শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৫ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আব্দুর রশীদ লুলু

চাষাবাদ বিষয়ক টুকিটাকি-২৪



 দেশি জাতের একটি ভালো কলা চাঁপাকলা (চাম্পা কলা)। কিন্তু গুরুত্ব সহকারে এ কলা বাণিজ্যিকভাবে দেশে চাষাবাদ করা হয় না বললেই চলে। কলা চাষাবাদের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকেই এখন বলছেন, বাণিজ্যিকভাবে চাঁপাকলা উপযুক্ত পরিচর্যার মাধ্যমে চাষাবাদ করা হলে সাগরকলা বা সবরিকলার চেয়ে লাভজনক হতে পারে। উল্লেখ্য, সাগরকলা বা সবরিকলার তুলনায় চাঁপাকলার চাহিদা দেশে প্রায়ই বেশি দেখা যায়। এ ছাড়া পুষ্টি ও স্বাদে চাঁপা কলা উন্নতমানের। এ জাতের পাকা কলায় সহজে পচন ধরে না এবং অনায়াসে ঘরে ২/৪ দিন পাকা কলা রাখা যায। দেশে সাধারণত: অবহেলায়-অযত্নে (সার এবং পরিচর্যা ছাড়াই) বসত বাড়ির আশে-পাশে ও পতিত জমিতে চাঁপাকলা চাষাবাদ করা হয়। সার্বিক বিবেচনায় চাঁপাকলা চাষাবাদে সংশ্লিষ্টদের যত্নবান হওয়া উচিৎ।

 দেশের রবি মৌসুমের একটি অতিপরিচিত সবজি হলো মুলা। তবে এখন প্রায় সারা বছরই দেশে মুলা উৎপাদিত হয়। এর চাষাবাদের জন্য পানি নিষ্কাশনের সুবিধা সম্বলিত জমি প্রয়োজন। কম খরচে এবং কম সময়ে এর উৎপাদন সম্ভব। রবি মৌসুমে চাষাবাদের জন্য সেপ্টেম্বর-নভেম্বর পর্যন্ত বীজ বোনা হয়। পূর্ব প্রস্তুতকৃত জমিতে বীজ ছিটিয়ে বোনা গেলেও বিশেষজ্ঞরা বলেন বীজ সারিতে বোনা ভালো। এতে বীজের পরিমাণ কম লাগে এবং পরিচর্যায় সুবিধা হয়। সারিতে বীজ বুনতে ৩/৪ সে.মি. দূরে দূরে বীজ ফেলে ঝুরঝুরে মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হয়। সাধারণত: বীজ বোনার ৪০-৪৫ দিনের মধ্যে মুলা খাওয়ার/বাজারজাত করণের উপযোগি হয়।

 পেঁয়াজের বিকল্প হিসেবে দেশে পত্র বহুল নেগী চাষাবাদের কথা বলছেন কোনো কোনো গবেষক। তাঁরা বলছেন, এর চাষাবাদে আর্থিকভাবে লাভমান হওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর। বাংলাদেশে চাষাবাদ উপযোগী তিনটি নেগী হচ্ছে- সাউ নেগী-১, সাউ নেগী-২ এবং সাউ নেগী-৩। দেশী পেঁয়াজের বিকল্প হিসেবে পত্র বহুল নেগী চাষাবাদে গুরুত্ব দেয়ার অন্যতম কারণ- বারি পেঁয়াজ ২ এবং ৩ খরা মৌসুমে চাষ উপযোগি হলেও অন্যান্য জাতের পেয়াঁজ শীতকালেই চাষাবাদ করা হয়। পক্ষান্তরে দেশে নেগী সারা বছরই চাষাবাদ সম্ভব। এ ছাড়া মসলা হিসেবে নিত্য ব্যবহৃত পেঁয়াজের ঘাটতি দেশে অনেক। দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজ চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ মাত্র পূরণ করে থাকে। বাকীটা বিদেশ থেকে আমদানী করতে হয়। জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ মাটিতে নেগী ভালো হলেও পানি সুনিষ্কাশিত যে কোনো মাটিতেই নেগীর চাষাবাদ সম্ভব। পেঁয়াজের মতো বীজতলায় চারা উৎপাদন করে নেগী পূর্ব প্রস্তুতকৃত মূল জমিতে লাগাতে হয়। উল্লেখ্য, নেগীর স্বাদ ও গন্ধ হুবহু পেঁয়াজের মতো বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। তাঁরা আরো বলছেন, নেগী দিয়ে রান্নার স্বাদেরও কোনো কমতি হবে না।

 দেশের উদ্যান কৃষি গবেষকদের ধারণা, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি ভূমি লেবু জাতীয় টক (সাইট্রিক) ফল চাষাবাদের আদি স্থান। বাস্তবেও দেখা গেছে, অন্য ফল-ফসলের চেয়ে লেবু জাতীয় টক ফল ওখানে ভালো হয়। সে প্রেক্ষিতে বলা যায়, দেশের পার্বত্য অঞ্চল, সিলেট ও শ্রীমঙ্গলসহ দেশের অন্যান্য পাহাড়ি অঞ্চলে লেবু জাতীয় ফলের চাষাবাদ লাভজনক। দেশে এবং বিদেশে লেবু জাতীয় টক ফলের চাহিদাও প্রচুর। উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় লেবু জাতীয় টক ফলের সংখ্যা অনেক। সেখানে উদ্যান কৃষি গবেষকরা অনুসন্ধান চালিয়ে ৩৬২ ধরণের লেবু জাতীয় টক ফলের সন্ধান পেয়েছেন।

 পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, হাওর ও বিল-ঝিল থেকে ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে দেশি প্রজাতির সুস্বাদু মাছ। রসনা বিলাস বাঙ্গালী জাতির জন্য বিষয়টা নিতান্ত দু:খজনক। বিশেষজ্ঞ ও সচেতন মহলের তাই বক্তব্য, দেশি প্রজাতির মাছ চাষ ও রক্ষণাবেক্ষণে এখনই মনোযোগি হওয়া উচিৎ। কারেন্ট জাল, ভীম জাল, কাপড়ি জাল প্রভৃতি দিয়ে মাছ ধরার পাশাপাশি প্রায়ই হাওর, খাল-বিল, পুকুর-নালা শুকিয়ে নির্বিচারে মাছ ধরা দেশিয় প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির অন্যতম কারণ। উল্লেখিত পদ্ধতিতে নির্বিচারে মাছ ধরা থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি পরিকল্পিত উপায়ে দেশিয় মাছ চাষ করা অনায়াসে সম্ভব। দেশে দেশিয় প্রজাতির মাছের চাহিদা প্রচুর। সে হিসেবে দেশিয় ছোট মাছসহ সব ধরণের মাছ বাণিজ্যিকভাবে চাষ অবশ্যই লাভজনক। উল্লেখ্য, সংশ্লিষ্ট পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দেশিয় প্রজাতির শতাধিক মাছ ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পরিস্থিতির আরো অবনতি রোধ করতে তাই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সুনির্দিষ্ট নদী-বিল-হাওরের মতো মাছের প্রাকৃতিক আবাসস্থল সংরক্ষণ করা অতি জরুরি।

 চাষাবাদের জন্য দরকার কৃষি জমি। কৃষি জমিকে অকৃষি খাতে ব্যবহারের ফলে প্রতি বছর দেশে মোট জমির ১% হারে কৃষি জমি কমছে। যা চাষাবাদের জন্য নি:সন্দেহে উদ্বেগের বিষয়। বিশেষ করে দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চাষাবাদ তথা খাদ্য নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় কৃষি জমির অকৃষি খাতে ব্যবহার রোধ করতে হবে। প্রয়োজনে এ বিষয়ে কঠোর আইন করতে হবে। উল্লেখ্য, বর্তমানে দেশে কৃষি জমি যে কেউ ইচ্ছে মতো যে কোনো কাজে ব্যবহার করছে।

 দেশে এখন ফুল- ফল, শাক-সবজি, বনজ, ভেষজ ও ফলদ চারার ক্রমাগত চাহিদার প্রেক্ষিতে নার্সারি একটি সফল ব্যবসা হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রেও অন্যান্য কৃষি বিষয়ক কর্মকান্ডের ন্যায় প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা প্রয়োজন। নার্সারি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদানকারী কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান হলো- বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক এবং প্রশিকা। গ্রামের পাশাপাশি এখন অনেকেই শহরে বাসা-বাড়ির ছাদেও নার্সারি করছেন। দোআঁশ বা বেলে দোআঁশ মাটি গাছের চারা উৎপাদনের জন্য বিশেষভাবে উপযোগি। বীজ থেকে চারা উৎপাদনের জন্য ভালো বীজ এবং গ্রাফটিং, লেয়ারিং কিংবা কাটিং এর মাধ্যমে চারা উৎপাদনের জন্য অবশ্যই ভালো এবং উন্নতমানের মাতৃগাছ নির্বাচন করতে হবে। বর্ষায় পানি ওঠে না এবং প্রচুর আলো-বাতাস খেলে যায় এমন জায়গা নার্সারির জন্য নির্বাচন করতে হয়। অনেকেই নার্সারিকে স্বল্প পূঁজির কৃষি বিষয়ক একটা ভালো ব্যবসা বলে মনে করেন। ধারণা করা হয়, দেশে বারো হাজারের মতো নার্সারি বর্তমানে রয়েছে। এতদসত্ত্বেও চাহিদার তুলনায় এ সংখ্যা পর্যাপ্ত নয় বলে অনেকের ধারণা। বলা বাহুল্য চাষাবাদের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো নার্সারিতেও সাফল্যের জন্য আগ্রহ, দক্ষতা ও উদ্যম থাকতে হবে।

লেখক: সম্পাদক – আনোয়ারা (শিকড় সন্ধানী প্রকাশনা)।

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!