শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৯ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মো. ইব্রাহীম খান

একজন কর্মবীরের কথা বলছি



আমার শ্রদ্ধাশীল সহকর্মী বিশিষ্ট লেখক ও শিক্ষক মোঃ আব্দুর রউফ সাহেবের স্নেহধন্য ছাত্র আব্দুর রশীদ লুলু। তাঁর মাধ্যমে লুলু সাহেবের সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়। তিনি লেখালেখির করেন জেনে আমি তার প্রতি আকৃষ্ট হই। পরিচয়ের অল্পদিন পর তিনি নবগ্রাম হাজী মোঃ ছাইম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রয়াত প্রধান শিক্ষক আব্দুল মান্নান স্যারকে নিয়ে একটি স্মারক গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি নিজে সম্পাদক হিসেবে লেখা সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন জনের কাছে ছোটাছুটি করতে থাকেন। আমাকেও একটা লেখা দেয়ার জন্য বলেন। আমার অচেনা-অজানা একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদকে নিয়ে কিছু শুনা এবং কিছু অনুমান করে একটা লেখা খাড়া করি। তিনি আমার লেখাটি প্রকাশ করেন। পরিপাটি ছাপার অক্ষরে নিজের লেখাটি পড়ে তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার অন্তর ভরে উঠে। এর অল্পদিন পর তিনি “আনোয়ারা” নামে একটি সংকলন সম্পাদনা ধারাবাহিকভাবে শুরু করেন। আনোয়ারা তার মরহুমা মাতার নাম। মায়ের নামেই তিনি ম্যাগাজিনটি ছাপিয়ে যাচ্ছিলেন। অল্প দিনের মধ্যে আনোয়ারার দৃষ্টিনন্দন প্রকাশ, প্রচার-প্রসার সিলেটের পাঠকপাঠিকাদের প্রত্যাশা পূরণে সফল সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে স্থান করে নেয়। যদিও পরবর্তীতে পাঠকের চাহিদা অনুযায়ী আনোয়ারাকে বৈচিত্র্যময় করে তুলেছেন। সে ম্যাগাজিনেও তিনি আমার লেখা প্রকাশ করার সুযোগ করে দেন। এমনকি কয়েক সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি আমাকে “আনোয়ারা”র নিজস্ব প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করেন। আমি “আনোয়ারা”র জন্য মনপ্রাণ উজাড় করে কাজ করেছি। আনোয়ারা মূলত একটি শিকড় সন্ধানী ছোটকাগজ। এ কাগজটি শুরু থেকে আজ অবধি শিকড়ের সন্ধানে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। লুলু সাহেব নিজেও একজন শিকড় সন্ধানী লেখক। সাহিত্য, কৃষি ও হোমিওপ্যাথিসহ নানাবিধ বিষয়ে শেকড়ের খুঁজে তিনি তেড়ে বেড়াচ্ছেন বহুকাল ধরে। অত্যন্ত বিস্ময়কর ব্যাপার হলো প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে অবস্থান করেও তিনি অদ্যাবধি “আনোয়ারা” অর্ধশতাধিক সংখ্যা প্রকাশ করেছেন। এটি তার সিদ্ধহস্ত সম্পাদনার অনন্য দৃষ্টান্ত। উল্লেখ্য ১৯৮৩ সাল থেকে আব্দুর রশীদ লুলুর লেখা প্রকাশিত হচ্ছে এবং সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত আছেন।

তার উৎসাহ ও বলিষ্ঠ সম্পাদনার মাধ্যমে গড়ে উঠেছেন অনেক লেখক। লেখালেখিতে যাদের অনেকেই আজকে স্থানীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। এখানে একটি কথা অবশ্য স্বীকার করতে হয়। আমি লেখালেখি করতাম অনেক আগে থেকেই। ছিটাফোঁটা লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশের ব্যাপারটা আমি সঠিকভাবে বুঝতাম না। তিনি প্রথমে তার সম্পাদিত ম্যাগাজিনে আমার লেখা ছাপান। পরবর্তীতে তিনি “দৈনিক সিলেট বাণী”, “দৈনিক সিলেটের ডাক”, “দৈনিক কাজীর বাজার”, “আজকের মাসিক বিশ্ব বাংলা” প্রভৃতি পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হওয়ার পথটা তিনিই আমাকে দেখিয়েছিলেন। সেসব পত্রিকায় আমার অনেক লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এইসব প্রকাশিত লেখা নিয়ে আমার বেশ কিছু বইও প্রকাশ পেয়েছে। সেজন্য আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ।

আব্দুর রশীদ লুলু আরও অনেকগুলো সংকলনের সম্পাদনা করেছেন। উল্লেখ করা যেতে পারে- প্রগতি, রক্তজবা, আব্দুল মান্নান স্মারক, আব্দুল মান্নানঃ ঝরে যাওয়া এক নক্ষত্র, আল বির (শাহ আব্দুল করিম সংখ্যা) ও যতীন্দ্র মোহন সোম স্মারক প্রভৃতি। তার দক্ষ হাতের ছোঁয়ায় প্রকাশিত হয়েছে অনেক নবীন লেখকদের বই। তিনি নিজেও একজন ভালো লেখক। সিলেটের স্থানীয় দৈনিক পত্রপত্রিকা, সংকলন এমনকি ঢাকা ও দেশের বাইরে বিভিন্ন পত্রিকায় তার প্রচুর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তিনি আজও নিয়মিত লিখে যাচ্ছেন। তার কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো- হৃদয়ে মম ও তিন কণ্ঠ। তার আরও অনেকগুলো বই প্রকাশের প্রস্তুতি চলছে। আশা করা যায়, অদূর ভবিষ্যতে এ গ্রন্থগুলো পাঠকের হাতে পৌঁছে যাবে এবং বহুমাত্রিক এ লেখকের সেসব বই পাঠে পাঠক নানাভাবে উপকৃত হবেন।

আব্দুর রশীদ লুলু লেখালেখির পাশাপাশি একজন দক্ষ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক। তিনি সিলেট জালালাবাদ হোমিওপ্যাথি কলেজ থেকে ডিএইচএমএস ডিগ্রি অর্জন করেছেন। দীর্ঘ বছর ধরে তিনি হোমিওপ্যাথি পদ্ধতিতে চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছেন। গরিব-দুঃখী রোগীদের বিনামূল্যে কিংবা নামমাত্র অর্থের বিনিময়ে তিনি চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন। তিনি শুধুমাত্র চিকিৎসা সেবা দিয়ে ক্ষান্ত নন। হোমিওপ্যাথি শাস্ত্র বিষয়ের ওপর একজন বিজ্ঞ লেখক। ১৯৯১ সাল থেকে তিনি হোমিওপ্যাথির ওপর নিয়মিত লিখে আসছেন। দেশের বিভিন্ন দৈনিক পত্রপত্রিকা, পারিবারিক চিকিৎসা, মাসিক হোমিও চেতনা, বালাগঞ্জ প্রতিনিধি ও আনোয়ারায় হোমিওপ্যাথি বিষয়ে তার বহু আর্টিকেল প্রকাশিত হয়েছে। যা পাঠে নবীন-প্রবীণ হোমিও চিকিৎসকগণ প্রতিনিয়ত উপকৃত হচ্ছেন।
আব্দুর রশীদ লুলু সময়ের সাথে সংগতি রেখে লেখালেখির জীবনকে বৈচিত্র্যময় করে তুলেছেন। তিনি ২০০৯ সাল থেকে কৃষিবিষয়ক লেখার সংগে যুক্ত হন। কৃষি প্রধান বাংলাদেশে কৃষি এবং কৃষকের নানামুখী অবস্থা, ব্যবস্থা, উন্নয়ন ও অন্যান্য দিক নিয়ে তিনি নিয়মিত প্রবন্ধ লিখে যাচ্ছেন। কৃষির কল্যাণমুখী চিন্তা-ভাবনায় তার পুরো পরিবার জড়িত। সেই ভাবনা মাথায় রেখে তারা কৃষি ও কৃষকের জন্য সেবামূলক কাজ করে যাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তার একমাত্র পুত্র আনিসুল আলম নাহিদ “চাষাবাদ” নামে একটি ছোটকাগজ সম্পাদনা করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে সে অত্যন্ত সচেতনতার সঙ্গে তিনটি সংখ্যা প্রকাশ করেছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রাজ্ঞ ও গুণীজনের লেখায় বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষকের সম্ভাবনা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা উঠে আসছে এ ম্যাগাজিনের মাধ্যমে। এ পত্রিকা পাঠে উপকৃত হচ্ছেন কৃষক ও কৃষির সঙ্গে জড়িত সকল শ্রেণির মানুষ। এ পত্রিকার রস সংগ্রহ করে অত্যাধুনিক কৃষি ব্যবস্থাপনা আরও জোরদার হওয়ার সম্ভাবনা অসম্ভব নয়। কৃষি নির্ভর বাংলাদেশে দিনদিন এ সংকলনের পাঠকপ্রিয়তা বেড়ে আকাশচুম্বী হওয়ার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কেননা ইতোমধ্যে এ ছোটকাগজটি কৃষি ও কৃষকের কল্যাণে কাজ করে সবার সুদৃষ্টি অর্জনে সক্ষম হয়েছে।

আব্দুর রশীদ লুলু বহু প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা; যেমন- ১. আনোয়ারা হোমিও হল গ্রন্থাগার ও আর্কাইভ, ২. আনোয়ারা ফাউন্ডেশন, ৩. রাজীব স্মৃতি গ্রন্থাগার এবং ৪. মরহুম আব্দুল মালিক হোমিও দাতব্য চিকিৎসালয়। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে চারপাশের মানুষ নানাভাবে উপকৃত হচ্ছেন।

আব্দুর রশীদ লুলু একজন অসাধারণ কর্মবীর। তিনি লেখক এবং হোমিও চিকিৎসক। একজন অনন্য মানবিক মানুষ হিসেবে এক বিশাল কর্মযজ্ঞের শুভ সূচনা শুরু করেছেন। এ প্রসঙ্গে তার নিজের লেখা থেকে অংশ বিশেষ তুলে ধরা হলো, “মরহুমা আনোয়ারা বেগম ছিলেন বাংলার এক দুঃখী নারী এবং আমার গর্ভধারিণী মা। যিনি বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে মাত্র ছয় মাস বয়সে আমাকে রেখে বিনা চিকিৎসায় অকালে মারা যান ভাদ্রের এক বাদলা দিনে। ছোটবেলায় বিশেষত হাই স্কুলে পড়াকালীন সময় থেকে দুঃখের সাগরে ভাসতে ভাসতে আমি ভাবতাম বড়ো হলে একদিন আমি আমার দুঃখিনী মায়ের নামে সামাজিক একটা কিছু করবো। যাতে আমার মা মরহুমা আনোয়ারা বেগমকে ভালো কাজের মাধ্যমে স্মরণীয় করে রাখা যায়। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার বাইরে বিশেষত কথাসাহিত্য পড়তে পড়তে ভাবতাম মা’র নামে একটা গ্রন্থাগার করা যায়। যেখানে জ্ঞান চর্চার অপার সুযোগ আমার জন্য এবং সবার জন্য সহজ হবে। কখনো কখনো মায়ের নামে একটা বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করার কথা ভেবে বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছি। যাতে অবহেলিত বঞ্চিত-নির্যাতিত নারীদের সচেতন করা যায়, জাগরণের মন্ত্রে উজ্জীবিত করা যায়। মায়ের অভাব রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করে অনেক চোখের জল ফেলেছি। ২০১৪ সালের ১লা জানুয়ারি স্বল্প সঞ্চয় দিয়ে ভয়ে ভয়ে শুরু করি আনোয়ারা ফাউন্ডেশন।”

মরহুমা মাতার আনোয়ারা নামকে স্মরণীয়-বরণীয় করে রাখার জন্য পাগলপ্রায় পুত্র আব্দুর রশীদ লুলু। এনিয়ে তার সংগ্রাম, সাধনা আজকে অনেকটাই সফলতার পথে। তার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে তিনি গড়ে তুলেছেন মানব ও প্রকৃতি কল্যাণধর্মী প্রতিষ্ঠান “আনোয়ারা ফাউন্ডেশন”। পারিবারিক ক্ষুদ্র সঞ্চয় থেকে আনোয়ারা ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম শুরু করেন তিনি। তার মনে লালিত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে সহযোগিতা হাত বাড়ান তার স্ত্রী ও সস্তান। ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ইতোমধ্যে তিনি মানব ও প্রকৃতি কল্যাণমূলক ছোটছোট কিছু কাজ করেছেন। বিশেষ করে বর্তমানে তার পুত্র আনিসুল আলম নাহিদের দক্ষ পরিচালনায় ফাউন্ডেশনের যাবতীয় কর্মকান্ড নতুনত্ব লাভ করেছে। পরিবারের সদস্যগণ জীবন যাপন করে ফাউন্ডেশনের আর্থিক খাতকে সমৃদ্ধ করে তুলছেন। আত্মীয়স্বজন ও অন্য কারো আর্থিক সাহায্য গ্রহণ করতে তিনি আগ্রহী নন। নিজেদের আয় রোজগার দিয়ে ফাউন্ডেশনকে স্বাবলম্বী করে তুলতে চান। আশা করা যায়, অদূর ভবিষ্যতে এ ফাউন্ডেশনের সার্বিক কার্যক্রম স্থানীয় ও জাতীয়ভাবে অমূল্য অবদানে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে, অভাবী ও স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য আনোয়ারা ফাউন্ডেশন অবদান রাখবে। প্রাকৃতিক দূর্যোগে কিংবা দৈবাৎ দূর্ঘটনায় আনোয়ারা ফাউন্ডেশন দুর্বার গতিতে এগিয়ে আসবে এমন প্রত্যয় ফাউন্ডেশনের স্বত্বাধিকারীদের। এ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করে তিনি বাকি জীবন অতিবাহিত করতে বদ্ধপরিকর। এ লক্ষ্যে ফাউন্ডেশন কেন্দ্রীক বহুমুখী সেবামূলক কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

আব্দুর রশীদ লুলুর মাতৃভক্তির সঙ্গে অন্য কারো মাতৃভক্তি তুলনা করতে চাইনা। তার মাতৃভক্তি অতুলনীয়। তিনি মরহুম মাতার জন্য যা করে যাচ্ছেন তা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তার সার্বিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে শিক্ষা নেওয়ার মতো। যে কেউ তাকে অনুসরণ-অনুকরণ করে নিজেকে স্মরণীয় বরণীয় করে রাখার মতো উপকরণ খুঁজে পাবেন। আমি উত্তরোত্তর তার সকল কর্মকান্ডের উন্নতি কামনা করি।

লেখক: মো. ইব্রাহীম খান, সহকারী প্রধান শিক্ষক, কোনারাই আনোয়ার হোসেন উচ্চ বিদ্যালয়, বিশ্বনাথ, সিলেট

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!