শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১২ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
Sex Cams

দুর্বিন শাহ্-র সহজিয়া পদাবলি।। দীপংকর শীল



দুর্বিন শাহ্। ছবি: সংগৃহীত

আবহমান বাংলার লোকায়ত শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে পীর-আউলিয়া-দরবেশ, সাধু-গুরু-বৈষ্ণব, মরমি সাধক কবিদের মানবতাবাদের যে প্রকাশ আজও বিদ্যমান তারই উত্তরসূরি ‘জ্ঞানের সাগর’ উপাধি ভূষিত, অতীন্দ্রিয় বিষয় অভিজ্ঞ দুর্বিন শাহ্ (১৯২১-১৯৭৭)। তিনি অন্তরের স্বাভাবিক কবিত্বের প্রেরণায় রচনা করেছেন অজস্র গানের পদ। গানে গানে ‘পির-অলি-পয়গম্বর, যোগী-ঋষি-মুনিবর’দের মতো পরম জ্ঞানের অন্বেষণ করেছেন এবং ‘তৌরিত-জবুর-কোরান, বাইবেল-বেদ-পুরাণ’সহ সর্বশাস্ত্র অধ্যয়ন করে অবশেষে জেনেছেন ‘বিন্দুরূপী পরমাত্মা’কে। এসব গানে অন্য সকল মরমিয়া সাধকদের মতোই ধ্যানের অগোচর তাপস প্রভুর সান্নিধ্য কামনা করেছেন। গানের ভণিতায় তিনি নিজেকে ‘পাগল দুর্বিন শাহ্’,‘ফকির দুর্বিন শাহ্’, ‘খাদেম দুর্বিন শাহ্’, কবি দুর্বিন শাহ্’, ‘পল্লিকবি দুর্বিন শাহ্’ ইত্যাদি বলে পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর গান গেয়ে ভক্তগণ যেমন ধ্যান করেন তেমনি শ্রোতাগণও গানের সুরে মোহিত হন। গানে শুধু ভক্তিভাবের কথাই নয়, গূঢ়তত্ত্বদর্শনের পাশাপাশি সমাজ, স্বদেশ, রাজনীতি তথা জীবন ঘনিষ্ট কথাও ব্যক্ত হয়েছে। তাঁর রচিত গানগুলোর পর্যায় বিভাগ দেখলেই আমরা তাঁর সৃষ্টি ও দর্শন সম্পর্কে আভাস পেতে পারি। সুমন কুমার দাস সম্পাদিত ‘দুর্বিন শাহ সমগ্র’তে গানগুলো চৌত্রিশটি পর্যায়ে বিন্যস্ত হয়েছে। এই পর্যায়গুলো যথাক্রমে: আল্লাহ স্মরণে, নবী স্মরণে, নবিজির ওফাত শরিফ, কারবালা স্মরণে, পারঘাটা, মুর্শিদ স্মরণে, ওলি-আউলিয়া স্মরণে, আত্মতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, জীব-পরমতত্ত্ব, মারিফততত্ত্ব, মনঃশিক্ষা, দেহতত্ত্ব, কেয়ামত ও হাসর প্রসঙ্গ, সাধনতত্ত্ব, সংসারতত্ত্ব, আখেরতত্ত্ব, কামতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব, সখির সনে রাধার উক্তি, জটিলার সনে রাধার উক্তি, রাধার সনে সখির উক্তি, শ্যামের সনে সখির উক্তি, রাইবিচ্ছেদ, শ্যামবিচ্ছেদ, বিরহ আক্ষেপ, বারোমাসি, কোকিল সংবাদ, ভাটিয়ালি, সাক্ষাৎ, কুঞ্জভঙ্গ, গোষ্ঠ, সন্ন্যাসতত্ত্ব এবং বিবিধ পর্যায়ের গান।

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণব পদাবলি এক উল্লেখযোগ্য ধারা। তৎকালীন ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক পরিবেশে যখন মানুষে মানুষে ভেদাভেদ অতিমাত্রায় দেখা দিয়েছিল, আচার-স্বর্বস্বতার বাড়াবাড়িতে সমাজ-সংস্কৃতির ভিত্তিমূলকে তমসাবৃত্ত করে তুলেছিল সেই সময়ে শ্রীচৈতন্যদেব তাঁর প্রেমের অমৃতধারায় মানুষকে সিক্ত করলেন। তাঁর নতুন প্রেমবাদে উজ্জীবিত হলো মানুষ। গড়ে উঠল বৈষ্ণবতত্ত্বের নতুন কাঠামো। সমন্বয় হলো সুফি মতের সাথে ভক্তিধর্মের। ফলে উন্নীত হলো প্রেমধর্ম এবং জাগ্রত হলো মানব মর্যাদাবোধ।

বৈষ্ণব পদকর্তাগণ ¯্রষ্টা ও সৃষ্টির প্রতীক হিসেব রাধাকৃষ্ণকে অবলম্বন করে পদাবলি রচনা করেছেন। শুধু বৈষ্ণব মহাজনরাই বৈষ্ণব পদাবলি রচনা করেননি, অনেক মুসলমান পদকর্তাও অনেক উৎকৃষ্ট বৈষ্ণব পদাবলি রচনা করেছেন। ড. আহমদ শরীফের মতে- সুফি মতবাদের সঙ্গে বৈষ্ণবাদর্শের আত্যন্তিক সাদৃশ্য ও আচরণিক মিল থাকায় এবং জগৎ ও জীবনের চিরাবৃত্ত রহস্য, জীবাত্মা ও পরমাত্মার সম্পর্ক নির্ণয়ের কৌতূহল প্রভৃতি মানুষের মনে যে জিজ্ঞাসা জাগায়, তার সদুত্তর সন্ধান করতে দেশে বহুল প্রচলিত রাধাকৃষ্ণ রূপকের ব্যবহার করে সুফি মতাসক্ত বাঙালি মুসলমান কবিদেরকে বৈষ্ণব সাধনায় অনুপ্রাণিত করেছিল। তাঁরা বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষা নেননি; কিন্তু মরমি সাধক ও সুফিপন্থি হিসেবে হৃদয়ানুভূতি প্রকাশে রাধাকৃষ্ণ রূপক অবলম্বন করেছিলেন। এই ধারাতে অনুপ্রাণিত হয়ে মরমি সাধক কবি দুর্বিন শাহ রচনা করেছেন রাধাকৃষ্ণ রূপকাশ্রিত পদাবলি।

বৈষ্ণব প্রেমতত্ত্ব অনুসারে প্রেমকে বলা হয় ‘আনন্দ চিন্ময় রস’। প্রেমের এই আনন্দ একাধারে আস্বাদ্য ও আস্বাদক- নিজেকে নিজে আস্বাদ করতে পারে, অন্যকেও করাতে পারে। প্রাকৃত চিত্তের মালিন্য দূরীভূত হলে শুদ্ধ সত্ত্বের বৃত্তি হিসেবে বিশেষ প্রেমের প্রকাশ সম্ভব। প্রেমের উদয়ে লৌকিক মালিন্য দূরীভূত হয়ে যায়।

বৈষ্ণবীয় প্রেমতত্ত্বের এই ধারা সাধক মহলে প্রবাহিত। দুর্বিন শাহ্-র গানেও এই প্রেমতত্ত্বের প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। তাঁর প্রেম পারমার্থিক এবং এই প্রেমকে তিনি শুদ্ধপ্রেম হিসেবে দেখেছেন। অবশ্য তাঁর গানে স্বতঃস্ফূর্ত প্রেমেরও লক্ষণ আছে। স্বতঃস্ফূর্ত প্রেম কোনো সাধন-ভজনের অপেক্ষা রাখে না। ভালোবেসে যাওয়াতেই আনন্দ। এই আনন্দ উপভোগের জন্য বা প্রেমের রসরূপ আস্বাদনের জন্য রাধাকৃষ্ণের লীলা বিষয়ক পদাবলি রচনা করেছেন, গেয়েছেন এবং ভাবে তন্ময় হয়েছেন। এ জাতীয় পদাবলির অন্তরঙ্গ বিষয় বাদ দিলে বহিরঙ্গে যা পাওয়া যায় তা একান্তই মানবিক বা জগৎ-সংসারকেন্দ্রিক এবং তা সুখ-দুঃখ ভরা আখ্যান মাত্র।

দুর্বিন শাহ্ রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক যেসব পদ রচনা করেছেন তা অষ্টকালীন লীলাবিলাসের গোষ্ঠলীলা, পূর্বরাগ, আক্ষেপ, অভিসার, কুঞ্জভঙ্গ কিংবা নিমাই সন্ন্যাস প্রভৃতি পালার মতো কোনো পূর্ণাঙ্গ পালা রচনা করেননি। বিচ্ছিন্নভাবে অনেকটা রোমান্টিক প্রেমের কবিতার মতো নরনারীর সুখ-দুঃখ, বিরহ-বেদনাকে প্রকাশ করেছেন। এ ধরনের পদ রচনায় তাঁর স্বাভাবিক কবি মানসের আনন্দ উপভোগই ছিল মুখ্য। তিনি পূর্বরাগ থেকে শুরু করেছেন। পূর্বরাগে রয়েছে মধুর বা শৃঙ্গার রস। নরনারীর প্রেম বা রতি ভাব উদ্ভূত রসই শৃঙ্গার বা মধুর রস। মধুর রসের দুইটি বিভাগ- বিপ্রলম্ভ ও সম্ভোগ। বিপ্রলম্ভের রয়েছে চারটি বিভাগ। যেমন: পূর্বরাগ, মান, প্রেমবৈচিত্ত্য ও প্রবাস। মধুর রসের পদাবলিতে পূর্বরাগ প্রেমাভিব্যক্তির তথা রসপর্যায়ের সূচনা স্তর। কৃষ্ণকে দেখে বা তাঁর কথা শুনে রাধার হৃদয়মুকুল প্রস্ফুটিত হওয়া কিংবা রাধার কারণে কৃষ্ণহৃদয়ে প্রেমাঙ্কুর উত্তপ্ত হওয়া― সাধারণ দৃষ্টিতে প্রাকৃত নায়ক-নায়িকার প্রেমচেতনার মতোই মনে হয়। মানবপ্রেমের রূপবিন্যাসে বর্ণিত রাধাকৃষ্ণলীলা প্রসঙ্গের বৈচিত্র্য পূর্বরাগ স্তরে লক্ষ্য করা যায়। পূর্বরাগ হলো মিলনের পূর্বে দর্শন ও শ্রবণের দ্বারা নায়ক-নায়িকার হৃদয়ে উন্মীলিত রতি ভাব। এই পূর্বরাগেই নায়িকা রাধার দশ দশার পরিচয় পাওয়া যায়। দশাগুলো হলো: লালসা, উদ্বেগ, জাগর্যা, তানব, জড়িমা, বৈয়গ্রা, ব্যাধি, উন্মাদ, মোহ ও মৃত্যু। এই প্রত্যেকটির মধ্য দিয়ে আকর্ষকের আকর্ষণের তীব্রতা সূচিত হয়। লালসা থেকে পূর্বরাগের শুরু এবং মৃত্যুদশায় গিয়ে তা চরমে উন্নীত। প্রেমাঙ্কুরের মহীরূহরূপ ধারণের অতিপ্রত্যক্ষ আভাস পাওয়া যায় পূর্বরাগ পর্যায়ের এই দশ দশার ভিতর দিয়ে। বৈষ্ণব পদাবলির ভাষ্য অনুযায়ী রাধার দশ দশা ও দুর্বিন শাহ রচিত পদের নিম্নোক্ত পরিচয় পাওয়া যায়।

অভীষ্ট বস্তুকে পাওয়ার জন্য প্রবল আকাক্সক্ষাকে বলা হয় লালসা। এতে ঔৎসুক্য-চপলতা প্রভৃতি ভাবোদয় হয়। লালসা যত তীব্র হয়, তত তার গাঢ়ত্ব সূচিত হয়। এই স্তরে প্রাপ্তির উৎকণ্ঠা যতই তীব্র হোক, তা থাকে মনের সংগোপনে। দুর্বিন শাহ রচিত পদে রাধার প্রেমভাব কিছুটা অগ্রসর হওয়ার পর তার সখিকে বলছে―
মদনমোহন রূপে আমার
মন করেছে চুরি গো
বল সে রূপ কেমনে পাসরি। (৭নং)

প্রেমজনিত উদ্বেগ স্তরে মনের চপলতা, দীর্ঘশ্বাস, অশ্রু, চাপল্য, বৈবর্ণ, স্বেদ প্রভৃতি প্রকাশ পায়। ১নং পদে এই লক্ষণ দেখা যায়।
বাঁশের বাঁশি বাজায় শ্যাম কালা
কেমন কেমন করে মনে বাড়ে প্রেমজ্বালা। (১ নং)

১৮ নং পদে রাধার জাগর্যা দশার দেখা মিলে। জাগর্যা দশায় নিদ্রার অভাব দেখা দেয়। রাধা নিজের দুর্ভাগ্য বর্ণনা করে সখিকে বলছেন―
বসন্তের শীতল বাতাসে
শুইলে না নিদ্রা আসে
প্রাণ সখি গো
বুক ভেসে যায় নয়নেরই নীরে গো। (১৮ নং)

জড়িমা স্তরে নায়িকার ইষ্ট-অনিষ্ট কোনো জ্ঞান থাকে না। দর্শন ও শ্রবণশক্তি লোপ হয়ে যায়। বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত নায়িকা হুংকার, ভ্রম, শ্বাস প্রভৃতি ভাব প্রকাশ পায়। ২৫ নং পদে রাধা বন্ধুকে ভুলে থাকার চেষ্টা করছেন কিন্তু পারছেন না। উপরন্তু কৃষ্ণকে পাওয়ার আশা করে ‘আপ্ত-জ্ঞাতি’র বৈরিতে পরিণত হয়েছেন। এই জ্বালা সইতে না পেরে রাধা যমুনাতে ঝাঁপ দেওয়ার কথা বলেন।
জ্বালাপোড়া পিঞ্জিরাতে
প্রাণপাখি না থাকতে চায়
কলসি বান্ধিয়া গলে
ঝাঁপ দিব যমুনার জলে
যাবে দুঃখ প্রাণ ত্যাজিলে
বলে পাগল দুর্বিন শায় ॥ (২৫ নং)

বৈয়গ্রা দশা: ‘বৈয়গ্রা’ অর্থ বোঝায় ভাবগাম্ভীর্যজনিত বিক্ষোভের অসহিষ্ণুতা। ভাবোৎকণ্ঠার তীব্র আলোড়নে মন বিক্ষুব্ধ হয়। হৃদয়-বেদনা হয়ে উঠে একান্ত অসহনীয়। এই স্তরে অবিবেক, নির্বেদ, খেদ, অসূয়া- ইত্যাদি দেখা দেয়। ৪৪ নং পদে তার প্রকাশ ঘটেছে। যেমন:
প্রাণ বন্ধুরে
তোমায় ছাড়া কারে বলি দুখ
আসবে বলে পন্থ চাইয়া দেখি তব মুখ।
না জানিয়া প্রাণ সঁপিয়া পাইলাম বড় দুখ
নিয়া প্রাণী কেন তুমি হইয়াছ বিমুখ।
কাঁচা বাঁশের মধ্যে যেন ধরে বজ্র পুক
সেই প্রকারে প্রেমাগুনে জ্বলে আমার বুক।
আমি যদি যাই মরিয়া পাইয়া প্রেম দুখ
রহম নামের এই কলঙ্ক জগতে দেখুক
তোমার মনে এত বাসনা দুর্বিন শাহ মরুক
বলতে নারি হায় কী করি, বৈরি পাড়ার লোক ॥ (রাইবিচ্ছেদ: ৪৪)

তানব দশা: ‘তানব’অঙ্গের কৃশতা বোঝায়। উৎকণ্ঠা, চিন্তা, নিদ্রার অভাব ইত্যাদি কারণে শরীর দুর্বল ও কৃশ হয়ে পড়ে। এতে দৌর্বল্য ও ভ্রমণাদি প্রকাশ পায়। দুর্বিন শাহ এ জাতীয় পদ রচনা করেছেন। যেমন:
কোন বা দোষে পাইয়া দোষী
প্রাণবন্ধু হইল বৈদেশি
প্রাণ সখি গো
চিন্তারোগে তনু হইল সারা গো। (১৭ নং)

ব্যাধি দশা: ইষ্টের অপ্রাপ্তিতে শরীর যখন পা-ুবর্ণ ধারণ করে এবং উত্তপ্ত হয়, তখন হয় ব্যাধি দশা। এই দশায় শীত, স্পৃহা, মোহ, বিশ্বাস ও পতন সুচিত হয়। দুর্বিন শাহ্ রচিত পদে নায়িকা ব্যাধি দশায় পড়ে তার সখিকে বলছে―
যাও সখি বন্ধুয়ার কাছে
কইও খবর বন্ধের রাঙা পায়
বন্ধুরে করাইও স্মরণ
প্রেম জ্বালাতে হবে মরণ
পাই যে চরণ মরণও বেলায় ॥ (১৯ নং)

উন্মাদ দশা: সর্বদাই তন্ময় ভাব। ফলে যে বস্তু যা নয়, তাই বলে ভ্রান্তি জন্মে। এই অবস্থায় অভীষ্ট বস্তুর প্রতি দ্বেষ, নিঃশ্বাস, নিমেষ-বিরহ প্রকাশ পায়। ২৩ নং পদে বিরহ থেকে দ্বেষ লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছে। যেমন:
বিশ্বাস করে আমি তারে
দিলাম ষোল আনা
পরার মন যুগাইয়া চলে
ভাব দেইখে বাঁচি না গো সখি।

মান: যে স্নেহ উৎকৃষ্টতা প্রাপ্তি হেতু নতুন মাধুর্য অনুভব করায় এবং স্বয়ং অদাক্ষিণ্য ধারণ করে, তাকে মান বলা হয়। ¯েœহ গাঢ়তা প্রাপ্ত হয়, ফলে প্রিয়ের মাধুর্য নতুনতর বলে অনুভূত হয়। কিন্তু হাবভাবে প্রকাশিত হয় কৌটিল্য বা বামতা। ভিতরে প্রচুর আনন্দ থাকা সত্ত্বেও বাইরে বক্র ব্যবহার দেখানো হচ্ছে মান। নায়িকা মনে করে, নায়ক তাকে অবহেলা করে অন্য নায়িকার প্রতি আসক্ত। দুর্বিন শাহ-র এ পর্যায়ের গানগুলো হলো ২ ও ৩ নং প্রভৃতি পদ।
সখি তোরা যাও গো
শ্যামচান্দ কালিয়ার খবরে
ও সে রইয়াছে কার বাসরে। (২নং পদ)

কিংবা, কোন রমণীর সাল্লায় পড়ে
ভুলে রইল মোরে
কেমন করে পাগল মনে
একা থাকি ঘরে। (৩নং)

প্রবাস: পূর্বে মিলিত নায়ক-নায়িকার স্থানান্তরে বা দেশান্তরে গমনজনিত ব্যবধানকে প্রবাস বলে। প্রবাস জনিত বিরহের লক্ষণগুলো পূর্বে বর্ণিত হয়েছে- যা রাধা বিরহের দশ দশা বলে কথিত। দুর্বিন শাহ রচিত এই পর্যায়ের পদ যথাক্রমে: ১৪, ১৫, ১৭, ১৮, ১৯, ২০, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৫, ২৬, ২৭, ২৮ প্রভৃতি।

দুর্বিন শাহ আধ্যাত্মিক গান রচনা করলেও তিনি জগৎ-সংসার, সমাজ-স্বদেশের চিন্তা থেকে মুক্ত থাকতে পারেননি। সর্বশাস্ত্র বলে সর্বশক্তিমান সবকিছু দেখছেন এবং তিনি অন্যায়ের প্রতিবিধান করবেন কিন্তু এক্ষেত্রে দুর্বিন শাহ্র মধ্যে যখন যুক্তিবোধ প্রবল হয়েছে তখন তিনি নির্দ্বিধায় বলে ফেলেন―
আসিল বিজ্ঞান জমানা, হুকুমের ধার ধারে না
নিজের ইচ্ছায় সবই করে, দেখি যত বিজ্ঞান।
ইচ্ছা হলে রাখে মারে, ন্যায় অন্যায় সবই করে
নির্দোষী থাকে বিচারে, গণ্যমান্য বলীয়ান।
দেখে শুনে কথা কও না, অন্যায়ের বিচার করো না
ভালো মন্দে সাড়া দেও না, আছ বলে কী প্রমাণ?
[জীব-পরমতত্ত্ব, পৃ. ১১১]

তিনি রাজনীতি সচেতন ছিলেন। ব্রিটিশ আমল, হিন্দুস্তান-পাকিস্তান আমল দেখেছেন। অর্থনৈতিক রাজনৈতিক বৈষম্য দেখেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি গানে গানে বলেছেন, ‘রক্ত দিলাম স্বাধীন পাইলাম দায়িত্ব রয় সম্মুখে/ সোনার বাংলা গড়ব মোরা বাসনা রাখি বুকেতে।’ সাম্যবাদ, মুজিববাদকে সমর্থন করে সংবিধানের চারটি মূল স্তম্ভ ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদের প্রশংসা করেছেন এবং সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমানকে ধন্যবাদ জানিয়ে গান রচনা করে বলেছেন, ‘সমাজতন্ত্র গণতন্ত্র সঙ্গে জাতীয়তাবাদ/ ধর্মনিরপেক্ষ নীতি নাইরে তাতে বৈষম্যবাদ/ দুর্বিন শাহ কয় জাতির জয় জানাই ধন্যবাদ।’ এভাবে দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান উভয় জগতেই তিনি তাঁর প্রজ্ঞাময় চিন্তাকে প্রসারিত করে গান রচনা করেছেন। শেষ বিচারে মানুষই তাঁর কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। মানুষকে জানার আগে সহৃদয় অন্তরে নিজেকে জানা এবং প্রেমভাব জাগ্রত করে আনন্দে সিদ্ধ পুরুষ হওয়াই তাঁর কামনা।

সহায়ক গ্রন্থ:
দুর্বিন শাহ্ সমগ্র : সুমন কুমার দাশ
বৈষ্ণব পদাবলি পরিচয় : সনাতন গোস্বামী

লেখক: প্রাবন্ধিক ও ভাষা গবেষক।

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!