১.
বেশ আগে এক যুবক আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল—Mufti! What’s your new year’s resolution? (মুফতি! তোমার নিউ ইয়ার রেজুলেশন কী?)
আমি তখনো ‘নিউ ইয়ার রেজুলেশন’— এ বিষয়টির সাথে পরিচিত ছিলাম না। আবার পনেরো অথবা ষোল বছরের একটি তরুণ যখন একটি বৈঠকে অনেক মানুষের সামনে প্রশ্ন করছে তখন কিছু একটা জুতসই জবাব দিতে না পারাটা হবে embarrassment বা বিব্রতকর।
সে সময়ে অর্থাৎ দুই দশক বা তারও পূর্বে আমার মন-মানসিকতা বা প্রবণতা হয়ত এমনটিই ছিল যে, বিশেষ কিছু জায়গায় সহজে নিজ অজ্ঞতা প্রকাশ করতে বিব্রত বোধ হত।
এখন সেই ভাব হয়ত নেই। এখন কিছু জানা না থাকলেও নির্দ্বিধায় ও নিঃসংকোচে সাহস করে বলে দিতে পারবো যে, ‘লা আদরি’ (لا ادري), আমি জানি না।অথবা বলবো, প্রশ্নটি আবার বুঝিয়ে বলুন—তাতে আমার পক্ষে উত্তর দেওয়া হয়ত সহজ হবে।
অতঃপর, মিহাল নামের ঐ তরুণটি যখন প্রশ্ন করছিল, আমি তাঁর কথা এবং বলার ভঙ্গিমা থেকে রেজুলেশনের একটি ধারণা
আঁচ করতে সক্ষম হই। ছেলেটি আসলে জানতে চাচ্ছে—এই যে round the corner (আসন্ন) নতুন বছর, এই নতুন বছরে আপনি কী করতে চান, এ বছরের জন্য আপনার প্রতিজ্ঞা বা পরিকল্পনা কী।
অতএব, এবার জবাবে মোটের উপর আমি তাঁকে জানালাম, ঠিক রেজুলেশন নিয়ে আমি কোন চিন্তা করিনি তবে একজন সচেতন মুসলিম হিসেবে নতুন বছরেও আমার এই শক্ত নিয়ত থাকবে যে, বছর জুড়ে যেন আমি সঠিক পথে থাকি, সঠিক চিন্তা করি আর সঠিক কাজ করি।
তারপর আমি আমার জবাব উপযুক্ত হয়েছে কি না বুঝার জন্য তাঁকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, এবার বলো তোমার কি রেজুলেশন?
জবাবে সে অকপট জানাল, সে এ বছর মার্শাল আর্টে কালো বেল্ট চায়।
আমি বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলাম—এত জলদি কালো বেল্ট? এর জন্য তো অনেক বছর অবধি চেষ্টা করতে হয়?
সে জানাল, বয়স আট থেকে সে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে।
আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, কোন মার্শাল আর্ট তুমি অনুশীলন করছো? কারণ মার্শাল আর্টের তো আবার অনেক প্রকার আছে।
সে জানাল, কারাতে’র পাশাপাশি তায়কোয়ান্দো’ও সে শিখছে।
তাঁর সাথের আলাপ দ্রুত শেষ করতে আমি শেষমেশ বললাম—-ঠিক আছে মিহাল, তবে আমি তোমাকে আরো দুটি বিষয় শিখার সাজেস্ট্ করব, আর তার একটি তুমি এ বছরের রেজুলেশনে রাখতে পারো, অর্থাৎ এ বছর শুরু করতে পারো। সেই দুটি বিষয় হলো—হর্স রাইডিং অথবা সুইমিং।
মিহাল যখন ‘তাবাসসুম’-(মুচকি হাসির) ঔজ্জ্বল্য দিয়ে থামস আপ করল, তখন তাঁকে দৃঢ় ‘প্রত্যয়ী’ মনে হলো।
২.
নিউ ইয়ার রেজুলেশনের ইতিহাস কিন্তু নতুন নয়, বরং বেশ পুরনো। খ্রিস্টাব্দ শুরুর বহু হাজার বছর পূর্বে এর সূচনা। ধীরে ধীরে এর প্রচলন ব্যাপক হয়ে যায়। শুরুতে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এর প্রবর্তন হয়।
একটি বছরের শেষে এবং নতুন আরেকটি বৎসরের প্রারম্ভে, এক বা একাধিক মন্দ বা বাজে অভ্যাস ছেড়ে দিতে ঈশ্বরের সাথে অঙ্গীকারবদ্ধ হত মানুষ।অথবা এক বা একাধিক ভাল স্বভাব অর্জনের জন্য দেবতার কাছে প্রতিজ্ঞা করত লোকজন।
কিংবা বদ কিছু অভ্যাস বর্জন এবং কল্যাণকর কিছু আচরণ উপার্জনের জন্যে ঈশ্বরের কাছে প্রতিশ্রুতি বা ওয়াদা করত অনুসারীগণ।
যেমন কেউ একজন ঈশ্বরের কাছে ওয়াদা করল, “এ বছর সে চুরুট টানা বন্ধ করে দিবে।”
এ রকম ছিল নিউ ইয়ার রেজুলেশন।
কিন্তু একসময় এই রেজুলেশন ধর্মীয় আরাধনায় আর আবদ্ধ থাকেনি বরং পশ্চিমা বিশ্বে এটি একটি সাধারণ ট্রেন্ডে পরিণত হয়ে যায়। অতঃপর ব্যাপারটি সর্বজনীন হয়ে যায়।
অর্থাৎ নিউ ইয়ার রেজুলেশনের এ ধারায় ঈশ্বরের কাছে আর ওয়াদা করার প্রয়োজন হয় না অথবা মানুষ এটি আর প্রয়োজন মনে করে না।
তবে এ ক্ষেত্রে self promise বা Self-Commitment (স্ব-প্রতিশ্রুতি) বেশি কাজ করে অর্থাৎ মানুষ তার নিজের সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয় যে, সে এই কাজ বা এই সব কাজ এ বছর করবে এবং এই বা এসব কাজ আর করবে না।
কিছু মানুষ ফি-বছর সংকল্প করে বেড়ায়—নতুন বছরে কিছু একটা করার অথবা নির্দিষ্ট কিছু সফলতা অর্জনের পরিকল্পনা করে।
৩.
অধুনা মানুষের কাছে, ব্যক্তি কেন্দ্রিক নিউ ইয়ার রেজুলেশন কম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। তবুও প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের প্রচুর মানুষ তাই করে চলেছে।
সাম্প্রতিক কিছু স্টাডি বা গবেষণায় দেখা গেছে ৩৫% মানুষ তাঁদের নববর্ষের রেজুলেশন রক্ষায় ব্যর্থ হয়। এবং তাঁরা স্বীকার করে নেয় যে তাদের লক্ষ্য আসলে অবাস্তবই ছিল।
৩৩% তাঁদের অগ্রগতির কোন ট্র্যাক বা হিসাব রাখে না। এবং ২৩% তাঁদের রেজুলেশন ভুলে যায়। অবশিষ্টরা তাঁদের রেজুলেশন পালনে মোটামুটি সচেষ্ট থাকে।
তবে অনেক এমন আছে যারা তাঁদের নিউ ইয়ার রেজুলেশনে থাকা ছোট ছোট লক্ষ্যগুলো পূরণে সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়। যেমন ওজন কমানো বা ধূমপান ছেড়ে দেওয়া।
কিন্তু বড় লক্ষ্যগুলো পূরণ করতে অনেকে পারে না।
অপর এক গবেষণায় উঠে এসেছে যে ৮৮% তাঁদের রেজুলেশন পালনে ব্যর্থ হয়।
৪.
গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার হোক অথবা হিজরী-ইসলামী, একটি নতুন বছরের সূচনা কালে কোন ধরণের নির্দিষ্ট উদযাপন বা celebrations অথবা উপাসনা বা ইবাদাহ কিংবা আমাল,কিছুই ইসলামে নেই।
তবে, জানুয়ারী বা মুহাররমের শুরুতে শুধু নয় বরং বছর জুড়ে যে কোন দিন যে কোন সময় self-reflection (محاسبة النفس) অথবা আত্মসমালোচনা করা একটি সুন্দর চরিত্র।
বছর ঘুরে আসলে,অনেক মানুষ যেমন হিসাব-নিকাশ করে।জমা-খরচের খতিয়ান দেখে।উন্নতি-অবনতির হিসাব মিলায়।সফলতা-বিফলতার খোঁজ নেয়।
তেমনি একজন মানুষ যদি সপ্তাহ বা মাস ফুরালে, কিংবা বছর শেষে অথবা নির্দিষ্ট একটি সময় পার করে (যেমন তিন মাস পর পর) সে তাঁর আত্মসমালোচনা করে অথবা আত্ম-অবলোকন (আত্ম-মনিটরিং) করে, অতঃপর সে পরবর্তী সময়ের জন্য নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সে পিছনের ভুলকে পরিশোধন করার সংকল্প করে। সে আরো অগ্রসর হওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় নেয়।
তো এ রকম কিছু করলে তাতে দোষের কিছু নেই।বরং এটি ভাল। যদিও এটি কোন জরুরী বিষয় নয় যে করতেই হবে। তবে যারা করে তাঁরা লাভবান হয়।তাঁরা উপকার পায়।
কারণ মানুষ যখন নিখাদ নিয়ত আর দৃঢ় সংকল্প বা determination -এর সাথে সঠিক পরিকল্পনার করে তখন সে সম্মুখে বহুদূর যেতে পারে।
৫.
মানুষের কাজের স্বভাব বা আচরণে দুটো গুরুত্বপূর্ণ অংশ রয়েছে। একটি হচ্ছে action বা কাজ এবং অপরটি হচ্ছে তার intention বা নিয়ত অথবা ইচ্ছা।
যেমন, কেউ ইচ্ছা প্রকাশ করল আগামী বছর থেকে সে একজন বিজ্ঞ উস্তাদের কাছে কুরআনের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা শিখবে। অতঃপর সংগত কোন কারণে যথা সময়ে তাঁর পক্ষে তা সম্ভব হলো না। সে কুরআন শিক্ষা শুরু করতে আর পারেনি। কিন্তু তাঁর ইচ্ছা ছিল।
এই ইচ্ছা, এ অভিপ্রায়ই ইসলামে নিয়ত বা নিইয়াহ্। স্রষ্টার কাছে এ নিয়তের এক মর্যাদা আছে।এ নিয়তেও সাওয়াব আছে।ভাল ইচ্ছা ও নিয়তকে ইসলামে ইবাদাহ বা ইবাদাতের মর্যাদা দেওয়া হয়।তাই যৌক্তিক কারণে নিয়ত কার্যকর বা নির্বাহ করতে না পারলেও কিছু সাওয়াব অবশ্যই পাওয়া যায়।
আদপে, নিয়ত হলো মানুষের চিন্তার প্রক্রিয়া এবং চিন্তা বা ভাবনার বহিঃপ্রকাশ।
তাই, একজন মুসলিম যদি তাঁর ইচ্ছার উপর দাঁড়িয়ে আগামীর জন্য হিতকর কোন সংকল্প বা Resolution বানায়, আশা করা যায় যে তাঁর জন্য তা কল্যাণকরই হবে।
এ ক্ষেত্রে, সে যেন শুধু নিয়তই করে। আল্লাহর নামে শপথ বা কসম যেন না করে।মানত বা মান্নত যেন না করে। কারণ এ গুলির বিধান আলাদা। এ গুলো পালন করতেই হয়। রক্ষা না করতে পারলে ধর্মীয় দন্ডও আছে।
তাই, কাঙ্ক্ষিত সমৃদ্ধি অর্জন অথবা সাফল্যের ঠিকানায় পৌঁছাতে সচেতন যে কেউ সংকল্প করবে, পরিকল্পনা করবে, উপায় তৈরি করবে, এটাই স্বাভাবিক। নতুন বছর একটি অজুহাত মাত্র।
লেখক: মুফতি