মরহুমা আনোয়ারা বেগম ছিলেন বাংলার এক দুঃখী নারী এবং আমার গর্ভধারিনী মা। যিনি বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে মাত্র ছয় মাস বয়সে আমাকে রেখে বিনাচিকিৎসায় অকালে মারা যান ভাদ্রের এক বাদলা দিনে। ছোটবেলায় বিশেষত হাইস্কুলে পড়াকালীন সময় থেকে দুঃখের সাগরে ভাসতে ভাসতে আমি ভাবতাম বড় হলে একদিন আমি আমার দুঃখিনী মায়ের নামে সামাজিক কিছু একটা করব। যাতে আত্মীয়-স্বজন কর্তৃক ভুলতে বসা আমার মা মরহুমা আনোয়ারা বেগমকে ভালো কাজের মাধ্যমে স্মরণীয় করে রাখা যায়। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার বাইরে বিশেষত কথাসাহিত্য পড়তে পড়তে ভাবতাম মা’র নামে একটা গ্রন্থাগার করা যায় যেখানে জ্ঞান চর্চার অপার সুযোগ আমার জন্য এবং সবার জন্য সহজ হবে। কখনো কখনো মায়ের নামে একটা মহিলা স্কুল করার কথা ভেবেও বিনিন্দ্র রজনী কাটিয়েছি। সেই সাথে মায়ের অভাব রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করে অনেক চোখের জল ফেলেছি।
সেসব সংকল্প-স্বপ্ন বুকে ধারণ করে দুঃখ-কষ্টে দিনে দিনে বড় হয়েছি। শিল্প-সাহিত্য চর্চায় সেসব কিছুটা গেঁথেও রেখেছি। এমনি করে একদিন রোজগারীও হয়েছি। কিন্ত আমার যাযাবর/ভাসমান জীবনের সহজে ইতি ঘটেনি। আর একেবারে শূন্য থেকে শুরু করা জীবনে স্বপ্ন-সংকল্পের কিছু করতেও পারিনি। ভুল, হতাশা-ব্যর্থতার অন্ধকারে হাবুডুবু খেতে খেতে প্রায়ই বিনিন্দ্র রজনীতে দীর্ঘশ্বাস বুক ভরে উঠেছে।
রোজগারী হয়েও সহজে কিছু করতে পারিনি বিশেষত আমাকে ঘিরে থাকা চতুর, নিমকহারাম ও স্বার্থপরদের কারণে। তবে আর্থিক, মানসিক ও শারিরীক বিপর্যস্ততায় বলতে গেলে খাই খাই পার্টির তেমন কাউকে কাছে পাইনি। উপরন্ত অনেকেই আমাকে দূরে তাকাতে ও মাথা তুলতে দেয়নি নানাভাবে। শিল্প-সাহিত্যের ধ্যানে থাকা আমি বৈষয়িক বিষয়ে বোধ হয় খুব বোকা ছিলাম। এমতাবস্থায় প্রায়ই মার অভাব মনে খুব উঁকি মারে। এ প্রেক্ষিতে ২০০১ সালের ১ জানুয়ারি ব্যক্তিগত স্বল্প সঞ্চয় দিয়ে ভয়ে ভয়ে শুরু করি আনোয়ারা ফাউন্ডেশন। বলা দরকার, মায়ের নামে গ্রন্থাগার ও স্কুল প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন-সংকল্প থেকে সরে এসে ফাউন্ডেশন করার কারণ বিচিত্র বিষয়ে পড়াশোনা ও চিন্তা ভাবনার পর ধারণা আসে ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে অনেক বড় পরিসরে কাজ করা সম্ভব। ফাউন্ডেশনের অধীনে/মাধ্যমে চাইলে গরিব-দুঃখী, সমাজ, প্রকৃতি-পরিবেশের কল্যাণে কাজের সাথে সাথে গ্রন্থাগার, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসাসহ অনেক কিছু করা যেতে পারে। বলা বাহুল্য, ভালো কাজের মাধ্যমে অকালে মারা যাওয়া মাকে স্মরণীয় করে রাখার পাশাপাশি ছোটবেলা হতে কাছে থেকে দেখা আশপাশের মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টও মানুষের জন্য কিছু করতে আমাকে হর হামেশা অনুপ্রাণিত করে।
নিকটজন বলতে পাশে কেউ নেই, ভাবি শুরু করলে অনেকে এগিয়ে আসবে। কিন্ত ২/১ জন বন্ধু-বান্ধব ছাড়া সহযোগী তেমন কাউকে পাইনি। অনেকে আবার ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে টাকা-পয়সা দাবী করেন। এতদসত্বেও ছোট্ট একটা সাইনবোর্ড, স্ট্যম্প সীল ও লেটার প্যাড তৈরী করে সীমিত আকারে শুরু হয় আনোয়ারা ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম। মহিলাদের অগ্রাধিকার দিয়ে কিছু গরীব মহিলাকে শাড়ী-কাপড় ও কর্জে হাসানা প্রদান করা হয়। এর বাইরে এলাকার গরীব ও মেধাবী ছাত্র/ছাত্রীদের শিক্ষা সহায়তা এবং বয়স্কদের ধর্মীয় জ্ঞানে সহায়তার লক্ষ্যে ইসলামী বইপত্র বিতরণ করা হয়। আশা করি, একদিন আনোয়ারা ফাউন্ডেশন বড় প্রতিষ্ঠান হবে এবং কার্যক্রমেও ব্যাপকতা আসবে। কিন্ত বিভিন্ন বিপর্যস্ততা ও সহযোগীর অভাবে তা আমি বেশিদিন চালিয়ে যেতে পারিনি। যদিও সে ব্যর্থতা অন্তরে খুব বেজেছে অনেকদিন। ইতোমধ্যে সুরমা-কুশিয়ারায় অনেক জল গড়িয়ে গেছে। আশেপাশের চতুর, নিমকহারাম, স্বার্থপর এবং বন্ধুবেশী প্রতারকদের চরিত্র তখন আমার কাছে প্রস্ফুটিত হতে থাকে। তবু আমি টু শব্দ করি না। এরপর এদের ৩/৪ জন (যারা আমার কাঁধে ভর করে ততক্ষণে স্বাবলম্বী হয়ে গেছে)- এর লাথি খেয়ে আমার হুশ হয়। জীবনের পড়ন্ত বেলায় থিতু হওয়ার, মাথা তোলার এবং একান্ত নিজের স্বপ্ন, সাধ-আহ্লাদের উপলব্ধি আসে। এ ক্ষেত্রে ২০০৪ সাল থেকে জীবনবাদী কিছু বইপত্র স্টাডি কাজ দেয়। বলা যায়, ২০০৪ সাল আমার জাগরণের বছর।
‘নিজের ভেতর জ্বলতে থাকা অঙ্গিস্ফুলঙ্গ নিভতে দিও না’, ‘অন্যের স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে নিজের জীবনকে নষ্ট করো না।’…….- এমনতরো প্রাজ্ঞবচন আমাকে উজ্জীবিত করে। তদুপরি পত্রপত্রিকার মাধ্যমে জানা গেলো, আমার অন্যতম প্রিয় ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ মাত্র ৩৫ টাকা দিয়ে শুরু করে আজকের বিশাল বিশ^সাহিত্য কেন্দ্র গড়েছেন, প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ৮৫৬ টাকা দিয়ে (পরীক্ষামূলকভাবে) শুরু করেন গ্রামীণ ব্যাংক, যা আজ নোবেলজয়ী বিশাল প্রতিষ্ঠান, ময়মনসিংহের সদর উপজেলার দূর্গম টানহাসাদিয়া গ্রামের জয়নাল আবেদিন (যার পিতা বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন তার চোখের সামনে) রিক্সা চালানোর স্বল্প সঞ্চয় দিয়ে মমতাজ হাসপাতাল গড়েছেন। সাথে প্রাথমিক বিদ্যালয় ও নারীদের সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এরকম আরো কত কী! এছাড়া নিজের দুঃখ-দূর্দশার সাথে সাথে আশেপাশে মানুষের দুঃখ-দূর্দশা আমাকে খুব ব্যথিতও করত। বলা দরকার, মায়ের নামে সামাজিক একটি প্রতিষ্ঠান করার সাথে সাথে মানুষের জন্য কিছু করার কথা তাই সেই শৈশব, কৈশোর ও তারুণ্যে খুব ভেবেছি। বলা দরকার, সে সুযোগে বন্ধুবেশী অনেকে সমাজ সেবার নামে ব্যক্তিগত স্বার্থে আমাকে বহুবার বহুভাবে ব্যবহার করেছে। যাদের কথায় কাজে মিল নেই। এতে করে বহু সময় ও শ্রম আমার অযথা ব্যয়িত হয়েছে।
অবশেষে আল্লাহকে স্মরণ করে ‘স্মল ইজ বিউটিফুল’ কিংবা ‘সব গাছই একদা বীজ ছিলো’ এই আলোকে আবার ২০১৩ সালের ১৪ মে থেকে শুরু করি পারিবারিক ক্ষুদ্র সঞ্চয়। এক্ষেত্রে আমার স্ত্রী ও ছেলে সহযোগিতার হাত বাড়ায়। ৩১ ডিসেম্বর ২০১৩ পর্যন্ত সঞ্চিত হয় ১১০০ টাকা। তা দিয়ে ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি ভীরু পায়ে পুণরায় যাত্রা শুরু হয় আনোয়ারা ফাউন্ডেশনের। দেখতে দেখতে ইতোমধ্যে আট বছর পেরিয়ে গেছে। এখন আমরা স্বপ্ন দেখছি- একটি সুপরিচিত, স্থায়ী ও স্বনির্ভর প্রতিষ্ঠানের। বিগত দিনের পারিবারিক ক্ষুদ্র সঞ্চয়, কায়িক শ্রম ও মেধা দিয়ে অনেক ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ ও প্রতিকূলতা ডিঙ্গিয়ে আমরা ছোট ছোট অনেকগুলো কাজ করেছি মানব ও প্রকৃতি কল্যাণে। আশার কথা, কম্পিউটার প্রকৌশলে অধ্যায়নরত তরুণ লেখক আমার ছেলে আনিসুল আলম নাহিদের দক্ষ পরিচালনায় ২০২১ সাল থেকে আনোয়ারা ফাউন্ডেশনের যাবতীয় কার্যক্রমে গতিশীলতা এসেছে। আমার স্ত্রী ও ছেলের সহায়তায় ফাউন্ডেশনের জন্য পারিবারিক সঞ্চয় চলছে এবং চলবে ইনশাআল্লাহ। তারা একেবারে সাধারণ জীবন-যাপনের সাথে সাথে ফাউন্ডেশনের জন্য প্রতিনিয়ত প্রচুর শ্রম ও মেধা ব্যয় করছে। পারিবারিক কৃষি থেকেও ফাউন্ডেশনে বিভিন্নভাবে সহায়তা করা হচ্ছে। এছাড়াও আমাদের পারিবারিক উদ্যোগে অন্যান্য ভাবেও ফাউন্ডেশনের জন্য ফান্ড গঠনের প্রচেষ্টা চলছে। উল্লেখ্য, বিনা টাকায় কিংবা অল্প টাকায় আমরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হলেও ইতোমধ্যে কায়িক শ্রম ও মেধা দিয়ে মানুষ ও প্রকৃতির জন্য ভালো কিছু করতে পেরেছি। উল্লেখ্য, অদ্যাবধি ফাউন্ডেশনের জন্য আমরা কারো কাছ থেকে কোনো টাকা-পয়সা গ্রহণ করিনি।
আনোয়ারা ফাউন্ডেশনের কথা বিভিন্নভাবে আমি অনেক বলেছি। আজ সংক্ষেপে শুরুর কথা (এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা) বলা হল। আমি হর-হামেশা এই ফাউন্ডেশনের সফলতার জন্য মহান আল্লাহ তালার দরবারে প্রার্থনা করছি। বলা যায়, ধর্ম-কর্মের পরে আমার দ্বিতীয় চিন্তা এখন আনোয়ারা ফাউন্ডেশন। দুরু দুরু বুকে শুরু করলেও এই ২০২২ সালে এসে আনোয়ারা ফাউন্ডেশন নিয়ে আমার উল্লেখ করার মতো কোনো সংকোচ-সংকীর্ণতা আর নেই। আশার কথা, মানব ও প্রকৃতি কল্যাণে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অথচ ভালো কাজ দিয়ে তরুণ উদ্যোক্তা ও পরিচালক আনিসুল আলম নাহিদ এবছর (২০২২) থেকে ঘরে-বাইরে,কাছে-দূরে ও দেশে-বিদেশে ক্রমান্বয়ে আনোয়ারা ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম তুলে ধরতে আন্তরিকভাবে কাজ করছে। একই সাথে দেশ-বিদেশের প্রতিষ্ঠিত ও জনকল্যাণকামী অন্যান্য ফাউন্ডেশনের প্রতি নজর রাখার ও সেসবের সাথে যোগাযোগ করার প্রচেষ্টা চলছে। ইনশাআল্লাহ খুব ছোট থেকে শুরু করা আনোয়ারা ফাউন্ডেশন মানব ও প্রকৃতি কল্যাণধর্মী কাজের মাধ্যমে এবং সমাজ হিতৈষীদের সহযোগিতায় একদিন সময়োপযোগী একটি স্থায়ী ও স্বনির্ভর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।
লেখক, সম্পাদক- আনোয়ারা (শিকড় সন্ধানী প্রকাশনা), প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান- আনোয়ারা ফাউন্ডেশন ও রাজীব স্মৃতি পাঠাগার, যোবায়েদা ভিলা, দেওয়ান বাজার, গহরপুর, সিলেট।