পৃথিবীতে বহু ভাষা আছে যাদের লিখিত রূপ নাই। এরকম একটি ভাষা কুরুখ। আদি ও অনক্ষর কুরুখ ভাষা দ্রাবিড় ভাষা বংশের অন্তর্গত। যে জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বংশ পরম্পরায় মুখে মুখে কুরুখ ভাষা বহন করে চলেছে তাদের নাম ওরাওঁ। বাংলাদেশে ওরাওঁ জাতিগোষ্ঠীর মানুষ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে অভিবাসিত হয়েছে। আদিবাসী ওরাওঁ বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে ব্রিটিশ আমলে চা বাগান প্রতিষ্ঠার সময় থেকে বসবাস করছে। সিলেটে ওরাওঁ জনগোষ্ঠী উরাং হিসেবে পরিচিত। এমনকি তারা তাদের নামের শেষে উরাং লিখে থাকে। তারা নিজেদেরকে উরাং হিসেবেই পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। বিভিন্ন কারণে আদিবাসী উরাংদের মাতৃভাষা কুরুখ এখন বিপন্ন। এরকম একটি বিপন্ন ভাষার মাঠপর্যায়ের বাস্তবচিত্র পর্যবেক্ষণ করে জীবন্ত শব্দসম্পদ সংগ্রহ করে সংকলন ও ভাষাতাত্ত্বিক আলোচনা সহ ‘উরাং জনগোষ্ঠীর কুরুখ ভাষা পরিচয় ও অভিধান’ প্রণয়ন করেছেন দীপংকর শীল। বইটি ‘উপজেলা শিল্পকলা একাডেমি, কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার’ থেকে প্রকাশ করেছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার সিফাত উদ্দিন। প্রাককথনে তিনি বলেছেন, “ক্রম ম্রিয়মাণ নৃগোষ্ঠীর ভাষাকে দেদীপ্যমান রাখতে এই উদ্যোগ একটি পাথেয় হবে বলে আশা করি।”
বইটির ভূমিকা লিখেছেন বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী, জনসংযোগ বিশেষজ্ঞ ও থিংক ট্যাঙ্ক ব্যক্তিত্ব ড. সেলু বাসিত। তিনি বলেছেন, “কবিগুররু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘জীবন ও বর্ণমালা’ প্রবন্ধে বাংলা বর্ণ বিন্যাস আর বর্ণমালার অত্যন্ত গভীর তাৎপর্য প্রকাশ করার প্রয়াস করেছেন; তা সকল ভাষার বর্ণ তাৎপর্যকে বস্তুুনিষ্ঠ সত্তা (objective entity)- এর অস্তিত্ব (being) জ্ঞাপক। কুরুখ ভাষার সেই অস্তিত্ব জ্ঞাপকতাকে, সেই ভাষিক সম্প্রদায়ের ভাষিক সংশ্রয় (Language System)-কে মৌলিক সন্ধিৎসার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ধ্বনিছক (Sound Pattern)-কে শব্দ ও বাক্যের মৌখিক ভাষারূপ লেখ্যরূপে বর্ণায়নের এ-পরিচয় এবং বোধযোগ্যতা সৃষ্টি করে দীপংকর শীল- এর এই প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে উদ্ভাবন তুল্য।”
এ গ্রন্থে প্রসঙ্গক্রমে প্রাবন্ধিক ও মননশীল গবেষক আহমদ সিরাজ বলেছেন, “কুরুখ ভাষা সম্পর্কিত বইটির প্রণেতা হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে শ্রম-ঘাম ব্যয় করেন প্রভাষক দীপংকর শীল। কমলগঞ্জের সন্তান হিসেবেও এই জনগোষ্ঠীর কাছাকাছি অবস্থানের গভীর অভিনিবেশ ও মনোনিবেশ সহকারে সমৃদ্ধ তথ্য সন্নিবেশন করে বইটি লিপিবদ্ধ করেন। একজন অনুসন্ধানী গবেষকের দৃষ্টিতে কাজটি করেছেন বলে মনে হয়েছে। বিশ্বাস করি এ গ্রন্থটি ভাষা সাহিত্য ও গবেষণার ক্ষেত্রে এক অপূর্ব সংযোজন।”
প্রয়োজন মানুষকে কথা বলায়। কথা উৎপাদনের কারখানা মানুষের মনোজগৎ। মনের ইচ্ছাতেই বস্তু নতুন অর্থ পায়, মনের ইচ্ছাতেই শব্দ তার অর্থ বদল করে। মানুষ সেটা গ্রহণ করে- ফলে ভাষা গতি পায়। মনের এই গতিপ্রকৃতি লক্ষ্য করে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন,-
“আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ,
চুনি উঠল রাঙা হয়ে।
আমি চোখ মেললুম আকাশে,
জ্বলে উঠল আলো
পুবে পশ্চিমে।
গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম “সুন্দর’,
সুন্দর হল সে।”
মন বা চেতনাই ভাষাকে গতি দান করে। ভাষার গতি কখনো এলোমেলো নয়, একটা শৃঙ্খলায় চলে। পর্যবেক্ষণে সেই শৃঙ্খলা ধরা পড়ে। গভীর পর্যবেক্ষণে দীপংকর শীল অলিখিত কুরুখভাষার সেই শৃঙ্খলাটিকে সূত্রবদ্ধ করে এর ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব ও বাক্যতত্ত্বকে আলোচনা করেছেন। গ্রন্থের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর প্রাঞ্জলতা। প্রমিত বাংলায় কুরুখ ভাষার কুটিনাটি বিষয় এত সহজ ও সুন্দর আলোচনা করেছেন যে, কুরুখ ভাষাভাষী তো বটেই যে কোনো ভাষার পাঠকের পক্ষেই তা সুখপাঠ্য। যে এলাকা থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন সেখানকার ভৌগোলিক পরিচয় সহ উরাংদের মূল আবাসভূমি, সিলেটে উরাংদের অভিবাসন ও বর্তমান পরিস্থিতি, বাংলাদেশে জেলাভিত্তিক উরাংদের পরিবার ও লোকসংখ্যা, কমলগঞ্জ উপজেলায় উরাং জাতির জনতাত্ত্বিক বণ্টন, ভাষা, শিক্ষা, আর্থিক পরিস্থিতি, উরাং জাতিসত্তার পরিচয়, দ্রাবিড় ভাষা পরিবার পরিচিতি, দ্রাবিড় ভাষাগুলোর সাধারণ লক্ষণ, কুরুখ ভাষার ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি বিষয়ের সাবলীল ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন।
কীভাবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে এবং কীভাবে কুরুখ ভাষা বিবর্তিত হচ্ছে সে সম্পর্কেও গ্রন্থে আলোকপাত করেছেন। অভিধানের ভুক্তি কুরুখ শব্দসংখ্যা প্রায় দুই হাজার। ভুক্তি শব্দের ব্যাকরণিক শ্রেণি নির্ণয় সহ প্রথম বন্ধনীর ভেতর কুরুখ শব্দের বাংলা অর্থ দিয়েছেন। সেই সাথে শব্দটিকে কুরুখ ও বাংলা বাক্যে প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন। অভিধানের অবলম্বন হিসেবে গ্রন্থকার বলেছেন, “প্রতিটি শব্দই সরাসরি সাক্ষাৎকারে গৃহীত এবং শব্দগুলোর বানান যথাসম্ভব উচ্চারণের কাছাকাছি রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। বয়স, শিক্ষা, পেশা, সামাজিক অবস্থান, লিঙ্গ ইত্যাদি কারণে কোনো কোনো শব্দের একাধিক উচ্চারণ লক্ষ্য করা গেছে। এ ধরনের শব্দের সঠিক উচ্চারণ গ্রহণের জন্য কলেজ পড়ুয়াদের সর্বোচ্চ সংখ্যক উচ্চারণকারীর উচ্চারণ থেকে যাচাই-বাছাই করে প্রমিত উচ্চারণ গ্রহণ করা হয়েছে। নারী-পুরুষের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত শব্দগুলো যথাস্থানে যাচাই-বাছাই করে গ্রহণ করা হয়েছে।”
নানাবিধ কারণে উরাং জনগোষ্ঠীর প্রায় দুই তৃতীয়াংশ মানুষ তাদের মাতৃভাষা কুরুখ ভুলে গেছেন। এমনকি নতুন প্রজন্মের অনেকে কুরুখ নামে যে তাদের মাতৃভাষা ছিল তা জানেই না। এ প্রসঙ্গে আমরা ভাষাবিজ্ঞানী ড. সেলু বাসিত এর সুরে সুর মিলিয়ে বলতে পারি, এই গ্রন্থটি প্রণয়নের মাধ্যমে দীপংকর শীল সাংস্কৃতিক দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। এতে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও ভাষিক পরিসরে ব্যবহারিক উপাদানে ঋদ্ধ হবে- বাংলাদেশের ভাষিক বাস্তবতায় শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সামাজিকীকরণেও সহায়ক হবে নিঃসন্দেহে। আশা করা যায়, এ গ্রন্থটি উরাং জাতিসত্তার ভাষিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ১৮৪ পৃষ্ঠার সুখপাঠ্য এই গ্রন্থের নান্দনিক প্রচ্ছদ, উন্নত কাগজ, মজবুত বাঁধাই, চমৎকার মুদ্রণসৌকর্যে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। আমরা এই গ্রন্থের বহুল প্রচার কামনা করি।
উরাং জনগোষ্ঠীর কুরুখ ভাষা পরিচয় ও অভিধান
লেখক: দীপংকর শীল
প্রকাশক: উপজেলা শিল্পকলা একাডেমি, কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার।
প্রচ্ছদ: অবিনাশ আচার্য
প্রকাশকাল: নভেম্বর ২০২২।
মূল্য ৩৫০ টাকা।