শনিবার, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৩ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাবীব নূহ

সে রাতে পাহাড়ে কি ঘটেছিল?



মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। বয়স তখন তাঁর সৌর-বৎসরের হিসেবে ৩৯ বছর ৩ মাস ২২ দিন। চন্দ্র বৎসরের গণনায় ৪০ বছর ৬ মাস ১২ দিন।
১০ই আগষ্ট ৬৭০ খৃষ্টাব্দ। ২১ রামাদ্বান। সোমবার রাত। তখন তিনি মক্কার অদূরে নূর পাহাড়ের হিরা গুহায়। মক্কা সহ পুরো পৃথিবীর বাসিন্দারা নিমগ্ন অন্য কিছুতে। আর তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ধ্যানমগ্ন অন্য কিছুতে।

অতর্কিতে এক স্বর্গীয় আগন্তুকের অভ্যাগম হল তাঁর গুহায়। আগন্তুক হলেন নূর দ্বারা সৃষ্ট মালাক। বরং মালাঈকাদের প্রধান। তাঁদের দলনেতা জিবরাঈল (তথা জিবরিল তাঁর নাম) আলাইহিস সালাম। তাঁর উপনাম রূহ ও রূহুল আমীন এবং রূহুল কুদস। তিনি বিরাট ও বিশাল সব দায়িত্বে নিয়োজিত। অগণন নাবী আর রাসূলদের কাছে তিনি রব্বানী বার্তা নিয়ে আসেন। তাঁদের দেখাশোনা করেন ইত্যাদি ইত্যাদি সব মহান কাজ তিনি সম্পাদন করেন।

আল্লাহ-প্রদত্ত যে সেরা দায়িত্ব পেয়ে তিনি সব চেয়ে বেশি গৌরবান্বিত ও বেশি শ্রেষ্ঠ এবং মহীয়ান। আজ রাত তিনি শুরু করতে যাচ্ছেন সেই সেরা দায়িত্ব।
জিবরিল অদ্য রাতে সহসা সোজা চলে আসলেন ঐ পাহাড়ের গুহায়। একদম সাক্ষাৎ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্মুখে এসে কন্ঠ ধরলেন।
জিবরিল এসে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কিছু পড়তে অনুরোধ করলেন। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পড়তে অসমর্থের কথা অকপটে স্বীকার করলেন জিবরিল বরাবর। জিবরিল এবার তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে চাপ দিলেন। তিনি কষ্ট পেলেন। জিবরিল তাঁকে মুক্ত করে দিয়ে দ্বিতীয় বার পড়তে নিবেদন করলেন। তিনি তাঁর অক্ষমতার কথা পুনঃ জানান দিলেন। জিবরিল পুনর্বার তাঁকে জাপটে ধরলেন। তিনি খুব ব্যথা পেলেন। জিবরিল বন্ধনমুক্ত করে দিয়ে পুনশ্চ তাঁকে পড়তে আবদার করলেন। তিনি তৃতীয় বারও তাঁর অপরাগতা প্রকাশ করলেন। পুনরায় জিবরিল তাঁকে আঁকড়ে ধরলেন।অতপর জিবরিল তাঁকে ছেড়ে দিয়ে নিজেই কিছু পাঠ করে শুনাতে লাগলেন।

তখন আরশের পাশের লাওহুম-মাহফূযে যা মজুত ছিল এতকাল অর্থাৎ কুরআন। সেই কুরআন খ্যাত স্রষ্টার কুদরাতি মুখনির্গত উক্তিগুলোর অবমুক্ত শুরু হল। ধরণীর বুকে এই প্রথম আবির্ভূত হল সেই অমিয় বচন। জিবরিল স্বকন্ঠে উচ্চারণ করে যেতে লাগলেন আর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কর্ণবিবর হয়ে তাঁর বক্ষে প্রোথিত ও নিরাপদ হয়ে রক্ষিত হতে থাকলো। এ এমনই ভারী কালাম যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বুক ছাড়া এ বসুন্ধরায় অন্য কোন অন্তর ও প্রান্তরের সামর্থ্য নেই এই বোঝা বহন করার।

প্রথম যে পাঁচটি অমৃত বাণী জিবরিল তাঁকে সোপর্দ করতে লাগলেন তাঁর ঐশী জবানে তাতে সুপ্ত ৮৩টি অক্ষরের একেক হারফকে যদি সহস্র অথবা অজস্র সংখ্যায় টুকরো করা হত আর তা থেকে ক্ষুদ্র একটি অংশ যদি নূর পাহাড় অথবা পাশের সাবীর পাহাড়কে অর্পিত করা হত তখন হয়ত পর্বত দুটি ভারসাম্যহীন হয়ে নুয়ে পড়তে এবং ফেটে চৌচির হয়ে যেতে পারত।

মক্কার অধিবাসীরা এ বিভোর রাতে যখন প্রসুপ্ত পৃথিবীর মানুষের দিল যখন এখনই ঘুমন্ত। এই নিদ্রিত দুনিয়ায় তখন একটি মাত্র জাগ্রত অন্তরে তোলপাড় চলছিল। অঘোর পাহাড়ে নিশির ঘোর। গুহার তিমির। জড় শরীর কিন্তু তাঁর অভ্যন্তর অন্তরে আজ রাত অভ্যুদয় হল এক নূর-সূর্যের। কুরআন-রবি। যা অনাগত ২২ বছর ৫ মাস ১৪ দিন অবধি উদিত হতে থাকবে তাঁর বুক কক্ষ পরিক্রমণ করে।

এ নূর-রবি পৃথিবীর বুকে হিদায়েতের কক্ষপথে নবীর বক্ষে ব্যাপ্ত ও বিকীর্ণ হবার আগেই কিন্তু পুরো কিতাবুম মুবীন তথা পরিপূর্ণ কুরআন পৃথিবীর আসমানে অবতরণ করেছিল ক্বাদারের একটি রাতে। এবং তা পৃথিবীকে আচ্ছাদিত করে রাখা আসমান-অভ্যন্তরের সুমহান একটি কেন্দ্র “বাইতুল ইযযাহ’ এ অপেক্ষমাণ ছিল পৃথিবীতে উত্তরণের জন্য।

পৃথিবীর জ্বিন ও মানবের সৌভাগ্য যে—কুরআন অবতীর্ণের যে রাতটি অতি মোবারক। সে মোবারক রাতটি ছিল লাইলাতুল ক্বাদর।
————————————-
বিশেষ টিপ্পনী:
উপরের ব্যাখ্যানের সাথে নিম্নের কিছু তথ্যসূত্রের সম্বন্ধ ও সূত্র মিলানো যেতে পারে।
১.
সাহীহ মুসলিম ২৩৪৭
(بَعَثَهُ اللَّهُ عَلَى رَأْسِ أَرْبَعِينَ سَنَةً )
২.
সূরাতুল ক্বাদর(৯৭),
আয়াত-৪
৩.
সূরা আশ শুআরা(২৬),
আয়াত: ১৯৩
{نَزَلَ بِهِ الرُّوحُ الْأَمِينُ}
৪.
বাক্বারা২/৮৭,
{وَأَيَّدْنَاهُ بِرُوحِ الْقُدُسِ}
৫.
বুখারী,হাদীস ৩,
মুসলিম ১৬০
৬.
সূরা আল-আ’লাক্ব: ৯৬/১-৫
৭.
আল-মুযযামমিল: ৭৩/৫
৮.
আল-হাশার: ৫৯/২১
৯.
আদ-দুখান: ৪৪/৩

লেখক: মুফতি

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!