিটি চাঁদ-মাস উনত্রিশ অথবা ত্রিশ দিনের হয়ে থাকে।তার মানে প্রতিটি চাঁদ-মাস—উনত্রিশ দিবসের নাকি ত্রিশ দিনের,তা পূর্ব থেকে নির্ধারিত থাকে না বরং আকাশে যখন চাঁদ দেখা দেয় বা প্রকাশ পায় তখন তা নির্ধারণ হয়।

রুইয়াতুল হিলাল বা নতুন চাঁদ দেখার উপর প্রতি চান্দ্রমাস নির্ভরশীল।

অমাবস্যা শেষ হওয়ার পর উজ্জ্বল ধনুকের আকৃতিতে যখন আকাশে সরু ও বাঁকা চাঁদ প্রকাশিত হয়,যাকে ‘হিলাল’ বলা হয়।প্রদর্শিত এই হিলাল দেখে নতুন আরেকটি ইসলামী বা চাঁদ মাসের সূচনা হয়।

পৃথিবী একটা গ্রহ।এই পৃথিবীকে ঘিরে যদি কিছু ঘুরে তবে সেটি পৃথিবীর উপগ্রহ।চাঁদ পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরে বেড়ায়।সেজন্য চাঁদ পৃথিবীর উপগ্রহ।এবং একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ।এবং সৌর জগতের পঞ্চম বৃহত্তম উপগ্রহ।

এই চাঁদ প্রতি মাসে তার নিজস্ব পরিক্রমণ সমাপ্ত করে ফেলে।এ পরিভ্রমণ সম্পাদনে সব মিলিয়ে চাঁদের সময় লাগে প্রায় ২৯ দিন, ১২ ঘণ্টা, ৪৪ মিনিট ৩ সেকেন্ড তথা ২৯ দিনের উপরে।যদিও চাঁদের উপর সূর্যের আকর্ষণের কারণে যেকোনো চাঁদ-মাস ২৯.২৬ দিন থেকে ২৯.৮০ দিন সময়কালের মধ্যে যেকোনোটাই হতে পারে।
আর যেহেতু মাসের গণনায় ভগ্নাংশ হয় না,তাই আরবি বা হিজরি মাস ২৯ বা ৩০ দিনের হয়ে থাকে।
হিজরি মাস কখনো ২৮ এবং কখনো ৩১ দিনের হয় না।

সূর্যের আলো থেকে চাঁদ আলো পায়।চাঁদের নিজস্ব কোনো আালো নেই।আবার চাঁদের আলো সূর্যের আলোর চেয়ে ঢের কম।সূর্যের আলো এতোই বেশি যে সূর্যের পূর্ণ আলোতে চাঁদ দেখা যায় না।সন্ধ্যার আগে যখন সূর্যের আলো কমে যায় তখন সাধারণত চাঁদ দেখতে পাওয়া যায়।
সেজন্য প্রতি চাঁদ-মাসের ২৯ তারিখে নতুন এক চাঁদ দেখার সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং এই চাঁদই মাসকে চূড়ান্ত ভাবে নির্ধারণ করে দেয় যে মাসটি ২৯ নাকি ৩০ হবে।
প্রতিটি চাঁদ-চক্র অনন্য।প্রতিটি চাঁদ-মাস স্বতন্ত্র।

শা’বান মাসের ২৯ তারিখে যখন সংগত কারণে চাঁদ দেখা না যায় তাহলে পরের দিন ৩০ শা’বান নির্ণয় হবে এবং এর পরের দিন প্রথম রামাদ্বান নির্ধারিত হয়ে যাবে।

উল্লেখ্য যে, ইসলামী বা আরবি দিন শুরু হয় সূর্যাস্তের সময় থেকে এবং পরদিন সূর্যাস্তের সময় পর্যন্ত একদিন পূর্ণ হয়।মাগরিব থেকে মাগরিব।

আরো উল্লেখ্য যে, চাঁদ দেখা এবং চাঁদ দেখার সাক্ষ্য দেয়া দুটো ভিন্ন ভিন্ন বিষয়।আলাদা ভাবে দুটো বিষয় দ্বারা চাঁদ দেখা
প্রমাণিত হতে পারে।অবশ্য সাক্ষীর সংখ্যা ও গুণাগুণ নিয়েও আলাদা বিধান রয়েছে।

২৯ শা’বান আর প্রথম রামাদ্বানের মাঝে ৩০ শা’বানের রয়েছে।এই ৩০ শা’বানই হতে পারে সন্দেহ দিবস তথা ইয়াওমুশ শাক।
কারণ সব ৩০শে শা’বান কিন্তু সন্দেহ দিবস নয়।বরং ঐ ৩০ শা’বান, যাকে নিয়ে সন্দেহ, সংশয় দেখা দেয় যে,এ দিন কি সত্যিই ৩০ শা’বান অথবা শা’বানের শেষ দিন নাকি রামাদ্বানের প্রথম দিন।

সন্দেহ দিন সাব্যস্তে এক বা একাধিক সম্ভাবনা রয়েছে এবং এ নিয়ে মনীষী ইমামদেরও বেশ কিছু ভিন্ন ভিন্ন অভিমত ও মতামত রয়েছে।
যথাঃ
(ক) আকাশ যদি মেঘলা বা আবহাওয়ার কারণে ঝাপসা থাকে।যার কারণে ২৯ শা’বানের দিবাগত রাত অর্থাৎ ৩০ শা’বানের রাতে চাঁদ দেখা গেল না।তো রাত শেষের ৩০ শা’বানের দিনটি সন্দেহ-দিন।
(এ মতটি মালিকি মতাদর্শের)

(খ) আকাশ পরিচ্ছন্ন,পরিষ্কার তবুও চাঁদ দেখা যায়নি তাহলে দিনটি সংশয়ের দিন হবে কারণ মেঘাবৃত গগন হলে তার বিধান ভিন্ন।
(এটি আল্লামা ইবনু তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ সহ হাম্বলি তাত্ত্বিকদের অভিমত)

(গ) কোন কারণে চাঁদ তো দেখা যাচ্ছে না এমতাবস্থায় এমন কিছু লোক সাক্ষী দিল যাদের সাক্ষী শারিআহ বিধানে গ্রহণযোগ্য হল না(যেমন কিছু শিশু চাঁদ দেখার সাক্ষী দিল) তাহলে ঐ দিনটি হবে সন্দেহের।তাতে আসমান মেঘাবৃত হোক অথবা নাই হোক।
(এ মতটি শাফিঈ ভাবাদর্শের)

(ঘ) রজব মাস ৩০ দিন পূর্ণ হওয়া পর,পরের মাস শা’বানও আবার ৩০ দিন হওয়াতে দিনটি নিয়ে সংশয় দেখা দিল।
অথবা মেঘাবৃত ও ঝাপসা আসমানের কারণে সন্দেহ হল।কিংবা আকাশ তো পরিষ্কার কিন্তু চাঁদ তো নেই,এমনি পরিস্থিতিতে কেউ একজন সাক্ষী দিল বটে কিন্তু সংগত কারণে তার সাক্ষ্য প্রত্যাখ্যান হল।
অথবা দুজন ফাসিকের সাক্ষীর কারণে প্রত্যাখ্যাত হল।
৩০ শা’বান দিনটি নিয়ে এ জাতীয় সন্দেহ হলে দিনটি ইয়াওমুশ শাক হবে।
( এ বিবেচনা হানাফি মতাদর্শের)

তবে দিনটি নিয়ে অন্তত তিনটি বিষয়ে সবাই একমত।

(১) দিনটি ৩০ শা’বানের হবে।

(২) ঐ দিন চাঁদ সরাসরি দেখা যাবে না।এবং

(৩) দিনটি নিয়ে এই সন্দেহ জাগবে যে,দিনটি শা’বানের শেষ দিবস নাকি রামাদ্বানের প্রথম।

এ দিনটিতে রোযা রাখা নিয়ে আছে বিশদ বিধান,ব্যাপক ব্যাখ্যা এবং বিস্তৃত নিয়ম ও নীতি।

তবে সংক্ষিপ্ত মূল বিধি হল :

সন্দেহের বশবর্তী হয়ে এবং রামাদ্বান হতে পারে এমন মনস্থ করে,কারো এ দিবসে রোযা রাখা উচিত নয়।রাখাটা গোনাহ হবে।রোযা রাখাটা হারাম না হলেও হারামের কাছাকাছি মাকরূহ (মাকরূহ-তাহরীমী) হবে যা বর্জনীয় ও পরিত্যাজ্য।

সর্বোপরি,নিচের হাদীসটি লক্ষনীয়ঃ

স্বনামধন্য সাহাবী আম্মার ইবন ইয়াসির রাদ্বিআল্লাহু আনহু।যার মা ছিলেন ইসলামের প্রথম শাহীদ হওয়া একজন—সুমাইয়া বিনতে খাব্বাত (বা খাইয়াত) রাদ্বিআল্লাহু আনহা।
তাঁর এক ঘটনা বর্ণনা করেছেন—ইরাকের কুফার বিশিষ্ট তাবিঈ সিলাহ ইবন যুফার আবুল আ’লা,আল-আবসি আল-কুফি রহিমাহুল্লাহ :

«كُنَّا عِنْدَ عَمَّارِ بْنِ يَاسِرٍ فَأُتِيَ بِشَاةٍ مَصْلِيَّةٍ، فَقَالَ: كُلُوا، فَتَنَحَّى بَعْضُ القَوْمِ، فَقَالَ: إِنِّي صَائِمٌ، فَقَالَ عَمَّارٌ: مَنْ صَامَ اليَوْمَ الَّذِي يَشُكُّ فِيهِ النَّاسُ فَقَدْ عَصَى أَبَا القَاسِمِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ».

সিলাহ বর্ণনা করে বলেন,

আম্মার ইবন ইয়াসির রাদ্বিআল্লাহু আনহুর সমীপে আমরা ছিলাম।একটি ভুনা ছাগল (খাবারের উদ্দেশ্যে) নিয়ে আসা হল।তিনি বললেন, তোমরা সবাই এটি খাও।তখন দলের কেউ একজন সরে দাঁড়িয়ে বল্লেন,আমি রোযা রেখেছি।আম্মার রাদ্বিআল্লাহু আনহু বললেন, সন্দেহের দিনে যে সাওম পালন করে,সে তো আবুল ক্বাসিম (মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর নাফরমানি (তথা অবাধ্যতা বা বিরোধিতা) করে”

(তিরমিযি, হাদীস নাম্বারঃ ৬৮৬, হাদীসটি হাসান সহীহ।নাসায়ীঃ ২১৮৮,হাদীসটি সহীহ। ইবন হিব্বানঃ ৩৫৮৫।)

পরিশেষে :
এ লিখার অভিসন্ধি এই নয় যে কোন মাসআলা বা ফাতওয়া দেয়া বরং উদ্দেশ্য হল,একটি দিবসকে চিহ্নিত ও লক্ষণীয় করে তুলা।শুধু ইয়াওমুশ শাক বা সন্দেহ দিবসকে পরিচিত করানো।আর তাই,দিবসটি নিয়ে উদ্ভুত অথবা এ ব্যাপারের আনুষঙ্গিক ও প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো তথা মাসআলা-মাসাঈলের জন্য স্থানীয় বিজ্ঞ আলিমদের কাছেই যেতে হবে অথবা যাওয়া বাঞ্ছনীয়।

লেখক: মুফতি

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!