শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৬ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আব্দুর রশীদ লুলু

মরহুম আব্দুল মন্নান: আমার প্রিয় শিক্ষক



মরহুম আব্দুল মন্নান (১৯৪৯-২০০৪) স্যার ছিলেন আমার অন্যতম প্রিয় শিক্ষক। যিনি মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে অনেকটা অকালে বিগত ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৪ ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যু সংবাদ আমাকে এবং আমার মতো তাঁর অসংখ্য ছাত্র/ছাত্রী, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, সহকর্মী- শুভানুধ্যায়ীকে অত্যন্ত ব্যথিত করে। এখনও মরহুম স্যারের জন্য আমার মতো অনেকরই দীর্ঘশ্বাস ও আক্ষেপ ঝরে।

মরহুম আব্দুল মন্নান স্যারের স্মরণে ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে আমার সম্পাদনায় বেরিয়েছে “আব্দুল মন্নান স্মারক গ্রন্থ”। এতে স্যারের অনেক ছাত্র-ছাত্রী, সহকর্মী-শুভানুধ্যায়ী এবং গুণীজন লিখেছেন। লিখেছেন স্যারের জীবন ও কর্ম নিয়ে। আমি আশ্চর্য্য হয়েছি, স্যারের জীবনের অনন্য বিভিন্ন দিক দেখে। এই সমাজে এমন মানুষ, এমন শিক্ষক সত্যি সত্যি বিরণ। “আব্দুল মন্নান স্মারক গ্রন্থে”র জন্য আমাকে প্রচুর ছুটাছুটি করতে হয়েছে, পরিশ্রম করতে হয়েছে। কিন্তু স্মারক গ্রন্থটি সম্পন্ন করে আমার মনে হয়েছে আমার লেখালেখির জীবনে অন্যতম একটি ভালো কাজ করতে পেরেছি। সে কথা আমি তাই বিগত ১১ এপ্রিল ২০০৫ “আব্দুল মন্নান স্মারক গ্রন্থে”র প্রকাশনা অনুষ্ঠানে নির্দ্বিধায় বলেছি।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রকাশনা অনুষ্ঠানে সুধীজনেরা (মূলত বিভিন্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা) তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। প্রশংসা করেছেন তাঁর জ্ঞানের-কর্মের। আমি শুনে শুনে অভিভূত হয়েছি। নিজেকে ধন্য মনে করেছি, তাঁর মতো একজন জ্ঞানী ও সার্থক শিক্ষকের ছাত্র হতে পেরে।

যা হোক, আমার এই প্রিয় শিক্ষক সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার ইলাবাজ গ্রামে ১৯৪৯ সালের ৩০ জুন জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম মোঃ লকদ্দছ আলী ছিলেন একজন সম্পন্ন গৃহস্ত এবং প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। মাতা মরহুমা মোছাঃ রহিমা বেগম ছিলেন একজন সাধারণ গৃহিনী। চার ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। বি.কম, বি.এড ছাড়াও তিনি ছিলেন হোমিওপ্যাথির এইচ.এম.বি ডিগ্রীধারী। শিক্ষকতায় প্রথম যোগ দেন ১ ফেব্রয়ারি ১৯৭৪। শিক্ষকতা করেছেন যথাক্রমে- নবগ্রাম হাজী মোঃ ছাইম উচ্চ বিদ্যালয় (মাদার বাজার, বালাগঞ্জ, সিলেট) ও গণিপুর- কামালগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় (জকিগঞ্জ, সিলেট)-এ। ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে তিনি শিক্ষকতা থেকে অবসর গ্রহণ করেন ৩১ আগস্ট ২০০৩। ১৯৯০ সাল থেকে তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি হোমিও প্রাকটিস্ করেন- মোনালিসা হোমিও ফার্মেসী, বাবুর বাজার, জকিগঞ্জ, সিলেটে। শিক্ষকতার ন্যায় হোমিও চিকিৎসায়ও তিনি সফলতা অর্জন করেন। অনেক জটিল রোগী তাঁর হাতে আরোগ্য লাভ করে। তাঁর বড় ছেলে মোঃ মহসিন মূল্ক (মহসিন)-এর লেখা থেকে জানা যায়, অনেক দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ জন আসতো তাঁর কাছ থেকে ঔষধ নিতে। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, তিন ছেলে, দুই মেয়েসহ অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী, সহকর্মী-শুভানুধ্যায়ী, আত্মীয়-স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। সংক্ষেপে এই আমার প্রিয় স্যার মরহুম আব্দুল মন্নান।

নবগ্রাম হাজী মোঃ ছাইম উচ্চ বিদ্যালয় (মাদার বাজার, বালাগঞ্জ, সিলেট)-এ আমি তাঁর কাছে পড়াশোনা করেছি। আদর-শাসন পেয়েছি। তিনি ওই স্কুলে প্রধান শিক্ষক থাকাকালীন ১৯৮২ সালে আমি এসএসসি পাশ করি। স্যারের সহৃদয় সহযোগিতা-আন্তরিক উপদেশ-পরামর্শ না পেলে আমার পক্ষে এসএসসি পাশ করা নিঃসন্দেহে কঠিন হতো। মনে পড়ে দশম শ্রেণীতে কোনো এক পরীক্ষায় আমি বাংলায় একষট্টি নাম্বার পেলে স্যার খুব খুশী হন। আমার অত্যন্ত ভালো লাগে, তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরে।

তিনি মাদার বাজার এলাকায় ‘বিকম স্যার’ হিসেবে ব্যাপক পরিচিত ছিলেন। একদিনের ঘটনা- এ.টি স্যার (শ্রদ্ধেয় মোঃ আব্দুর রউফ, যিনি একজন ভালো লেখকও)-এর উপস্থিতিতে আমি তাঁকে বি.কম স্যার সম্বোধন করলে এ.টি স্যার আমার প্রতি খুব রাগ করেন- ‘হেড স্যার বলতে পারো না?’
আমি লজ্জায় কুণ্ঠিত হই। মরহুম স্যার শুধু মিটিমিটি হাসেন।

হাই স্কুল জীবনে আমরা অনেকটা লক্ষ্যহীন ছিলাম। স্যার বোধ হয়, আমাদের অবস্থথাটা আঁচ করে থাকবেন। একদিন আমাদের ডেকে পাঠালেন তাঁর অফিসে। খুব আস্তে-ধীরে আমাদের সাথে কথা বললেন। জানতে চাইলেন, জীবনে আমরা কে কি হতে চাই?

আমরা ভাবনায় পড়ে যাই। বিষয়টা আগে আমরা তেমন ভাবিনি। স্যারের জিজ্ঞাসার মুখে আমরা এক একজন এক একটা বলে যাই- যার মুখে যেটা আসে।
স্যার আমাদের উপদেশ দেন, যার যার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কঠোর পরিশ্রমী তথা পড়াশোনায় মনোযোগী হতে। আমি স্যারের কথায় প্রচুর উদ্দীপ্ত হই। জীবনের লক্ষ্য ঠিক করি এবং মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি, আমাকে এসএসসি পাশ করতেই হবে।

স্যার সম্পর্কে আমার অনেক কথা, অনেক স্মৃতি। তাঁকে নিয়ে ইতোমধ্যে আমি লিখেছি- “আমার শিক্ষক আব্দুল মন্নান স্যারকে মনে পড়ে” (জাগরণঃ ২৬ মার্চ ২০০৪) এবং “আব্দুল মন্নান স্যারঃ যিনি ছিলেন অনেক গুণে গুণান্বিত” (আব্দুল মন্নান স্মারক গ্রন্থঃ ডিসেম্বর ২০০৪)। তারপরও নিজের কাছে প্রশ্ন জাগে, আমি কি আমার প্রিয় মন্নান স্যারকে পুরোপুরি তুলে ধরতে পেরেছি? কিংবা স্যারকে নিয়ে আমার যত কথা, যত স্মৃতি তা কি লিখতে পেরেছি?

না, পারিনি। হয়তো এ জীবনে পারবও না। মরহুম আব্দুল মন্নান স্যারের কাছে আমি অনেকভাবে ঋণী। এ জীবনে সে ঋণ স্নেহ-ভালোবাসা পরিশোধ করা সম্ভব নয়। আমি শুধু চেষ্টা করছি-করব, স্যারের কথা মনে রাখার। স্যারের জন্য দোয়া করার।

লেখক: সম্পাদক- আনোয়ারা (শিকড় সন্ধানী প্রকাশনা)।

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!