ভাগ্য বদলাতে আমাদের দেশের নারীরা বিদেশে যাচ্ছেন।বিশেষ করে মূলত সৌদি আরবই যাচ্ছেন আমাদের দেশের বেশির ভাগ নারী শ্রমিক। ভাগ্যবদলের সেই স্বপ্নকে পুঁজি করে যাওয়া তাঁদের কেউ তিন মাস, কেউ ছয় মাস, কেউবা এক বছর পর ফিরে আসেন।সেখানে গিয়ে স্বপ্নভঙ্গ হতে খুব বেশি দিন লাগেনা তাঁদের। কারণ সেখানে বেতন তো পাচ্ছেনই না, উল্টো অনেক সময়ই তাদের কপালে জুটছে নির্যাতন-নিপীড়নের মত ঘটনা। যাতে শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত সৌদি আরব থেকে ফিরেছেন প্রায় এক হাজার নারী। এর মধ্যে ১-৬ জুন পর্যন্তই এসেছেন ৮২ নারী।
দেশে ফিরে সরকারের কোনো সংস্থাকে পাশে পাননি ওই নারীরা। এমনকি পরিবারেও ঠাঁই হচ্ছে না অনেকের। সামাজিকভাবেও হেয় হতে হচ্ছে তাঁদের। ফিরে আসা নারীদের নির্যাতনের ভয়াবহ বিবরণ হরহামেশা প্রকাশিত হচ্ছে দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। সদ্য দেশের অন্যতম শীর্ষ দৈনিক প্রথম আলো ফিরে আসা বেশ কয়েকজন নারীর সঙ্গে কথা বলে নির্যাতনের ভয়াবহ বিবরণ তুলে ধরেছে।
তাতে জানা যায়, সরকারের পক্ষে কেউ বিমানবন্দরে তাঁদের খোঁজ নিতে যায়নি। এ নিয়ে প্রচন্ড ক্ষোভ রয়েছে তাঁদের। এ বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক গাজী মোহাম্মদ জুলহাস বলেন, নারীরা নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরে আসার দায় রিক্রুটিং এজেন্সিকে নিতে হবে। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের আলাদাভাবে নারীশ্রমিকদের জন্য কোনো কার্যক্রম নেই। তাঁর দাবি, বিমানবন্দরের কল্যাণ ডেস্কে তাঁদের কর্মীরা বিদেশফেরত শ্রমিকদের তথ্য সংগ্রহ করছেন।
সরকারি এই কর্মকর্তা সৌদি আরবে নারীশ্রমিকদের ওপর নির্যাতনের ঘটনায় রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর ওপর দায় চাপালে এ খাতের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো এর জন্য এককভাবে দায়ী নয়। দুই দেশের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে নারী গৃহকর্মীরা সৌদি আরবে গেছেন। এ ঘটনায় প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব রয়েছে।
জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) যুগ্ম মহাসচিব-২ শামীম আহমেদ চৌধুরী বলেন, চুক্তির আগে কোনো নারী শ্রমিক ফেরত এলে রিক্রুটিং এজেন্সিকে উল্টো টাকা দিতে হচ্ছে ওই দেশের মালিককে। আর শরীরে ইস্তিরির পোড়া দাগ, হাত-পা ভাঙাসহ শরীরে যতই প্রমাণ থাকুক, দূতাবাসগুলো এসব সৌদি কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরছে না। এর আগেই ওই নারীকে দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। ফলে নির্যাতনের বিষয়টি আর প্রমাণ করা যাচ্ছে না। অথচ সরকার এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলছে। তিনি বলেন, বিদেশফেরত নারীদের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে এখন পর্যন্ত সরকারের কোনো কার্যক্রম নেই।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সৌদি আরব থেকে ফেরত আসা নারীদের সংখ্যা বাড়তে থাকায় গত দুই সপ্তাহে মন্ত্রণালয়ে সচিবের নেতৃত্বে একাধিক সভা হয়েছে। ফেরত আসা নারীদের বিষয়ে সরকারের করণীয় কী, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। এর মধ্যে বায়রা থেকে তদারক কমিটি গঠন, বিদেশে পাঠানো প্রতিটি কর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা এবং নির্যাতনের অভিযোগ পেলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
অভিবাসন খাতের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, ফেরত আসা নারীদের শুধু আর্থিক সহায়তা নয়, দীর্ঘ মেয়াদে তাঁদের সমাজে পুনর্বাসন করার দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকে। এ ক্ষেত্রে শুধু সৌদি আরব নয়, মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলো থেকেও যাঁরা ফেরত আসছেন, তাঁদের বিষয়েও সরকারকে ভাবতে হবে।
লেবানন থেকে প্রায় এক বছর আগে দেশে ফেরেন ২৫ বছর বয়সী এক নারী গৃহকর্মী। তাঁর কোলে ছিল ১ মাস ১০ দিন বয়সী শিশু। তিনি যেখানে কাজ করতেন, ওই বাসার গৃহকর্তা শিশুটির বাবা। এই নারী জানান, লেবাননে যাওয়ার পর থেকে গৃহকর্তা তাঁকে যৌন নির্যাতন করতে থাকেন। ওই ব্যক্তির স্ত্রীর কাছে অভিযোগ করলেও তিনি এটি বিশ্বাস করেননি। পরে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে উল্টো মামলা দিয়ে তাঁকে জেলে পাঠানো হয়। সন্তান জন্ম দেওয়ার পর তাঁকে দূতাবাসের মাধ্যমে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়। বিমানবন্দর থেকে তাঁকে নেওয়া হয় বেসরকারি সংস্থা অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন কর্মসূচির (ওকাপ) নিরাপদ আবাসে। সেখানে টানা কয়েক মাস ছিলেন তিনি। সংস্থাটি চিকিৎসার পাশাপাশি এই নারীকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য কাউন্সেলিংসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। মে মাসের শেষ সপ্তাহে তিনি বাড়ি ফিরেছেন। তিনি লেবানন থেকে প্রতি দুই মাস পরপর ২৪ হাজার করে টাকা পাঠাতেন। সেই টাকা নিতেন স্বামী। এই নারী বলেন, ‘স্বামীই আমারে বিদেশ পাঠাইছিল, এহন স্বামী তাকাইয়্যাও দেহে না। বাপ-ভাইও চেনে না। বিদেশি বাচ্চা দেইখ্যা অন্যরা হাসে।’
সৌদি আরব থেকে মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় ফেরত আসা এক নারী রাজধানীর জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সম্প্রতি গ্রামে ফিরেছেন। ওই নারীর ভাই টেলিফোনে প্রথম আলোকে জানালেন, বিদেশ যাওয়ার আগেই স্বামী তাঁর বোনকে ফেলে চলে গেছেন। সৌদিতে নয় মাস কাজ করলেও ছয় মাসের টাকা দেশে পাঠাতে পেরেছিলেন। বোন কবে সুস্থ, স্বাভাবিক হবে ঠিক নেই। এখন কে তাঁর দায়িত্ব নেবে, তা ভেবে হিমশিম খাচ্ছে পরিবারটি।
বেসরকারি সংস্থা ওকাপের কর্মকর্তা (কেস ম্যানেজমেন্ট অফিসার) শাহীনূর আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, বিদেশফেরত নারীদের অনেককেই পরিবার নিতে চাচ্ছে না, কখনোবা ওই নারী নিজেই যেতে চাইছেন না। অনেকে সন্তান নিয়ে ফিরেছেন। এ অবস্থায় সামাজিকভাবে তাঁরা সমস্যায় পড়ছেন।
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নারী গৃহকর্মী পাঠানোর বিষয়ে সৌদি আরবের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করে বাংলাদেশ। এরপর থেকে চলতি বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত প্রায় ২ লাখ নারী সৌদি আরবে গেছেন। আর ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ থেকে গেছেন প্রায় ৭ লাখ নারী। এই তথ্য প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ অভিবাসনবিষয়ক বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার।
নারী গৃহকর্মীদের ফিরে আসার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) সমন্বয়ক সি আর আবরার প্রথম আলোকে বলেন, নির্যাতনের শিকার হয়ে ফেরত আসা নারীরা সবাই সরকারের বৈধ পথে বিদেশ গিয়েছিলেন। বর্তমানে নারীদের ফেরত আসার সংখ্যাটা বেড়েছে, কিন্তু নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, তার ইঙ্গিত তো আগে থেকেই ছিল। কোনো নারীর পরিবার যদি এই নারীদের নিতে না চায়, সেই পরিবারকে বোঝানোর দায়িত্বও নিতে হবে সরকারকেই। আর পরিবার অপারগ হলে দীর্ঘ মেয়াদে ওই নারীর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। অথচ সরকারের এখন পর্যন্ত এ বিষয়টি নিয়ে কোনো নীতি নেই।