আমি ‘সোম বাবু’র কথা প্রায় ভুলতে বসেছিলাম। ২০০৪ সালে “আব্দুল মন্নান স্মারক গ্রন্থে’র সম্পাদনা কাজে ছুটাছুটি করতে গিয়ে আবার তাঁর কথা আমার মনে পড়ে। মনে পড়তে সাহায্য করেন সোম বাবুর দৌহিত্র বাংলাদেশ ডাক বিভাগে কর্মরত কবিতাকর্মী শ্যামল কান্তি সোম। তারা মন্নান স্যার সম্পর্কে তাদের লেখায় ‘সোম বাবু’র কথা টানেন। আমি চৈতন্য ফিরে পাই। স্মৃতিকাতর হই। শিকড়ের সন্ধানে হই উদ্দীপ্ত।
পারিবারিক টাইটেল ‘সোম’-এর পরিচয়ে ‘সোম বাবু’ নামে ব্যাপক পরিচিত ছিলেন তিনি। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল যতীন্দ্র মোহন সোম। বাংলা ও সংস্কৃতিতে ছিলো তাঁর অগাধ দখল। যদিও তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত। আমার মনে পড়ছে, একবার (সম্ভবত: ১৯৮০ সালে) আমাদের হাই স্কুল (নবগ্রাম হাজী মোঃ ছাইম উচ্চ বিদ্যালয়, মাদার বাজার, ওসমানীনগর, সিলেট)-এ তখনকার সম্মানিত এস.ডি.ও মহোদয়ের আগমণ উপলক্ষে ছাত্র-শিক্ষকসহ এলাকার সর্বস্তরের মানুষের উপস্থিতিতে স্কুল প্রাঙ্গণে এক জাঁকজমকপূর্ণ সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে আয়োজন করা হয়। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী উক্ত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করার কথা আমাদের শ্রদ্ধেয় প্রধান শিক্ষক আব্দুল মন্নান (মরহুম) সাহেবের। কিন্তু তিনি অনুষ্ঠানের শুরুতেই মাইক নিয়ে ঘোষণা করলেন, অনুষ্ঠানে তাঁর সভাপতিত্ব করার কথা থাকলেও তিনি অনুরোধ করছেন তাঁর পিতৃসম, জ্ঞানবৃদ্ধ, বয়োবৃদ্ধ বাবু যতীন্দ্র মোহন সোমকে সভাপতির আসন অলংকৃত করার জন্য।
প্রথমদিকে আমরা সেদিন মনেমনে খুব ফুঁসে ছিলাম। কিন্তু সোম বাবু যখন সভাপতির ভাষণ দিলেন, তখন আমাদের মন ভালো হয়ে গেলো। তাঁর বাচন ভঙ্গি, বক্তৃতার উপস্থাপনা, সুন্দর-সাবলীল শব্দ প্রয়োগ আমাদের মুগ্ধ করে। এমন সুন্দর ও জ্ঞানগর্ভ ভাষণ আমি জীবনে খুব বেশী শুনিনি। এর বছর দু’য়েক আগ থেকে তাঁকে চিনলেও আমরা তাঁকে তেমন গুরুত্ব দিতাম না। সেদিন থেকে তিনি আমার একজন প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। পথে-ঘাটে, হাটে-বাজারে দেখা হলে, তাঁকে স্বতঃস্ফুর্ত চিত্তে ‘আদাব’ দিতাম। তিনি প্রতিউত্তরে “আমার আদাব, আমার আদাব” বলতেন সবিনয়ে। এখনও যেন সেই “আমার আদাব, আমার আদাব” মধুর কণ্ঠ আমার কানে বাজছে। এই জীবনে অনেককে আমি ‘আদাব’ দিয়েছি, কিন্তু সেই মধুর প্রতিউত্তর “আমার আদাব, আমার আদাব” আর কখনো কোনো মুখ থেকে শুনিনি। বাকী জীবনে কখনো শুনবো কি না কে জানে!
পরবর্তীতে শুনেছি, আমার জীবনের অন্যতম ‘সেরা স্যার’ মরহুম আব্দুল মন্নান (১৯৪৯-২০০৪) স্যার তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন; ভালোবাসতেন। সময় সুযোগে তাঁর সান্নিধ্যে সময় কাটাতেন, তাঁর বাড়ীতে নিজ থেকে অনেক সময় যেতেন। তিনিও নাকি তাঁকে (আব্দুল মন্নান স্যারকে) পুত্রের ন্যায় স্নেহ করতেন।
তাঁর বাড়ী ছিল মাদার বাজার এলাকার লতিবপুর গ্রামে। আমার নানার বাড়ি পার্শ্ববর্তী ধনপুর গ্রামে। পড়াশোনা ও নানাবিধ কারণে আমি মাদার বাজার এলাকায় প্রায় দশ বছর কাটিয়েছি। সে সুবাদে কাছে থেকে-দূরে থেকে আমি তাঁকে অনেক দেখেছি। ছাত্রাবস্থায় বিভিন্ন সময়ে ইচ্ছে করেছে সোম বাবুর একান্ত সান্নিধ্যে যেতে এবং তাঁর কাছ থেকে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করতে। সে অনুযায়ী একরাতে আমাদের জুনিয়র অথচ বন্ধু স্থানীয় মোঃ আব্দুল ওয়াহিদ (মরহুম) কে নিয়ে তাঁর বাড়ীতে যাই। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারিনি। সাদামাটা কিছু কথা-বার্তা হয়। তিনি বিনয় করেন। আমরা পরে আবার যাবো বলে উঠে পড়ি। কিন্তু নানা কারণে পরে আর আমার যাওয়া হয়নি।
দূর-দূরান্তে তাঁর ডাক পড়তো বিচার-শালিশীর জন্য। তিনি খুব নাম করা ‘বিচারী’ ছিলেন। সে কথা এখনও মানুষ যেন বলাবলী করেন। প্রায়ই আমার নিজের কানে শুনি। এখনো অনেকে আক্ষেপ করে তাঁকে দেখতে পায়নি বলে। আমি মুগ্ধ হই, মৃত্যুর এতকাল পরও আমার চেনা-জানা জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব সোম বাবুর মূল্যায়ন দেখে।
প্রয়াত যতীন্দ্র মোহন সোম সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়, তাঁর পিতা ছিলেন প্রয়াত ভারত চন্দ্র সোম। জন্ম সিলেট জেলার বালাগঞ্জ উপজেলার লতিবপুর গ্রামে ২০ জুন ১৯০৯। মৃত্যু ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ নিজ বাড়ীতে। তিনি আজীবন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। দীর্ঘদিন বালাগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতিও ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন ভারতে বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে তিনি ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব পালন করেন। প্রাক্তন মন্ত্রী জাতীয় সংসদ সদস্য জনাব দেওয়ান ফরিদ গাজীর সাথে তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে ১৯৯৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক তিনি বিশেষ পুরস্কার লাভ কনে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এমন মানুষের জন্ম-মৃত্যু তারিখ খুব চুপিচুপি অতিবাহিত হয়। দলীয় ও নির্দলীয় কোন বিশেষ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তাঁকে মনে করেন না। শুধুমাত্র সাধারণ মানুষের মুখে মুখে এখনও ‘বিচারী’ সোম বাবুর কথা উচ্চারিত হয় স্বতঃস্ফুর্তভাবে। তাঁর পরিবার-পরিজন ও শুভানুধ্যায়ীদের সহযোগিতায় আনোয়ারা ফাউন্ডেশন থেকে তাঁর স্মরণে কিছু একটা করার কথা আমরা ভাবছি। যদিও আমার সম্পাদনায় তাঁর একশ একতম জন্মদিনে (২০ জুন ২০০৯) ৩ ফর্মার একটা ছোট্ট স্মারক প্রকাশিত হয়েছে যেটাতে দেওয়ান ফরিদ গাজীসহ অনেকেই লিখেছেন এবং সেটা আনোয়ারা ফাউন্ডেশন পরিচালিত রাজীব স্মৃতি গ্রন্থাগারে বর্তমান ও ভবিষ্যত পাঠকের জন্য যত্নে সংরক্ষিত আছে।
যা হোক, পেশাগত কারণে তখন আমি মাদার বাজার এলাকা থেকে ছিঁটকে পড়লেও সোম বাবুর মৃত্যুর দিন (১৭ নভেম্বর ১৯৯৯) ঘটনাক্রমে মাদার বাজার পৌঁছি। মানুষজন মুখে মুখে তাঁর কথা বলাবলি করছিল। তাঁর নাকি খুব শান্তিতে মৃত্যু হয়েছে। মানুষজন এ-ও বলছিল-“ভালো মানুষ ছিলেন, আল্লাহ তাই তাঁকে শান্তিতে মৃত্যু দিয়েছেন।”
আমি আর বেশী কথা বলব না, শুধু একান্ত মনে চাইব, এই বাংলার ঘরে ঘরে জ্ঞানী ও বিনয়ী মানুষের জন্ম হোক। মূল্যায়ন হোক ভালো, ভদ্র ও জ্ঞানী মানুষদের।
লেখক: সম্পাদক – আনোয়ারা (শিকড় সন্ধানী প্রকাশনা)