শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৯ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাদল গেছে টুটি ।। আব্দুর রশীদ লুলু



ঘরের পাশে আম গাছের নীচে লখন ও তার বউ। পাশে তাদের বছর দেড়েকের ছেলেটা খেলছে আপনি মনে, দৃষ্টি আমার স্থির হয়ে থাকে।

ভর দুপুরে ঘরে আমি অস্বস্থিতে ভুগছি। লখন জাল বুনছে, পাশে বসে বউ তার মাছ কুটছে। কথা বলছে দু জনে, কখনো মৃদু হাসছে। কখনো হাঃ হাঃ করছে। লখন কাজে অসম্ভব মনোযোগী। বউ মাঝে মাঝে মুখ তুলছে। স্বামীর মুখ দেখছে, গভীর ভালোবাসায় পরম নির্ভরতায় । একটা দীর্ঘশ্বাস আমি আটকাতে পারি না, লখন তোমরা ভালোই আছো ।

লখন আমার বছর পাঁচেকের ছোট পড়শি। অভাব-অনটন, ঝগড়া-বিবাদ থাকলেও বউ বাচ্চা নিয়ে কী সুন্দর দাম্পত্য জীবন। এই তো সুখ, স্বর্গীয় সুখ। জানালা দিয়ে ওদের দেখতে দেখতে চোখ আমার ঝাপসা হয়ে ওঠে। ব্যথায় হৃদয়টা মোচড় দিয়ে যায় । রুগ্ন মায়ের মুখ ভেসে ওঠে চোখের সামনে। মা যন্ত্রণায় ছটফট করছেন বিছানায়, একটা টুকটুকে লাল বঁধুর স্বপ্ন তার আজীবনের। মরার আগে তিনি দেখে যেতে চেয়ে ছিলেন, সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন, ঘর আলো করে থাকা পুত্রবধু।

কিন্তু সে আর হলো না। টানা হেঁচড়ার সংসার, বাবা তাই প্রথম দিকে মানলেন না। আগে চাকুরী, তারপর বিয়ে। মার কান্নাকাটিতে শেষ পর্যন্ত বাবা রাজী হলেন। কিন্তু আমি পারলাম না। যে বেকারত্বের কারণে আমি আমার ভালোবাসা রিমিকে হারিয়েছি, সেই বেকারত্ব কাঁধে নিয়ে আমি ঘর বাঁধব সে হয় না। হতে পারে না। মনে পড়ে রিমির কথা।

: মতি, আর কতকাল আমি এ কথা ওকথা দিয়ে বাবা মাকে বুঝাই। প্লিজ তুমি এবার একটা কিছু করো।

আমার হাত ধরে রিমি মিনতি করে।

না, আমি কিছু করতে পারিনি। আমার নিজের জন্য না। রিমির জন্য না। বাবা-মা ভাই-

বোনের জন্য না।

শেষ পর্যন্ত নাকের জল চোখের জল এক করে, লাল শাড়ী গয়না পড়ে রিমি চলে গেছে। হৃদয় আমার শূন্য হয়ে আছে। বুকে ব্যথা চিড়িক মারে সময়ে অসময়ে।

তবু সব কিছু ছাপিয়ে চেষ্টা করেছি মরিয়া হয়ে। হন্যে হয়ে ঘুরেছি। আত্মবিশ্বাস রেখেছি, বিএ পাশ আমার একটা কিছু হবেই। চাকুরীর দরখাস্ত লেখার চর্চা করেছি। ডজন ডজন ইন্টারভিউ দিয়েছি। ব্যক্তিগত ঋণের বোঝা বাড়িয়েছি ।

: লক্ষ্মী মা, আর ক’টা দিন সবুর করো। এই তো আমার চাকুরী হলো।

আমার মিছে সান্তনায় মা শুধু দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত সেই দীর্ঘশ্বাস বুকে নিয়ে । এই বছর দেড়েক আগে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন।

: ভাইয়া, তোমার চা

মমতার উপস্থিতিতে বিব্রত হয়ে পড়ি, তাড়াতাড়ি চোখ মুছে ওদিকে মুখ ঘোরাই ।

: টেবিলে রেখে যা। কন্ঠস্বরে কান্না আমার ধরা পড়ে। মুখোমুখি এসে দাঁড়ায় মমতা।

: তুমি কাঁদছ, ভাইয়া!

আশ্চর্য্য হয়ে যায় মমতা; এই বয়সে আমি কাঁদতে পারি, ওরা ভাবতে পারে না। সবাই জানে, আমি খুব শক্ত প্রকৃতির, সহজে ভেঙ্গে পড়ি না।

কাছে বসে মমতা, কতদিন আমরা ভাই-বোনেরা কাছে বসি না। হাসি-ঠাট্টা আনন্দ করি না, মা মারা যাওয়ার পর থেকে সবাই কেমন চুপসে গেছে। পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে ছোট ভাই ইমনটা টো টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি হতাশায় ভূগছি।

দুপুরে চা খাওয়ার অভ্যাস আমার অনেক দিনের। মমতাটা সংসারের টানাটানির মাঝেও এদিকে একটু খেয়াল করে।

আজকাল ওকে দেখলে আমার কষ্টটা আরো বেড়ে যায়। সংসার সামলাচ্ছে। বড় হয়েছে। বিয়ে দেয়া দরকার। কিন্তু পারছি না। পারছি না সংসার নিয়ে আমার কষ্টটা সবাইকে বুঝাতে। শুধু সে কষ্টের আগুনে নিজে নিজে পুড়ে মরছি।

হঠাৎ করে উঠোনে বাবার সাড়া পাওয়া যায়। কোথায় জানি গিয়েছিলেন। কাশতে কাশতে হাঁপাতে হাঁপাতে আসছেন। চমকে উঠি। বাবাকে কেমন ভয়ে ভয়ে থাকি। কতদিন বাবার সাথে কথা নেই। লেখাপড়া শেষে আমি তার ঘাড়ে-পিঠে অবাঞ্চিত জঞ্জাল। ইশ, আমার মতো বাড়ন্ত যুবক ঘরে রেখে এই বুড়ো বয়সেও তিনি সংসারের ঘানি টানছেন, টেনে যাবেন আজীবন। অথচ কত সাধ- আহ্লাদ বুকে নিয়ে জমিজমা বিক্রি করে তিনি আমাকে পড়িয়েছেন ।

: ভাইয়া, তুমি কেঁদো না। আমার কথা শোনো, চাকুরীর চিন্তা বাদ দিয়ে এবার তুমি খেত- খামার, এমন তরো একটা কিছু করো। দেখবে তোমার শ্রম ও মেধায় যাবতীয় দুঃখ ঘুচবে। তুমি সুখী ও স্বচ্ছল হবে। আমি প্রতিনিয়ত দোয়া করছি।

পিঠে হাত রেখে মমতা আমাকে সান্তনা দেয়। আশান্বিত করে।

এসএসসি না দেয়া বোনটার অমন মূল্যবান ও সুন্দর কথায় আমি অভিভূত হয়ে যাই। উদ্দীপ্ত হয়ে উঠি এবং এক মিনিটে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি।

হ্যাঁ, আমি আমার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব। তবে আর অফিসে অফিসে ঘুরব না। ডজন ডজন দরখাস্ত লিখব না, ইন্টারভিউ দেব না। বড় লোকের কৃপা প্রার্থনা করব না।

আজ এবং এ মুহুর্তেই বাবার সাথে খোলামেলা আলোচনা করে কৃষি বিষয়ক কর্মকান্ড শুরু করব। ক্রমান্বয়ে একটি বহুমুখি কৃষি খামার গড়ে তুলব। চৌদ্দ পুরুষের পেশা কৃষিকে আধুনিক ও উন্নত পদ্ধতিতে বাস্তবায়নে আমি আমার সমস্ত শ্রম ও মেধা ব্যয় করব। না আর চুপটি করে বিষণ্ন মনে শুয়ে বসে মূল্যবান দিন কাটাব না। কৃষি এবং একমাত্র কৃষিই হবে আমার পেশা। এ দিয়েই আমি আমার সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য-স্বচ্ছলতা আনব। এছাড়া মাথার উপর ছায়া হয়ে তো আছেনই আমার আজন্ম কৃষক বাবা । অতএব, হুর-রে। মাকে আমি বউ দেখাতে পারিনি। কিন্তু বাবা আছেন, ভাই বোনেরা আছে, আমি তাদের মুখে হাসি ফোটাব, মমতাকে ভালো দেখে বিয়ে দেব, বাবাকে সংসারের ঘানি থেকে মুক্তি দেব, ইমন আবার স্কুলে যাবে। মা জান্নাত থেকে দেখবেন, খুশী হবেন। হ্যাঁ, আমি পারব। পারব। অবশ্যই পারব।

মুহুর্তে আমার গোমভাব কেটে যায়। মমতার মাথায় আস্তে করে একটা থাপ্পর দিয়ে প্রসন্ন মনে আমি দৌড়াই বাবার ঘরের দিকে। মমতা আমার এমন কর্মতৎপরতায় মিটি মিটি হাসে।

 

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!