সৌন্দর্য পিপাসা মানুষকে নতুন নতুন সৃষ্টির দিকে আহ্বান করে নিয়ে যায়। সেই সুন্দর হতে হবে সত্যের নির্যাসে পূর্ণ, পূণ্যের গঙ্গা বারিতে বিধৌত, হৃদয়াকাশে তার প্রকাশ হতে হবে উদীয়মান প্রভাত সূর্যের সহস্র কিরণরাজির মতো। এই সুন্দরের চেতনাবোধে যার অন্তর জাগ্রত হয়- সে সৃষ্টির উল্লাসে উল্লসিত হয়। জীবনকে ধন্য করে অন্তরতর মহাসত্যের দিকে ধাবিত হয় মহামিলনের দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে। অমৃতের অর্ণবে স্নাত হয়ে তার জীবন ধন্য হয়ে যায়। জন কীটস এমনি একজন ক্ষণজন্মা কিন্তু স্বল্পজীবী প্রথিতযশা কবি- যাঁর নাম কালান্তরের মানুষের হৃদয়ের পাতায় লিখা হয়ে রইল জলধারা দিয়ে। চিরসজীব কবি তিনি। দেশ কালের সীমানা পেরিয়ে কীটস আজ বিশ্ব মানবের কবি। সকল সমাজে সাহিত্যানুরাগী সকল মানুষের কাছে কীটস এক অবিস্মরণীয় নাম। সেক্সপীয়ারের পরেই তিনি ইংরেজি সাহিত্যের কীর্তিমান কবিবৃন্দের মধ্যে মানব হৃদয়ের নিকটতম প্রতিবেশী।
কীটস -এর পুরো নাম John Keats। জন্মেছিলেন ৩১ অক্টোবর, ১৭৯৫ খ্রি. লণ্ডন শহরে এবং মৃত্যুবরণ করেন মাত্র ২৬ বছর বয়সে ইতালির রোম নগরিতে ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৮২১ খ্রি.। স্বল্প সময়ের সংক্ষিপ্ত জীবনে তিনি এমন সব কবিতা রচনা করেন যা তাঁকে চিরঞ্জীব করে রেখেছে সাহিত্য রস পিপাসু মানুষের কাছে। রোমান্টিক যুগের কনিষ্ঠ কবি তিনি কিন্তু ধরাপৃষ্ঠ ত্যাগ করেন অন্য সকলের পূর্বে। স্বপ্নের মতোই তাঁর জীবন এবং এক স্বপ্নময় সন্ধ্যায় অস্তগামী সূর্যের ক্রমবিলীয়মান করুণ কিরণমালার মতোই তাঁর জীবনাবসান। Shakespeare -এর মতোই বেদনার মুহ্যমানতায় বলতে হয়-
. . . We are made of such stuff
As dreams are made an . . .
ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও শেলির মতোই তাঁর কবিতায় প্রকৃতিই ভাস্বর হয়ে উঠেছে তার সুরভিত সৌন্দর্যের পত্র পুষ্পের সম্ভার নিয়ে। সৌন্দর্যের চির উপাসক কবি তিনি। চিরসুন্দরের বাণী বন্দনা রচনা করতে গিয়ে তিনি গেয়ে উঠেন-
Truth is beauty, beauty truth
A thing of beauty is joy forever.
তাঁর সকল কবিতার মধ্যেই সত্য সুন্দরের প্রতি তাঁর অন্তরের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদিত হয়েছে আর সেজন্যই তাঁকে Worshipper of beauty বা সৌন্দর্যের উপাসক কবি বলা হয়। বিশ্ব প্রকৃতি তাঁর কাছে সৌন্দর্যের ডালা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে এবং প্রকৃতির বিভিন্ন সুন্দর জিনিসের উপস্থাপনা করতে গিয়ে তিনি সেগুলোর মধ্যে গ্রিক পৌরাণিক দেব-দেবীর উপস্থিতি দর্শন করেছেন। অনেক সাহিত্য রসজ্ঞ ব্যক্তি তাঁকে মননশীলতায় গ্রিক বলে আখ্যায়িত করেছেন।
স্বল্প পরিসর জীবনে Keats অনেক সুন্দর সুন্দর সৃষ্টি রচনা করে গেছেন। তাঁর সাহিত্য প্রতিভা যেখানে সর্বাধিক পরিস্ফূট হয়েছে সেটা তাঁর Great Odes বা শ্রেষ্ঠ প্রশস্তিমূলক গীতি কবিতা। তাঁর Great Odes গুলোর মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় হচ্ছে ‘Ode to a Nightingale’, ‘Ode on a Grecian Urn’ এবং ‘Ode to Autumn’|
বুলবুল পাখির গানকে অবলম্বন করে Keats যে বাণী প্রশস্তি রচনা করলেন ইংরেজি সাহিত্যে তা অতুলনীয় হয়ে রইল। বিশ্ব সাহিত্যে ‘Ode to a Nightingale’, ‘Ode on a Grecian Urn’ এবং ‘Ode to Autumn’ Keats -এর সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান। ভাবের গভীরতা, প্রকাশের স্বতঃস্ফূর্ততা, কল্পনার আকাশ ছোঁয়া বিস্তার, স্বপ্নের মায়াজাল এবং অনিবার্য মৃত্যুর আগমনী পদধ্বনি Keats -এর কবিতাগুলোকে মহাকাব্যিক গভীরতা দান করেছে। বিশ্ব সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিতাগুলোর মধ্যে ‘Ode to a Nightingale’, ‘Ode on a Grecian Urn’ চিরসমুজ্জ্বল হয়ে থাকবে। মনোহারী চিত্রধর্মিতাগুণে কবিতাগুলো আমাদের মনের আকাশে জ্বল জ্বল করে ভাসতে থাকে।
মাত্র কিছু দিনের মধ্যেই Keats প্রথমেই হারিয়েছেন তাঁর পিতাকে ১৮১০ খ্রিস্টাব্দে। Tuberculosis বা যক্ষাই ছিল তার কারণ। তারপর তার স্নেহময়ী সেই নিষ্ঠুর রোগে আক্রান্ত হলেন। তখনকার দিনে যক্ষা রোগের কোনো ঔষধ আবিষ্কৃত হয়নি। Keats ছিলেন অত্যন্ত মাতৃভক্ত। Keats মনপ্রাণ ঢেলে মায়ের যত্ন করলেন। কিন্তু মৃত্যুকে আটকাতে পারলেন না। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন তিনি। মাতৃবিয়োগের বেদনা Keats -কে চরমভাবে বিপর্যস্ত করে দিল। ইতিমধ্যে তাঁর ছোট ভাইও সেই মরণঘাতী রোগে আক্রান্ত হলো। সুতরাং ভাই হারানোর আশঙ্কায় তিনি বেদনার্ত। কীটসের কাব্য সাধনা এগিয়ে চলেছে দ্রুত গতিতে। তাঁর রচনা একের পর এক প্রকাশিত হয়ে চলেছে। প্রকৃতিকে তিনি স্বরূপ সুষমায় সজ্জিত করে প্রকাশ করছেন তাঁর কাব্য প্রবাহের মধ্যে।
কীটসের তিনটি কাব্যের বই প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর জীবন কালেই কিন্তু কবিতাগুলো তাৎক্ষণিক জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারেনি। পারিবারিক আভিজাত্য কীটসের ছিল না। চিকিৎসাবিদ্যা তিনি অধ্যয়ন করেছিলেন কিন্তু চিকিৎসক তিনি হতে পারেননি। কাব্য সরস্বতীর আহ্বানে সাহিত্যের নন্দন-কাননে পুষ্প চয়নে ব্রতী হলেন তিনি। তাঁর আহরিত পুষ্পের গাঁথা মালা তাঁর জীবিতাবস্থায় ধূলা লুণ্ঠিত হলেও তাঁর মৃত্যুর অনতিকাল পরেই বাণী দেবীর কণ্ঠে মণিমালা হয়ে শোভা পেয়েছে।
ব্যক্তিগত জীবনে কীট্স মোটেও সুখী মানুষ ছিলেন না। সুন্দরী তরুণী Fanny Browne -এর প্রতি ছিল তাঁর গভীর প্রেম। কিন্তু চঞ্চল মানসিকতা সম্পন্ন Fanny Browne কীটসকে প্রেমের যথার্থ প্রতিদান দিতে পারেননি। সবকিছু জেনেও কীটস Fanny Browne -কে মোটেই ভুলতে পারেননি। সুতরাং তাঁর জীবন স্বাভাবিকভাবেই হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছিল। সমসাময়িক কয়েকটি পত্রিকা কীটসকে নির্মমভাবে আক্রমণ করেছিল। এতে তাঁর কবি মানস ভেঙে পড়েছিল এবং তাঁর মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করেছিল। রোমান্টিক যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি শেলি Keats -এর মৃত্যুতে Adonais শিরোনামে দীর্ঘ শোকগাথা রচনা করেন এবং এতে তিনি কীটসের অকাল মৃতুর জন্য এই পত্রিকাগুলোর নির্মম আক্রমণকে দায়ী করেন।
Keats নিজেও Tuberculosis রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁর জীবনের দিনগুলো দ্রুতই শেষ হয়ে আসছে। সেইজন্য তাঁর শেষের কবিতাগুলোর মধ্যে মৃত্যুর অশনি সংকেত বার বার ধ্বনিত হয়েছে। কবির সৌন্দর্য চেতনা তীব্র বেদনার রঙে সিক্ত হয়ে অপূর্ব বাণীরূপ পেয়েছে তাঁর প্রশস্তিমূলক কবিতাগুলোর মধ্যে। Ode to a Nightingale কবিতাটি শুরুই হয়েছে একটি গভীর বেদনার আবহের মধ্য দিয়ে। কবি বলেন-
My heart aches and a drowsy numbness pains
My sense, as though of hemlock I had drunk.
বেদনা বিমথিত কবি স্মরণ করছেন মৃত্যুলোকের সেই Lethe নদীর কথা। তিনি যেন ডুবে যাচ্ছেন সেই বৈতরণীর অগাধ সলিলে। কবি শুনে চলেছেন বুলবুল পাখির অমৃত নির্ঝরণী গান, যা তাঁর শ্রবণে প্রবেশ করে হৃদয় মন আকুল করে দিচ্ছে। কবির দেহ মন ক্লান্তি আর বিষাদে বিপন্ন কিন্তু সেই বিষাদের আভাস মাত্র বুলবুলের সুললিত কণ্ঠে নেই। হতাশায় নিমজ্জমান কবি কীটস বলছেন-
Here where men sit and hear each other groan
Where palsy shakes a few, sad, lost grey hairs,
Where youth grows pale spectre-thin and dies
And laden eyed despairs.
মৃত্যুময় এই জগৎ সংসার। এখানে বসে বসে কিংবা জীবনের পথ চলায় বেদনার দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হয়। এখানে রীপবতীর রূপের লাবণ্য এবং উজ্জ্বল স্নিগ্ধ নয়নের জ্যোতি দীর্ঘ সময় থাকে না। নব প্রেম পুরনো হয়ে যায় অতি দ্রুত, অবশেষে হারিয়ে যায়, পিছনে পড়ে থাকে স্মৃতির দীর্ঘশ্বাস। কীটস বলেন-
Where beauty cannot keep her lustrons eyes
Or new love pine at them beyond tomorrow.
এত যে হতাশা ভরা কবি জীবন, মৃত্যু যার জীবনের দিকে দ্রুত ধেয়ে আসছে, তিনি তাঁর স্বভাব সুলভ সৌন্দর্য প্রীতিকে বিসর্জন দিতে পারেননি। মরণ সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে চিরসুন্দরের জয়গান তিনি গেয়ে যাচ্ছেন। চিত্ররূপময়তায় ভরে তুলেছেন তিনি তাঁর প্রতিটি শ্রেষ্ঠ কবিতাকে। জ্যোৎস্নারাতের সৌন্দর্যকে কবি চিত্রায়িত করেছেন কী অপরূপ মহিমায়!
Tender is the night,
And haply the Queen-Moon is on her throne,
Clustered around by all her starry Fays.
Ode to Autumn একটি অনবদ্য এবং ত্রুটি বিচ্যুতিহীন সুন্দর কবিতা। Autumn ফসলের ঋতু। মাঠে মাঠে ফসলের সমারোহ। কৃষাণ-কৃষাণীর আঙিনা ভরে উঠে সোনালি ফসলের সম্ভারে। স্তবকের পর স্তবক এগিয়ে চলেছে আর চোখের সামনে ভেসে উঠে শরতের অসংখ্য বাণীচিত্র। কবি নৈর্ব্যক্তিক শরতকে ব্যক্তিরূপ আরোপ করেছেন। শরৎ যেন এক শস্য কুড়ানি কৃষাণ কন্যা। সে ফসল আহরণে ব্যস্ত। কীট্সের তুলিকায় তার কি অপরূপ বাণী চিত্র-
Who hath not seen thee oft amid thy store?
Sometimes whoever seeks abroad may find
Thee sitting careless on a grannary floor,
Thy hair soft-lifted by the winnowing wind.
এভাবে চিত্ররূপময়তা Ode to Autumn কবিতাটিকে অবিস্মরণীয় করে রেখেছে।
‘Ode on a Grecian Urn’ কবিতাটি ইংরেজি সাহিত্যের সর্বাধিক জনপ্রিয় কবিতাগুলোর মধ্যে অন্যতম। পার্থিব জীবনের ক্ষণস্থায়িত্বের প্রেক্ষিতে Art -এর চিরস্থায়িত্ব ও চির সমুজ্জ্বলতা কবিকে মন্ত্রমুগ্ধ করেছে। পার্থিব জীবনের হতাশা ও অগ্রসরমান মৃত্যুর পদধ্বনি কবিকে করে তুলেছে বেদনায় মুহ্যমান। কবি জেনেছেন এই পার্থিব জীবন শেষ হয়ে যাবে কিন্তু এই ক্ষণস্থায়িত্বের মাঝেও এই গ্রিক ভাস্কর্য ও চিত্রকলা অনাগত কালের দিকে বিজয়কেতন উড়িয়ে ধাবমান হবে। ভাস্কর্যের গায়ে অঙ্কিত একটি চিত্র বিশেষভাবে কবির দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। তা হচ্ছে সবুজ শাখার নীচে একজন লোক বাঁশি বাজাচ্ছে। তার বাঁশির সুর চিত্রের মাঝে নীরব হয়ে আছে কিন্তু কবি অন্তঃকর্ণে সেই বাঁশির সুর লালিত্য শ্রবণ করছেন। তাঁর কাছে মনে হচ্ছে শ্রুত সঙ্গীতের চেয়ে সেই অশ্রুত সঙ্গীত অনেক বেশি মধুর – অনেক বেশি হৃদয়গ্রাহী। কীটস বলেন-
Heard melodies are sweet, but those unheard
Are sweeter, therefore, ye soft pipes, play on;
Not to the sensual ear, but more endear’d
Pipe to the spirit dities of no tone.
অনুরূপ উপলব্ধি আমরা ররীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের মধ্যেও পেয়ে থাকি-
যে গান কানে যায় না শোনা সে গান যেথায় নিত্য বাজে
প্রাণের বীণা নিয়ে যাব সেই অতলের সভা-মাঝে।
কীটস স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য ইতালি চলে গিয়েছিলেন। সেখানে অন্য দুই রোমান্টিক কবি শেলি ও বায়রনের সঙ্গে কীটসের সাক্ষাৎ হয়। কীটসের স্বাস্থ্যের হঠাৎ অবনতি ঘটল। ১৮২১ খ্রিস্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারি রোম নগরির সৌরকরোজ্জ্বল আকাশে সহসা অমানিশার অন্ধকার নেমে আসে। শেলির কোলে মাথা রেখেই কীটস অনন্তের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালেন মাত্র ২৬ বছর বয়সে। ইংরেজি সাহিত্যের এক অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন হলো। রোমের Protestant Cemetery -তে কীটস চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। তাঁর সমাধি লিপিতে তাঁরই অন্তিম বাণী-
Here lies one
Whose name was writ in water
কীটস চলে গেছেন। সেই রোমান্টিক কাব্যের স্বর্ণযুগও হারিয়ে গেছে সুদূর অতীতের তমসায়। কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া আলোর জ্যোতি আমাদের হৃদয়ের আকাশকে আলোকোজ্জ্বল করে তোলে। ভারতীয় জীবন দর্শনের চিরন্তন বাণী ‘সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম্’ – যা সত্য তাই কল্যাণময় এবং তাই সুন্দর। কীটস -এর কাব্যে সেই চিরসুন্দরের বাণী অপরূপভাবে প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বমানবের উদ্দেশ্যে কীটস -এর বাণী-
Beauty is truth, truth beauty-that is all
ye know on earth, and all ye need to know.
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, কমলগঞ্জ সরকারি গণমহাবিদ্যালয়, কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার।