আমার আম্মার ডেকোরেটিভ ওয়াল ফ্রেমে বন্দী যে ছন্দ, তাতে পাহাড়ের উল্লেখ বা উপমা রয়েছে। পাহাড় একটি ঊর্ধ্বমুখী ভূমিভাগ। পর্বতও তাই।তবে পাহাড়ের উচ্চতা পর্বত থেকে কম হয়। পর্বত, আরো উঁচু, আরো খাড়া হয়।
সাধারণত ৬০০ মিটার বা ২০০০ ফুট উচ্চতার ভূখণ্ড, যা সমতল থেকে উপরের দিকে প্রসারিত থাকে, তাকে পর্বত এবং এর চেয়ে নিচুকে পাহাড় বলে, এই বিবেচনা হল ইংল্যান্ডের ভূবিদদের।
অন্যান্য উন্নত দেশের ভূবিজ্ঞানীরা একটু-আধটু বেশ-কম করে প্রায় ঐ রকমই ভেবে থাকেন।
অর্থাৎ, পাহাড়ের উপর সহজে চড়া যায়, কিন্তু পর্বত চূড়া বা শিখরে অনায়াসে আরোহণ করা যায় না।
“তাক্বদীর মেরি বদ নসিবী ফরিয়াদ কিয়া করে,
সর পর ঘিরে পাহাড় শিকায়েত কিয়া করে।”
উল্লিখিত আমার আম্মার ছন্দে, মাথার উপর পাহাড় ভেঙে বা ধসে পড়া মানে—হঠাৎ মহাবিপদে পড়া বা আকস্মিক ঝঞ্ঝাট অথবা আচম্বিত যন্ত্রণা কিংবা অপ্রত্যাশিত সংকটে পড়া।যেমনটি আমরা,অতর্কিত বিপত্তি অথবা অনাকাঙ্খিত কষ্টের সম্মুখীন হলে পর বলে থাকি— মাথার উপর যেন “আকাশ ভেঙে পড়েছে।”
এই পাহাড় যখন মাথায় ভেঙে পড়ে তখন ‘অনেকের’ মনোবলও ভেঙে পড়ে যায়। আর যখন মনোবল চৌচির হয় তখন ‘অনেকের’ জবান হয়ে যায় উদার অথবা দরাজ। ফলে জিহ্বা ফরিয়াদ ও অভিযোগ, অথবা অনুযোগ ও বিলাপ, কিংবা নালিশ আর শিকায়েতে লিপ্ত হয়ে যায়। এবং এক সময় বিপন্ন ব্যক্তির সাহস ও হিম্মত এত বেশি কমে যায় যে, সে তখন superstition (কুসংস্কার) ‘যদি’(if) ও ‘কিন্তু’(but) নামের পাহাড়গুলির তলায় যেন আটকে যায়।তবে, তাতে বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিটিরই ক্ষতি সাধন হয়।
এই অনিষ্ট থেকে সতর্ক করতেই ঐ ছন্দের উদ্ভব। চরণটি বলছে:
“আমার কপাল যখন সুপ্রসন্ন নয়, তখন অভিযোগ কি করব,
মাথায় যদি পাহাড় ধসে পড়ে তবে দোষারোপ কাকে করব।”
জীবনের গিরিপথ মাড়াতে ভাগ্য-পরীক্ষা হওয়া অতি স্বাভাবিক।বিড়ম্বনা ও দুর্বিপাকে পড়াও স্বাভাবিক। তাতে বিচলিত না হয়ে ইতিবাচক মনোভাব আর সহায়ক পদক্ষেপ নিয়ে এগোতে থাকাই হিতকর।
আমার আম্মা শিক্ষিতা মহিলা বলতে যা বুঝায় তা কিন্তু ছিলেন না। যদিও আমার বিশ্বাস, পৃথিবীর প্রত্যেক ‘মা’ প্রতিজন সন্তানের জন্য একেকটি বিশ্ববিদ্যালয়। সে ‘মা’ শিক্ষিতা কিংবা অর্ধ-শিক্ষিতা অথবা অশিক্ষিতা যাই হোন না কেন তিনি আসলে সন্তানের জন্য হলেও একটি বিশ্ববিদ্যালয় আবার একজন শিক্ষিকাও। বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন বিভিন্ন অনুষদে পড়া-লিখা করে শিক্ষার্থী তার জীবনকে আলোকিত করে তেমনি মায়ের জীবনের বিভিন্ন অনুষদ অনুধাবন করে সন্তান তার জীবনকে আলোকিত করতে পারবে। সন্তানরা ‘মা’ বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে প্রতিদিন অথবা প্রতি মাসে একটি করে হলেও ‘অভিজ্ঞতা-সনদ’ সংগ্রহ করতে পারবে।
আমি মনে করি, ধরণীর প্রতিটি মা’র সিকি অথবা অর্ধ-শতাব্দী জীবনের উপর গবেষণা করলে পি এইচ ডির ছাত্ররা অনায়াসে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করতে পারবে।
আমার আম্মার যখন এত শিক্ষা নেই তখন ঐ শ্লোক এবং তাঁর পঠিত আরো কিছু ছন্দের স্রষ্টা কে?
নাকি, তরুণ বয়সে বেশির ভাগ পড়ুয়া বাঙালিরা যেমন কাব্য চর্চা করে থাকে এবং সে অনুশীলনে অনেক সময় অযাচিতভাবে কিছু উন্নত কাব্য সৃষ্টি হয়ে যায়।আমি ভাবি,আমার আম্মার বেলায় কি তাই হয়েছে। আমি কখনো এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করে তাঁকে লজ্জা দিতে চাইনি।
আসলে,আমিও তো,জীবনে কখনো কোন শিক্ষকের কাছ থেকে বাংলা শিখিনি অথবা শিখার সৌভাগ্য হয়ে উঠেনি কিন্তু কিশোর বয়সে কিছুটা হলেও আপন সাধনায় কাব্য ঠিকই অনুশীলন করেছি। হয়তবা তা অনধিকার চর্চাই ছিল। তবে অসংখ্য কিশোরের মত আমিও লিখেছি। হ্যাঁ! কবিতা লিখেছি জ্ঞাতসারে অথবা অজ্ঞাতে।
সম্প্রতি, আমি যখন আমার আম্মার এ দিকটা নিয়ে চিন্তা করি তখন আমার ধারণা হয়, তিনি হয়ত তাঁর আব্বা অর্থাৎ আমাদের নানার কাছ থেকে প্রভাবিত হয়ে কিছু অথবা অনেক কিছু তিনি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন যা আমরা কখনো খেয়াল করিনি।
কারণ,স্বনামধন্য রেসলার এবং স্ট্রংম্যান হওয়া সত্ত্বেও বাঘা বাঘা সব সাহিত্যিক,পন্ডিত আর শায়েখদের সাথে আমার ‘নানা’র সখিত্ব এবং ঘনিষ্ঠতা ছিল সুবিদিত।
যেমন, সিলেটের পুরাতন কোন এক প্রত্রিকার একটি প্রবন্ধ পড়েছিলাম, সেটি ছাপা হয়েছিল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে। সেখানে উদ্ধৃত আছে, একটি দাওয়াতে কবি ইলু মিয়া পহলেওয়ান কে সম্বোধন করে সিলেটী ভাষায় বললেন:
“খালি খাউকা, খালি খাউকা, আর কত খাইতামবা, খাইতে খাইতে নু হেষে পেট ফাটি যাইব।”
উল্লিখিত ইলু মিয়া পহলেওয়ান ছিলেন আমার নানা। ইলু মিয়া ছিল তাঁর ডাক নাম, যার প্রকৃত নাম ছিল ইলিয়াস আহমদ।
মা’দের মত বাবা’রাও যে সন্তানের বড় এবং প্রিয় শিক্ষক হতে পারেন তা কিশোর বয়সেই অনুধাবন বা উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম আমার আম্মার কাছ থেকে। নীতি কথা নিয়ে যখন কারো সাথে আমার আম্মার মনোমালিন্য হত তখন তিনি একটু উষ্মা প্রকাশ করে আর শাড়ির আঁচল দিয়ে চশমার পরাকলা (লেন্স) মুছতে মুছতে বলতেন—“তোমাদের মত আমি এত জ্ঞান শিখিনি তবে আমার বাবা আমাকে যে নিয়ম নীতি শিখিয়েছেন, আশাকরি তা রক্ষা করতে পারলেও পার পেয়ে যাব।”
ফ্রেমে বন্দী তাঁর ছন্দটিও ছিল একটি নীতি উক্তি। যা হয়ত তিনি তাঁর বাবার কাছ থেকে শিখেছিলেন। তবে শুধু শিখাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না তাঁর এ ছন্দ। বরং এ নীতি বাক্যটি তাঁর আয়ত্তে ছিল খুব বেশি। জীবনভর অজস্র পাহাড় তাঁর মাথার উপর ধসে পড়লেও, স্রষ্টার উপর তাঁর কেমন যেন এক আস্থা আর নীতির উপর তাঁর অবিচলতা, তাঁকে বরাবর এসব থেকে পার পেতে সাহায্য করেছে।
কিন্তু, এ ধরা তো এমনই যে স্রষ্টা এখানের সব কিছুরই সীমা টেনে রেখেছেন। ২০২১ সালের ১৭ মার্চ আব্বা রাহিমাহুল্লাহর প্রয়াণে একটি পাহাড় যেন তাঁর মাথায় ধসে পড়ে। কিছুদিন পর একটু স্বাভাবিক হলে পর বললেন, প্রায় সাড়ে ছয় দশকের “দাম্পত্য জীবন” বা বৈবাহিক সময়ে একদিনের জন্যও স্বামীর ঘর ফেলে রেখে কোথাও একা থাকেননি। এমনকি তাঁর বাবার (হাওয়া পাড়া, সিলেট) বাড়িতে বিয়ের পর আর থাকা হয়নি।এবার সে সুযোগ হয়েছে। সেহেতু, চার মাস দশ দিনের ইদ্দাত বা শোক-গাঁথা দিবসগুলো পার হলে পর প্রথমে যাবেন তাঁর নিজ বাবার বাড়িতে।সেখানে এক/দুই দিন কাটাবেন। অতঃপর মেয়েদের আবদার রাখতে তাঁদের বাড়িতেও রাত্রি যাপনে যাবেন।
কিন্তু, ঠিক চার মাস পর, ১৬ জুলাই আমাদের পরিবারের উপর মর্মান্তিক পাহাড় ধস হয়। সেদিন, আম্মা চলে গেলেন বারযাখীয় পাহাড়ের আড়ালে।
অতপর, মানিক পীর কবরস্তানের পাহাড়-কাটা যে জায়গায় তাঁর ৮৪ বছর বয়সী দেহকে কবর দিয়ে পাহাড়ী মাটি দ্বারা ঢেকে দেওয়া হল, সেখানের তিন দিকের পাহাড়-ঘেরা স্থানটিতে দাঁড়ালে মনে হয়, যেন তাঁর মাথার উপর পাহাড় ঢলে পড়ছে।
পরন্তু, স্মৃতিতে শিস বাজে আম্মার গাওয়া ঐ শ্লোক—
“তাক্বদীর মেরি বদ নসিবী ফরিয়াদ কিয়া করে,
সর পর ঘিরে পাহাড় শিকায়েত কিয়া করে।”