বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
Sex Cams

এস এম হেলাল

সংক্ষিপ্ত জীবনী: হযরত কনাই শাহ্ (রহ.)



হযরত কনাই শাহ্ (রহ.)। যাঁর জীবনের অধিকাংশ সময়ই মাবুদের ধ্যান ও মানুষের কল্যাণে উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর স্বীয়কর্মে দেশ বিদেশের অসংখ্য মানুষের মনে চিরস্মরণীয় এবং অমর হয়ে আছেন তিনি।

জানা যায়, হযরত কনাই শাহ্ (রহ.) মানুষের কাছে ছিলেন একজন অলি। কারো কাছে তিনি আল্লাহর অন্যতম যুগশ্রেষ্ঠ অলি, কারো কাছে শহরকুতুব, আবার কারো কাছে মাজ্জুব অলি, আধ্যাত্মিক সাধক, ফকির-দরবেশ হিসেবে আখ্যায়িত। এই অলি জীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করেছেন মহান আল্লাহ তায়ালার ধ্যান এবং মানুষের কল্যাণে।

হযরত কনাই শাহ্ (রহ.)-এর এর জন্ম ও বংশ পরিচয়: হযরত কনাই শাহ্ (রহ.) সিলেট জেলার বালাগঞ্জ উপজেলার শিওরখাল (কদমতলা) গ্রামে এক মুসলিম পরিবারে আনুমানিক ১৮০০ সালের শেষের দিকে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হযরত শেখ ইউনুছ শাহ্ (রহ.) এবং মাতা নছিবা বিবি। হযরত শেখ ইউনুছ শাহ্ (রহ.)-এর বাবা হচ্ছেন শেখ লাকু। শেখ লাকুর বাবা হচ্ছেন হযরত শেখ তাজ উদ্দিন (রহ.)। সুলতানুল আউলিয়া হযরত শাহ্ জালাল (রহ.) আরব থেকে দ্বীন ইসলাম প্রচারে যখন বাংলাদেশের শ্রীহট্রে (বর্তমান সিলেট) আগমন করেন, তাঁর অন্যতম সফর সঙ্গী ছিলেন হযরত শেখ তাজ উদ্দিন (রহ.)। যাঁর মাজার সিলেট জেলার অবিভক্ত বালাগঞ্জ উপজেলার দয়ামীর ইউনিয়নের খাঁপন গ্রামে। হযরত শেখ তাজ উদ্দিন (রহ.)-এর ২জন পুত্র ছিলেন। একজনের নাম শেখ লাকু এবং অন্যজনের নাম শেখ আনোয়ার। শেখ আনোয়ার ও তাঁর বংশধররা খাঁপনে বসবাস করলেও শেখ লাকু চলে যান সিলেটের বরইকান্দি গ্রামে। শেখ লাকুর চার সন্তানের মধ্যে কনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন শেখ ইউনুছ। শেখ লাকুর অন্য সন্তানরা হলেন – শেখ রফি, শেখ শফি ও শেখ নাজু। তাদের বংশধররা সিলেটের বরইকান্দি গ্রামে বসবাস করেন।

শেখ লাকুর ইন্তেকালের পর বিধবা স্ত্রী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন হযরত জাকির শাহ্ নামক আরেক আল্লাহর অলির সাথে। মা শিশু পুত্র শেখ ইউনুছকে সাথে নিয়ে চলে আসেন বালাগঞ্জ উপজেলার দেওয়ানবাজার ইউনিয়নের শিওরখাল কদমতলা গ্রামে আধ্যাত্মিক সাধক হযরত জাকির শাহ্ (রহ.)-এর কাছে। মায়ের সাথে থাকা শিশু শেখ ইউনুছ সেখানে ধীরে ধীরে ইউনুছ শাহ্ নামে বড় হন। পালক পিতা হযরত জাকির শাহ (রহ.) কে অনুস্মরণ করে তিনিও আধ্যাত্মিক সাধনায় উন্নতি সাধন করেন।

হযরত জাকির শাহ্ (রহ.)-এর পুর্বের নাম ছিল শ্রৗ চাঁন্দ ঠাকুর। তিনি একজন ভূ-স্বামী ছিলেন। তাঁর মালিকানায় কয়েকটি তালুকও ছিল। আধ্যাত্মিক সাধনায় মগ্ন হয়ে তিনি ধর্মান্তরিত হয়ে জাকির শাহ্ নাম ধারণ করেন। তাঁর মুর্শিদ ছিলেন হযরত ডুমাই শাহ্ (রহ.)। দয়ামীর পীরবাড়ী হযরত ডুমাই শাহ্ (রহ.)-এর মাজার বিদ্যমান রয়েছে।

হযরত ইউনুছ শাহ্ (রহ.)-এর সাত সন্তান ছিলেন। তার মধ্যে হযরত কনাই শাহ্ ছিলেন সবার বড়। হযরত কনাই শাহ্ (রহ.), তাঁর অন্য ভাইগণ ও তাদের সন্তানদের নাম যথাক্রমেঃ-
১.হযরত কনাই শাহ্ (রহ.)। তিনি ছিলেন সংসার ত্যাগী।
২. হযরত ধনাই শাহ্। তাঁর ৩ মেয়ে- (ক) মিছিরা বিবি-স্বামী জফর উল্লাহ। গ্রাম চক আতাউল্যা, দয়ামীর, ওসমানী নগর। (খ) আস্তরা বিবি- স্বামী আছমত উল্লাহ, গ্রাম রিফাতপুর, বালাগঞ্জ। (গ) কস্তরা বিবি- স্বামী মৃত নুর মিয়া, গ্রাম আতাউল্যাহ, দয়ামীর, ওসমানীনগর।
৩. ছনাই শাহ্। তাঁর ৩ মেয়ে। যথাক্রমে (ক) আরবি বিবি- স্বামী মৃত রেজান খাঁন, গ্রাম চিন্তামনি, দয়ামীর, ওসমানীনগর। বর্তমান ঠিকানা রায়খাইল, জালালপুর, দক্ষিণ সুরমা। (খ) সাহারা বেগম- স্বামী মৃত সালামত মিয়া, গ্রাম বারখলা, দক্ষিণ সুরমা, সিলেট। (গ) জাহানারা বেগম- স্বামী লালু মিয়া, চিন্তামনি, দয়ামীর, ওসমানীনগর।
৪. মনাই শাহ্। তিনি সংসার ত্যাগী ছিলেন।
৫. মিছির শাহ্। তিনি ‍ও সংসার ত্যাগী ছিলেন।
৬. ইছুব শাহ্। তাঁর ৪ সন্তান। যথাক্রমে- (ক) মরহুমা ফজর বিবি-স্বামী মৃত জসিম উল্যাহ্, গ্রাম নিজগহরপুর দিঘীরপার, বালাগঞ্জ (খ) মরহুম শাহ্ আব্দুল জব্বার, গ্রাম শিওরখাল (কদমতলা), গহরপুর, বালাগঞ্জ। (গ) আসরভি বিবি- স্বামী জহুর আলী, গ্রাম নিজ সিলাম, দক্ষিণ সুরমা। (ঘ) শাহ্ আব্দুস ছাত্তার, গ্রাম শিওরখাল (কদম তলা) গহরপুর, বালাগঞ্জ।
৭.ইয়াকুব শাহ্। তাঁর ৩ সন্তান। যথাক্রমে- (ক) আছারুন বিবি- স্বামী আব্দুল জব্বার, নশিওরপুর, বালাগঞ্জ (খ) শাহ্ আব্দুস ছুবহান, গ্রাম শিওরখাল কদমতলা, গহরপুর, বালাগঞ্জ। (গ) শুকুর বিবি- স্বামী আপ্তাব আলী, দয়ামীর, ওসমানীনগর।

হযরত কনাই শাহ্ (রহ.)-এর ভাইদের মধ্যে হযরত ধনাই শাহ্ ও ইছুব শাহ্ কে দয়ামীর কনাই শাহ্ (রহ.)-এর মাজারের পার্শ্বে সমাধি করা হয়। এবং হযরত ছনাই শাহ্ দক্ষিণ সুরমার জালালপুর ইউনিয়নের রায়খাইল গ্রামে আস্তানা করেন বিধায় সেখানে তাঁর মাজার রয়েছে। এছাড়া সবার কনিষ্ঠ ইয়াকুব শাহ্ -এর মাজার শিওরখাল কদমতলা নিজ বাড়ীতে রয়েছে।

প্রসংঙ্গত, হযরত কনাই শাহ (রহ.)-এর বংশধরদের মধ্যে হযরত শেখ শাহ্ তাজ উদ্দিন (রহ.), হযরত ইউনুস শাহ্ (রহ.)সহ আরো অলি-আউলিয়ার নাম লেখক আব্দুল হাই মোশাহিদ এবং লেখক আব্দুর রশীদ লুলুসহ বিভিন্ন লেখকের লেখায় উল্লেখ রয়েছে। এছাড়াও তাঁর ছোট ৬ ভাইদের মধ্যে মাজ্জুব আল্লাহর অলি হযরত মনাই শাহ্ (রহ.) ও মিছির শাহ্ -এর নাম উল্লেখযোগ্য। তাঁদের মধ্যে শিওরখাল কালা শাহ্ (রহ.)-এর মাজার কবরস্থানে হযরত মনাই শাহ্ ও হযরত মিছির শাহ্ এবং তাঁদের পিতা হযরত ইউনুছ শাহ্ (রহ.)কে শিওরখাল কদমতলা গ্রামে সমাহিত করা হয়েছে ।

ব্যক্তিগত জীবন: ভবঘুরের মত কাঁধে ঝোলা, হাতে লাঠি-ছুলফি, একা-একা কথা বলতে বলতে কনাই শাহ্ পথ চলতেন। সাথে ভক্তবৃন্দ তাঁকে অনুসরণ করতেন। অনেকে টাকা পয়সা দিলে কারও টাকা গ্রহণ করতেন আবার কারও কাছ থেকে নিতেন না। আবার কারো কাছে খাজনা দে বলে চেয়ে নিতেন। শীত- গ্রীষ্ম, বৃষ্টি-বাদলের দিনেও কনাই শাহ্ পথে বেরুতেন। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ কোন কৃষকের জমিতে ধান রোপন অথবা ধান কাঁটায় লেগে যেতেন। কোন সময় নেরাও কাঠতেন। তাকে অনুস্মরণ করে ভক্ত বৃন্দরাও সাথে সাথে কাজে লেগে যেতেন। বিনা মজুরীতে দিনভর কাজ করে চলে আসতেন। বাজারে তাঁকে দেখা যেতো কেনা-কাটায়। তবে চাল, সবজী, মাছ প্রভৃতি ভার ভরে দয়ামীরসহ আশপাশ গ্রামে কারো বাড়িতে পাঠিয়ে দিতেন অথবা নিজে দিয়ে আসতেন। নিজের ভাই-ভাতিজাদের এসব তেমন দিতেন না। সান্ত্বনাস্বরূপ তাদের বলতেন, লোভ করো না এসব সাপের লাল। আমার কেউ অনাহারে মরবে না। সারা দুনিয়া ক্ষেত করে যাচ্ছি। জনশ্রুতি এমন যে, তিনি যাদের এসব চাল, সবজি, মাছ প্রভৃতি প্রদান করেছেন পরবর্তীতে এই পরিবারগুলো নানাভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে।

পবিত্র-কুরআন ও হাদিসের দৃষ্টিতে অলি-আউলিয়া: মহান আল্লাহ যার প্রতি দয়া করেন তিনি তাঁর সান্নিধ্য পেয়ে থাকেন। কেবল শ্রষ্টার দিকেই নিবিষ্ট থাকে তাঁদের ধ্যান, জ্ঞান ও চৈতন্য। তাঁদের অনেকেই সমাজের চোখে পাগল। তাসাউফে বা সুফিবাদে এসব পাগলদের বলা হয় আল্লাহর মাজ্জুব অলি। অলি শব্দের অর্থ বন্ধু এবং অলির বহুবচন হচ্ছে আউলিয়া। মহাগ্রন্থ পবিত্র কুরআনে ‘‘অলি’’ এবং “আউলিয়া” এ উভয় শব্দটি অনেকবার এসেছে। পবিত্র কুরআনে সূরা ইউনুসের ৬২-৬৪ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, জেনে রাখো! নিশ্চয় আল্লাহর অলিগণের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তাগ্রস্থ ও হবে না-যারা ঈমান এনেছে এবং যারা আল্লাহর অসন্তুষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করে চলেন। তাদের জন্য সুসংবাদ পার্থিব জীবনে ও পরকালীন জীবনে।

নবী করিম (স.) ইরশাদ করেন, অনেক লোক আছে যাঁদের পোষাক এলোমেলো, চুল উস্কোখুস্ক, তোমাদের দরজা থেকে প্রায়ই তাড়িয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তাদের শান এ রকম যে, যদি তাঁরা আল্লাহর কাছে কিছু চায়, আল্লাহ তাহা তৎক্ষণাৎ কবুল করেন। তাদের মুখ থেকে যা বের হয় তাই হয়ে যায়।

এখানে বলাবাহুল্য যে, সকল পাগলই অলি নয়। তবে প্রত্যেক মাজ্জুব তথা আল্লাহর প্রেমের পাগলরাই আল্লাহর অলি। অলিগণ আল্লাহর বন্ধু হয়ে থাকেন।
হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ পাক ইরশাদ ফরমান, “যে আমার অলির সাথে দুশমনি করে তার সাথে আমি যুদ্ধের চ্যালেঞ্জ করলাম।” (বুখারী: আস-সহীহ্; হাদীস: ৬৫০২)।

ভক্তদের সাথে ফকির কনাই শাহ্ (রহ.):  ভক্তরা কনাই শাহ্ (রহ.)-এর সাথে সাথেই থাকতেন। সাধারণত ভক্তদের ব্যাপারে তিনি নির্লিপ্ত থাকতেন। তবে অতিষ্ট হলে যা তা বলতেন।

হালতুন্নবী ও ফকির কনাই শাহ্ (রহ.): নাগরী হালাতুন্নবী পুঁথিপাঠ শোনা ছিল ফকির কনাই শাহ্-এর প্রিয় অভ্যাস। তিনি নাগরী পড়া জানতেন না বলেই জানা যায়। দয়ামীর গ্রাম নিবাসী মরহুম ইউনুস উল্লাহ (যাকে তিনি হাওয়াল বলে ডাকতেন) বেশির ভাগ সময় তাঁকে নাগরী পুঁথি (হালতুন্নবী) পাঠ করে শোনাতেন। কনাই শাহ্ নাগরী পুঁথি পাঠকালে নিবিষ্ট মনে শোনতেন এবং প্রিয় নবীজি (স.)-এর জীবন চরিত্র শ্রবণকালে অঝোর ধারায় অশ্রুপাত করতেন। তাঁকে গুনগুন করে অস্পষ্ট ভাষায় মাঝে মধ্যে গান গাইতেও দেখা যেত।

পশু পালন: কনাই শাহ্ (রহ.) পশুদের মধ্যে বিড়ালকে খুব বেশি আদর করতেন এবং রাজহাঁস পোষতেন। তাঁর অসিয়ত মতে ভাই-ভাতিজাদের তাঁর পোষা রাজহাঁস এবং এসব হাঁসের ডিম খাওয়া নিষেধ। এখনো সেই রাজহাঁসের বংশ বিদ্যমান রয়েছে।

মানুষের যাতায়াত: হযরত কনাই শাহ্ (রহ.)-এর কাছে প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক নারী-পুরুষ যাতায়াত করতেন – তাগা, তেল, পানি পড়ানোর জন্য। এমনকি যেকোন ছোট-বড় সমস্যা হলেই সমাধনের জন্য কনাই শাহ্ (রহ.)-এর নিকট ছুটে যেতেন। এছাড়া হযরত কনাইশাহ্ (রহ.)-এর জীবদ্দশায় তাঁর কাছে যেতেন এমনকি ইন্তেকালের পর তাঁর মাজারে নিয়মিত যাওয়া-আসা করে দুনিয়া ত্যাগ করেছেন এমন কিছু মানুষদের মধ্যে অন্যতম কয়েকজন হলেন – জেনারেল এমএজি ওসমানী (জলালপাড়া, দয়ামীর, ওসমানীনগর)। কঠাই উল্লাহ (ইছামতি সন্ধাশী পাড়া, দয়ামীর, ওসমানীনগর)। তছর আলী (সিকন্দর পুর, গোয়ালাবাজার, ওসমনানীনগর)। মহিব উল্লাহ্ (সোনাপুর, বোয়ালজুড়, বালাগঞ্জ)। আপ্তাব মিয়া (খাদিপুর জালালপুর, দক্ষিণ সুরমা)। সোনাফর আলী চেয়ারম্যান (পলিরচর, শ্রীপুর, দোয়ারা, সুনামগঞ্জ)। মনোহর আলী (পলিরচর, শ্রীপুর, সুনামগঞ্জ)। নাইওর আলী (শ্রীপুর, সুনামগঞ্জ)। আব্দুল ওয়াহিদ মুস্তান (কাশিকাপন, ওসমানীনগর)। হুসমত উল্লাহ (দৌলতপুর, দয়ামীর, ওসমানীনগর)। হাজী আবরুজ আলী লন্ডনী (চিন্তামনি, দয়ামীর, ওসমানীনগর)। ঠাকুর মিয়া (কাদিপুর, জালালপুর, দক্ষিণসুরমা)। মো. সোয়াব আলী (খাদিপুর, জালালপুর, দক্ষিণ সুরমা)। হাজী সজ্জাদ আলী লন্ডনী (খালিয়া, দয়ামীর, ওসমানীনগর)। মুজেফর আলী মুস্তান (ঘোষগাঁও,দয়ামীর, ওসমানীনগর)। মরম আলী চেয়ারম্যান (কাউরাই, দয়ামীর, ওসমানীনগর)। আপ্তাব মিয়া (নিজগাঁও, লালাবাজার, দক্ষিণ সুরমা)। মবশ্বর আলী (গাংপার, দয়ামীর, ওসমানীনগর)। আওলাদ আলী (পালপাড়া, তাজপুর, ওসমানীনগর), জুয়াদ উল্লাহ্ (চকমন্ডল কাপন, দয়ামীর, ওসমানীনগর)। আসিক আলী (মিরার গাঁও, দয়ামীর, ওসমানীনগর)। মতছির আলী পেন্টই (মিরার গাঁও, দয়ামীর, ওসমানীনগর)। শফিক মিয়া (বরই কান্দি, দক্ষিণ সুরমা)। আমান উল্লাহ্ (কুনাপাড়াা দয়ামীর, ওসমানীনগর)। আজর উল্লাহ্ (দয়ামীর, ওসমানী নগর)। মর্তুজ আলী (দয়ামীর, ওসমানীনগর)। আব্দুল গনি (চক আতাউল্লাহ, দয়ামীর, ওসমানী নগর)। রইম উল্লাহ্ (সন্ধাশীপাড়া ইছামতি, ওসমানীনগর)। তেরা মিয়া (সন্ধাশীপাড়া ইছামতি, ওসমানীনগর)। জইন উল্লাহ্( সন্ধাশীপাড়া ইছামতি, ওসমানীনগর)। হুসন আলী( সন্ধাশীপাড়া ইছামতি, ওসমানীনগর)। মগন উল্লাহ্ (সন্ধাশীপাড়া ইছামতি, ওসমানীনগর)। আইন উল্লাহ (সন্ধাশীপাড়া ইছামতি, ওসমানীনগর)। আয়াত উল্লাহ্ (চকআতা উল্লাহ্, দয়ামীর, ওসমানীনগর)। বীরবল লাল (ফুরকাতি বাজার, কুরুয়া, ওসমানীনগর)। আনফর উল্লাহ( সুয়ার গাঁও, দয়ামীর, ওসমানীনগর)। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বিরাই উল্লাহ (থানা গাঁও, কোনাবন্দ, ওসমানী নগর)। তুতি মিয়া (বরইকান্দি, দক্ষিণ সুরমা)। শফিক মিয়া (বরইকান্দি, দক্ষিণ সুরমা)। আশ্বব আলী লন্ডনী (কান্দিগাঁও, বিশ্বনাথ)। উকিল আলী (বল্লবপুর, জগন্নাথপুর)। ছৈইদ আলী লন্ডনী (দতা, বিশ্বনাথ)। আব্দুল জাহির (রঙিয়া, তাজপুর, ওসমানীনগর)। মাসুক আলী (মাকড়সী, বালাগঞ্জ)। মন্তাজ উল্লাহ্ (চক আতাউল্লাহ, দয়ামীর, ওসমানীনগর)। সুয়াব আলী (বড়গল্লাহ, ছাতক)। আব্দুল জব্বার (মাঠিহাইন, তাজপুর, ওসমানীনগর প্রমুখ ব্যক্তিগণ।

জেনারেল ওসমানী ও কনাই শাহ্ (রহ.)-এর সর্ম্পক: বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী ও কনাই শাহ্ (রহ.)-এর মধ্যে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। জেনারেল ওসমানী দয়ামীর আসলে দেখা করতেন কনাই শাহ্ (রহ.)-এর সাথে। কনাই শাহ্ (রহ.) ওসমানীকে বাদুর (বাহাদুর) ও বাদুর মোড়ল নামে ডাকতেন।

জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধে যাবার পূর্বে কর্ণেল ওসমানী একান্তে কথা বলেন ফকির কনাই শাহ্ (রহ.)-এর সাথে। নিজের আস্তানায় কনাই শাহ্ (রহ.) কাউকে বসতে বলতেন না। শুধু ওসমানীকে বসার জন্য বলতেন। ওসমানী সাহেব চেয়ারে বসতে না চাইলে রাগ করে কনাই শাহ্ (রহ.) বসতে বলতেন। যুদ্ধ চলাকালেও তিনি কনাই শাহ্ (রহ.)-এর সাথে দেখা করতে আসতেন। যেদিন জেনারেল ওসমানী আসতেন সেদিন কনাই শাহ্ (রহ.) বলতেন চেয়ার নিয়ে এসো আমার বাদুর আসবে। সেদিন সবাই বুঝতেন যে আজ জেনারেল ওসমানী সাহেব আসবেন।

কনাই শাহ্ (রহ.) -এর ইন্তেকালের পরও জেনারেল ওসমানী দয়ামীর এলেই ছুটে যেতেন কনাই শাহ্ (রহ.)-এর মাজারে। মুক্তিযুদ্ধের প্রথমদিকে পাকবাহিনী কনাই শাহ্ (রহ.)কে আক্রমণের ব্যর্থ চেষ্টা করে। এরপর বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ায় ক্ষমা প্রার্থণা করে তাঁর কাছে। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মহাসড়ক দিয়ে ভক্ত-মুরিদানসহ যাতায়াতকারী কনাই শাহকে পাকবাহিনীর সেনারা সমীহ করে এড়িয়ে চলতো। তিনি পাকিস্তানবাহিনীর প্রতি বিরপ ছিলেন বলে তাঁর ভক্তরা উল্লেখ করেন।

হযরত কনাই শাহ্ সম্পর্কে প্রখ্যাত বুযুর্গ আল্লামা গহরপুরী (রহ.)-এর মন্তব্য: প্রখ্যাত বুযুর্গ আল্লামা হাফিজ নুরুদ্দিন আহমদ গহরপুরী (রহ.)কে মাঝে-মধ্যে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে দাঁড়িয়ে হযরত কনাই শাহ্ (রহ.)-এর মাজার জিয়ারত করতে দেখা যেতো। তিনি একান্ত আলাপকালে  বলেন, ”খবরদার কনাই শাহ্ হওয়ার চেষ্টা করো না। বেটা কামাইয়ারা পাগল ছিলো। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করো”।

শিক্ষাজীবন ও যৌবন: প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তিনি তেমন শিক্ষা অর্জন করেননি। বাল্যকালে মক্তব পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন বলে জানা গেছে। এরপর তিনি যৌবনে কৃষিকাজসহ অন্যান্য কাজকর্ম স্বাভাবিকভাবেই করতে থাকেন। একদা কোন জরুরী প্রয়োজনে তিনি সিলেট শহরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন এমন সময় তাঁর পঞ্চম ভাই মিছির শাহ্ কনাই শাহ্ (রহ.)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন, “ভাই তুমি আজ সিলট যাইওনা। আইয়া আমারে পাইতায় নায়”। কিন্তু কনাই শাহ্ সে কথায় সাড়া না দিয়ে জরুরী প্রয়োজনে সিলেটে চলে যান। পরে বাড়ি ফিরে ঠিকই ভাই মিছির শাহ্ কে আর জীবিত অবস্থায় পাননি। তখন থেকেই তিনি অস্বাভাবিক চিন্তামগ্ন হয়ে পড়েন এবং সেদিন থেকে তিনি সবার সাথে অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা প্রায় বন্ধ করে দেন। তাঁর সত্য পিপাসু হৃদয়ের গহীনে স্রষ্টার প্রেম দিনেদিনে প্রবল হতে থাকে। একসময় তিনি পার্শ্ববর্তী রঘুপুর গ্রামে এক দরবেশ হযরত আয়াস শাহ্ (রহ.)-এর কাছে প্রতিনিয়ত যাতায়াত শুরু করেন।

এদিকে দীর্ঘদিন ধরে ছেলের উদাসীনতা দেখে তাঁর মা কনাই শাহ্ (রহ.)-কে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করান। তাতেও কনাই শাহ্ (রহ.)-এর জীবনের তেমন পরিবর্তন হয়নি, এমনকি সংসারও ঠিকেনি। মায়ের বড় ছেলে বলে কথা, পুনরায় সুন্দরী দেখে নিজের আত্মীয়ের মধ্যে মা তাঁর ছেলের জন্য দ্বিতীয়বারের মতো ঘরে বউ তুলে আনেন। কিন্তু সে সংসারও কনাই শাহ্ (রহ.)-এর স্থায়ী হয়নি। শুধু স্ত্রীকে তিনি বলেছিলেন, কনাই তার মায়ের জন্য বউ আনছে। তুমি যদি সবর করে থাকতে পারো থাক। না হয় নিজের জীবনের কথা ভাবো। আমাকে তুমি এ জীবনে পাবে না।

আল্লাহপাকের শান-মান বুঝা মুশকিল। তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। তিনি এক, অদ্বিতীয়, অসীম দয়ালু। তিনি যাকে ইচ্ছা কেবল তার কাছেই নিজের রহস্য উন্মোচন করেন। আল্লাহ্ তায়ালার সান্নিধ্যপ্রাপ্ত ঈমানদারদের হৃদয়েই মাবুদের সিংহাসন। যাদের ক্বলবে আল্লাহর আরশ তারা কি আর জগত সংসারের মোহে থাকতে পারে? এজগতের সবকিছুই তাঁদের কাছে তুচ্ছ। কেবল মাবুদই সার। সেজন্যই ভাবুক ফকির শিতালং শাহ্ হয়তো এভাবে গেয়েছিলেন:-

পিরিতের ছেল বুকে যার কলঙ্ক তার অলঙ্গকার
কুলমানের ভয় নাইরে তার ।।

পিরিতের নয় নিশানি সদায় থাকে মন উদাসী-গো
সদায় থাকে প্রেমানলে নিরানন্দ নাহি তার ।।

ক্ষুধা তৃঞ্চা না লয় মনে নিদ্রা নাই তার দুই নয়নের গো
এগো ছির ঘুরে প্রেম ধুন্ধে দিবানিশি ইন্তেজার ।।

হাসি খুশি নাই তার মনে,সদায় থাকে মোর নয়নে গো
এগো নাইয়ে তার লাজভয় নাই তার কলঙ্ক অলঙ্কার ।।

প্রথম পিরিতে মজা,দ্বিতীয় পিরিতে সাজা গো
এগো তৃতীয় পিরিতে রাজা রঙ্গ খুশি বেশুমার ।।

যার গলে পিরিতের ফাঁসি সে হয় সকলের দাসী গো
লোকের নিন্দন পুষ্পচন্দন অলংকার পইরাছে গায় ।।

শিতালং ফকিরে বলে প্রেমের মালা যার গলে গো
কেওরর কথা নাহি শুনে কেবল বন্ধু বন্ধু সার ।।

মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আধ্যাত্মিক সাধনায়: হযরত আয়াস শাহ্ (রহ.) ইন্তেকালের কিছুদিন পূর্বে একদা রাতে হুজরাখানায় হঠাৎ বলে উঠলেন যে, তোমরা আমার কাছে কে কি চাও? আমাকে আর বেশিদিন পাবে না। তখন উপস্থিত কয়েকজন লোকদের মধ্যে মুর্শিদের কথায় শিওরখাল কদমতলা নিবাসী ইনসান শাহ্ বললেন, বাবা আমি খাইতাম আর গাইতাম। আরো কয়েকজন ধনদৌলতসহ বিভিন্ন কিছু চেয়ে দোয়া চাইলেন। কেবল হযরত কনাই শাহ্ (রহ.) বললেন, বাবা আমি একমাত্র আল্লাহকে চাই। তখন মধ্যরাত, ভক্তদের কথাশুনে হযরত আয়াস শাহ্ (রহ.) বলেন, ঠিক আছে আমাকে তোমরা রাত শেষ হওয়ার আগে হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজারের ধুলা এবং নিয়ামতপুর (বালাগঞ্জের গহরপুর) মাজারের বটগাছের পাতা এনে দাও। তখন মুর্শিদের কথামত সবাই একমত হয়ে ছুটেন সিলেট শহরের দিকে হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজারের উদ্দেশ্যে ধুলা আনতে। তবে কনাই শাহ্ (রহ.) বলেন তোমরা সবাই যাও, আমি আগে যাবো নিয়ামতপুরের মাজারের পাতার জন্য আর পরে যাবো সিলেটে।

ঠিক কথামতো সবাই ফজরের আযানের আগে মুর্শিদের সামনে এসে হাজির হলেও একমাত্র হযরত কনাই শাহ্ (রহ.) নিয়ামতপুর মাজারের বটগাছের পাতা এবং হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজারের ধুলা নিয়ে আসতে সমর্থ হন। কিন্তু বাকীরা হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজারের ধুলা নিয়ে আসলেও নিয়ামত পুর মাজারে এসে দেখেন আসমান জমিনে কে যেন দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাই ভয়ে মাজারের কাছে না গিয়ে চলে আসেন। তখন হযরত আয়াস শাহ্ (রহ.) সবাইকে যারযার মনবাসনা পুরণের জন্য দোয়া করে বলেন, কনাই তুমি তোমার মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসো।

কথামত সকালে বাড়ীতে এসে হযরত কনাই শাহ্ (রহ.) মাকে বললেন মা, আমাকে একমুটো চাল দাও! বেশকয়েক দিনপর ছেলেকে দেখে মা খুশি হয়ে বললেন কি করবে চাল দিয়ে? মা আমাকে ভিক্ষা দাও। মা বললেন, পাগল এইনে। তখন কনাই শাহ্ (রহ.) বললেন মা আমি চললাম সারাজীবনের জন্য, আমাকে আখেরাতে পাবে।

এরপর থেকে তিনি ভবঘুরের জীবন যাপন শুরু করেন। কাঁধে ঝুলি, হাতে ছুলফি (বর্শা) এবং লাঠির আটা নিয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকেন বৃহত্তর সিলেটের হাটে-মাঠে-নগর-গঞ্জে-বনজঙ্গলে। এরকম বেশ কয়েক বছর অতিবাহিত হওয়ার পর হযরত কনাই শাহ্ (রহ.) জালালপুর ইউনিয়নের বাদেশপুর শারফিন শাহ (রহ.)-এর মাজার, নিজ গ্রামের কদমতলা তেতইর তল, দয়ামীর খাপন গ্রামের রমিজ উল্লাহর বাড়ি, কাশিকাপন বাজার, সোয়ার গাঁও গ্রামের কদর উল্লাহর বাড়ি, শাহবাজ উল্লাহর বাড়ি, মরম উল্লাহর বাড়িসহ বিভিন্ন স্থানে অস্থায়ীভাবে ঘুরাফেরা করতেন। এসময় তাঁর নানা কেরামতি মানুষের নজরে আসে। সর্বশেষ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রায় ১যুগ আগে তিনি দয়ামীর আজর উল্লাহর বাড়িতে আস্তানা করেন এবং ওফাত পর্যন্ত এখানেই থাকেন। সে সময় হযরত কনাই শাহ্ (রহ.)-এর কাছে প্রতিনিয়ত বিপুল সংখ্যক নারী-পুরুষ যাতায়াত করতেন- তাগা, তেল, পানি পড়ানোর জন্য। এমনকি যেকোন ছোট-বড় সমস্যা হলেই সমাধনের জন্য তাঁর নিকট ছুটে আসতেন এবং উপকারও পেতেন। এসময় মানুষ তাঁর সাথে থাকতেও শুরু করেন।

প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে হযরত কনাই শাহ্ (রহ.)-এর আধ্যাত্মিক ঘটনাবলী: হযরত কনাই শাহ্ (রহ.) বা তাঁর কারামত সম্পর্কে অসংখ্য ঘটনাবলী জনশ্রূতি রয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্য থেকে ওসমানীনগরের দয়ামীর নিবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধা সানাওর আহমদ বলেন, আমার জীবনে কনাই শাহ্ মামুর মত অলি দেখিনি। তিনি মরা ছাগল জিন্দা করাসহ অনেক কারামতি দেখিয়েছেন। তিনি আমার মায়ের গ্রামের লোক ছিলেন। আমার মা ছোটকালে কনাই মামুর সাথে মক্তবে পড়েছেন। জীবনের শেষভাগের প্রায় এক যুগ মামু আমাদের দয়ামীর এলাকায় ছিলেন। আমি কখনো কনাই শাহ্ মামুকে গোসল করতে, প্রস্রাব-পায়খানা করতে দেখিনি বা কেউ দেখেছেন বলে শুনিনি। তবে, তাঁর চেহারায় যেন আলোর ঝলমল করতো। মৃত্যুকালে আমিসহ উপস্থিত অনেকেই ছিলাম। আমরা মামুর মুখে কলিমা পাঠ করতে শুনেছি। ইন্তেকালের পর এলাকায় মৃদু ভূমিকম্প হয়েছে।

দক্ষিণ সুরমা উপজেলার নিজ সিলাম নিবাসী হাজী তফজ্জুল আলী বলেন, জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পীর ছিলেন বাবা হযরত কনাই শাহ্ (রহ.)। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তিনবার পাকিস্তানীরা বাবাকে গুলি করেছে। তবে কোন ক্ষতি হয়নি বরং তারা ধ্বংস হয়েছে। আমরা বাবার সাথে থাকতাম। তাঁর অনেক কেরামতি রয়েছে। এসব বলা নিষেধ আছে। এক কথায় তিনি জগতের অন্যতম বিখ্যাত অলি ছিলেন।

ওসমানীনগরের দয়ামীর নিবাসী মজম্মিল আলী মজই বলেন, আল্লাহর অলি হযরত কনাই শাহ্ (রহ.) কেরামতি সম্পর্কে আমাদের অনেক জানা আছে। নিজ চোখে দেখেছি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একদিন আমাদের বাড়ীর সামনে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে দিয়ে হযরত কনাই শাহ্ (রহ.) হেঁটে যাচ্ছেন।   হঠাৎ পাঞ্জাবীর (পাক বাহিনী) গাড়ী থামলে কনাই শাহ্ (রহ.)-এর সাথে থাকা লোকজর যারযার মতো দৌঁড়ে পালালো। আর পাঞ্জাবীর এক লোক পিছন থেকে কনাই শাহ্ পীর সাবকে কোমরে শক্ত করে ধরলো। তখন কনাই শাহ্ বললেন “সত মারাউ নির পুয়া, আমার বাদুর কইরে”। তৎক্ষণাৎ হাত ছেড়ে পাকবাহিনীর এ সেনা জোড়হাতে বলে উঠলো ফকির বাবা মুজে মাফ কর দে না।

তিনি আরো জানান, একদা রাণীগঞ্জের এক ভক্ত লোক লণ্ডন যাওয়ার পথে হযরত কনাই শাহ্ (রহ.)-এর কাছে দোয়া চাইতে আসলে তিনি তার পাসপোর্ট নিয়ে নিজের কাছে রেখে দেন। এদিকে বিমানের ফ্লাইট হারানোর ভয়ে অনেক অনুনয়-বিনয় করেও কিছুতেই কনাই শাহ্ ঐ পাসপোর্ট দিতে রাজি হননি। এমনকি আমরা এলাকাবাসীও ঐ লোকের জন্য অনুরোধ করে কিছুতেই পাসপোর্ট উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। সারাদিন পর সন্ধ্যায় কনাই শাহ্ উক্ত লোকটির পাসপোর্ট স্বেচ্ছায় হাতে তুলে দেন। কিছু সময় পর দয়ামীর বাজারে খবর আসে যে, বিমান দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ওই বিমানের সব যাত্রী নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে স্থানীয় ব্রাম্মণশাসন গ্রামের একজন লোকও রয়েছেন।

ইছামতি নোয়াগাও গ্রামের আব্দুর রব বলেন, আমি পড়াশুনায় ভালো ছিলাম না। একদিন আমার মা বললেন এ বেটা তুই কনাই শাহ্ মামুর কাছে যা, একটি সালাম দিয়া আয়, পরীক্ষায় ভালো হবে। কিন্তু আমার সাহস হয়না ভয় লাগে। বারবার মায়ের অনুরোধে ২/৩ দিন পর বাদশা কনাই শাহ্ (রহ.)এর কাছে আসলে সালাম দেওয়ার সাথে সাথে বললেন, এটা তো তোর মার কথায় সালাম।

তিনি আরো জানান, একদা দয়ামীর মাদ্রাসার ওয়াজে বরুণার হুজুর হযরত লুৎফুর রহমান বর্ণভী (রহ.) আসলে আমি গিয়া হুজুরকে সালাম দিয়ে দাঁড়াই।

মনেমনে হুজুরের প্রতি একটু ভাব আসলে তিনি বললেন যাও বেটা যেখানে আছো সেখানেই থাকো। এরপর থেকেই বাদশা কনাই শাহ্ বাবার কাছে নিয়মিত আসতাম, এখনো মাজারে আসছি। আজীবন আসবো ইনশাআল্লাহ্।

ইছামতি  নিবাসী ছমরু মিয়া বলেন, সর্বদা আমার মাথায় ব্যথা করতো, কোন কোন সময় যন্ত্রনায় বেহুশ হয়ে যেতাম। একদিন কনাইশাহ্ মামুর কাছে গিয়ে বললে “মামু আমার মাথায় তাপ্পড় মেরে বললেন যা” এরপর আজ পর্যন্ত  আমার মাথায় আর কোন ধরনের ব্যথা নাই।

শিওরখাল নিবাসী কনাইশাহ (রহ.)-এর ভাতিজা শাহ আব্দুল জব্বার জানান, একদিন একান্ত আলাপকালে নিজ বাড়িতে আসার কথা জানতে চাইলে – কনাই শাহ্ (রহ.) বলেন, জঙ্গলের পাখিরাও ঘুরে ফিরে বাসায় যেতে চায়রে বাবা, কিন্তু মুনিবের হুকুম ছাড়া বলে দীর্ঘশ্বাস নেন। কিছুক্ষণ পর আরেকটি প্রশ্নের উত্তরে বলেন, লোভ করো না এসব সাপের লাল। আমার কেউ অনাহারে মরবে না। সারা দুনিয়া ক্ষেত করে যাচ্ছি।

কনাই শাহ্ (রহ.)কে নিয়ে ভক্তবৃন্দের রচিত গান: হযরত কনাই শাহ্ (রহ.)কে নিয়ে ভক্তবৃন্দের রচিত অনেক গান রয়েছে। এরমধ্যে-

(ক)
মানি কনাইশাহ্ অলি
রোআ রইলায় ধান কাটিলায় নেরার দিলায় ডেরি ,
কত আইলা কত গেলা ডাকলা বাবা বলি
কেউ গেলা ঝুলনা বরি কেউ গেলা খালি ।।

হাঁস-মোরগ কত পচলো ঝুলনার মাঝে পড়ি
লাঠি চুলপি কান্দে লইয়া করইন গোরাগুরি ।।

বাশেঁর ছাত্তি কান্দে লইয়া গুরাইলা অলি
গোসল করলা না তেল মাখলায় না ভাত খাইলায় না অলি !!
পাগলও সুরুজ আলীয়ে বলে, দেখলাম কতঘুরি
খাজনার অলি আর পাইলাম না এ জগত জুড়ি ।।

(খ)
কনাই শাহরী প্রেম বাজারে ফুলছে রঙের ফুল-২
কত ভ্রমর আশিক হইয়া খাইলা মধুজল ।।

তিনি হইলা আল্লাহর অলি কতয় নিলা ঝুলনা ভরি-২
আমি পাপী রইলাম খালি করিয়াছি ভুল ।।

দয়ার ভান্ডারও অলি মায়ার সাগরও অলি-২
দয়া কর আল্লাহর অলি দিয়া চরন ধুল ।।

পাগলও সুরুজ আলী বলে, রাইখো তোমার চরন তলে
দয়া করো মায়ার অলি দিয়া যাও গো কুল ।।

(গ)
মামু শাহ কনাই শাহ্ তুমি মধু করো দান
তোমার বাগানে ফুলের ফুটিয়াছে ঘ্রাণ
মামু শাহ্ কনাই শা্‌ ।।

সিলেট জেলায় বসতবাড়ি বালাগঞ্জে থানা
পোষ্টঅফিস দেওয়ানবাজার গহরপুর পরগনা।।

কদমতলা ফকির বাড়ি জন্ম হয় তোমার
দয়ামীর বাজারে গিয়া বসাইলায় মাজার ।।

পীরাকিরও টাইটেল নিলায় রঘুপুর থাকিয়া
আয়াস শাহ্ ফকিরে ছেলা ফকির কনাইশাহ্ ।।

মায়ের হাতের ভিক্ষা লইয়া ঘরথাকি বারইলায়
আল্লার নাম লইয়া কনাই শাহ্ জঙ্গলবাসী হইলায়।।

৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে পাঞ্জাবী আসিয়া বুকের মধ্যে
চালায় গুলি মারিবার লাগিয়া।।

হাজার হাজার ভক্তবৃন্দ মাজারেতে যাইয়া
হাত উঠাইয়া করে দোয়া মুক্তিরও লাগিয়া ।।

ভক্ত হইয়া নেছাওর আলীয়ে গায় তোমার গান
দুরকর মোর মনের জ্বালা অতি পেরেশান ।।

ফকির কনাই শাহ্ (রহ.)-এর আহার-নিদ্রা: কনাই শাহ্ (রহ.)-এর আহার-নিদ্রা ছিল অতি সাধারণ। ভাত সরাসরি খেতেন না। ভক্তবৃন্দরা দূরদূরান্ত থেকে হরেক রকমের খাবার নিয়ে আসতেন। তিনি নিজে না খেয়ে মানুষদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। কখনো বিশেষ অনুরোধ রাখতে ভাতকে চিবিয়ে শুধু ভাতের রসটুকু খেতেন। বাকীটা বুয়াহ বলে ফেলে দিতেন। তাঁর চা পানের অভ্যাস ছিল। তিনি ঘুমাতেন অত্যন্ত কম। দিনে ঘুমাতে দেখা যেতো না। রাতে সামান্য ঘুমাতেন বা তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকতেন। ঘুমানোর সময় সাধারণত কাউকে কাছে থাকতে দিতেন না এবং ধারে কাছেও কাউকে ঘুমাতে দিতেন না।

কনাই শাহ্ (রহ.)-এর মাজারের ব্যবস্থাপনা ও আয়-ব্যয়: সরকারি ওয়াকফ প্রশাসনের অধীনে মাজার পরিচালনা কমিটি যাবতীয় কার্যাদি সম্পাদন করছেন দয়ামীর এলাকার লোকজন। মাজারের আয়ের প্রধান উৎস ভক্তবৃন্দের দান। শতশত দর্শনার্থী ও পথচারী গাড়ী থামিয়ে মাজারের সামনে মহাসড়কে রক্ষিত দান বাক্সে অর্থ দান করে থাকেন।

মাজারে দানকৃত অর্থ ব্যয় করা হয় –
১. মাজার ও মাজার মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ ও বিভিন্ন সেবামূলক কাজে;
২. গরীব ও দুঃখীদের আর্থিক সাহায্য;
৩. কন্যাদায়গ্রস্ত পরিবারকে সাহায্যে;
৪. রাস্তাঘাট উন্নয়ন;
৫. স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে।

মাজারের খেদমতের দায়িত্বে যাঁরা: হযরত কনাই শাহ্ (রহ.)-এর ওফাতের পর থেকেই কনাই শাহ্ (রহ.)-এর ভাই ও ভাতিজারা পালাক্রমে মাজারের খেদমতে রয়েছেন।

বর্তমানে মাজারের খাদেম যাঁরা: বর্তমানে মাজারের খাদিম হিসেবে রয়েছেন হযরত কনাই শাহ্-এর ভাতিজা শাহ্ আব্দুস ছত্তার, শাহ্ আব্দুস ছুবহান, নাতি (ভাতিজার ছেলে) – শাহ্ মো. জলাল, শাহ্ মো. হেলাল, শাহ্ মো. বিলাল, শাহ্ মো. দুলাল ও শা্হ্ মো. রুহেল।

ওফাত: ১৭ কার্তিক  ১৩৭৯ বাংলা, ৩ নভেম্বব ১৯৭২ সাল- শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৫টার দিকে কনাই শাহ্ (রহ.) মাবুদের সান্নিধ্যে ইহকাল ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল (আনুমানিক) ১শ বছর। তিনি ভাই-ভাতিজা, আত্মীয়স্বজনসহ অগণিত ভক্তবৃন্দ ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। দয়ামীর সদরুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে  তাঁর জানাযার নামাজে হাজার হাজার ভক্তকুলের ঢল নেমেছিল। জানাযার নামাযে ইমামতি করেন দয়ামীর নিবাসী হযরত মাওলানা বুরহান উদ্দিন কনাই মিয়া।

এসএম হেলাল (শাহ্ মো. হেলাল): সাংবাদিক এবং কনাই শাহ্ (রহ.)-এর বংশধর।

 

 

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!