শুক্রবার, ১ নভেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৭ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

স্মরণ

ইদানিং খুব মনে পড়ে রুথের কথা।। শাহনাজ সুলতানা



ইদানিং রুথের কথা খুব বেশি মনে পড়ে। প্রায় চব্বিশ বছর আগে আমি যখন ইষ্টহ্যামের মার্কেট ষ্ট্রীটের একটি ফ্ল্যাটে উঠি তখন রুথ ছিলেন সেই ফ্লাটের চারতলার বাসিন্দা। রুথের সাথে প্রথম দেখা হয়েছিলো আমি নতুন ফ্ল্যাটে উঠার পরদিন সকালে দরজার সামনে। সে সময় রুথ বলেছিলেন’ নাইস টু মিট ইউ ইয়াং লেডি, ইফ ইউ নিড এ্যানি হেলপ জাষ্ট কল মি, আই লিভ ইন অন ফোর্থ ফ্লোর। সদা হাস্যময়ী বাদামী চুলের রুথকে সে দিন বেশ ভালো মনের একজন মানুষ মনে হয়েছিলো।

রুথের ডায়বেটিস ছিল। ডায়বেটিস উঠা-নামা করলে কেঁপে কেঁপে পড়ে যেতেন যে কোন জায়গায়। মনে পড়ে একবার রুথ আমাদের ফ্ল্যাটের সামনে রাস্তার পাশের গেইটে পড়ে গিয়ে খুব আঘাত পেয়েছিলেন পায়ে। তৃতীয় তলার বাসিন্দা মিলি এবং আমি এ্যাম্বুলেন্স ডেকে উনাকে হাসপাতালে পাঠিয়েছিলাম। হাসপাতালে দু’দিন থাকার পর রুথ বাসায় ফিরে অতি বিনয়ের সাথে ধন্যবাদ দিতে এসেছিলেন আমার দরজায়। হালকা পাতলা গড়নের ষাট উর্ধ্বয়সী রুথ তার দু-বেড রুমের ফ্লাটে একা-ই থাকতেন। যদিও বিভিন্ন সময়ে রুথের সাথে নানা বিষয়ে কথাবার্তা হয়েছে তবে কোনদিন উনার ব্যক্তিজীবন নিয়ে প্রশ্ন করিনি। কারো ব্যক্তিজীবন নিয়ে আগ্রহ দেখানো আমার অপছন্দ এবং সমচীন মনে করি না। তবে তৃতীয় তলার বাসিন্দা জসের মা একবার বলেছিলেন রুথ চিরকুমারী, জীবনে বিয়ে করেননি।

রুথ দিনের বেলা কাজ করতন সামার ফিল্ডে এবং প্রতিদিন সন্ধ্যায় একটি খবরের কাগজ হাতে বাড়ি ফিরতেন। উইকেন্ডে রাতে মাঝেমধ্যে পাবে যেতেন। প্রায় ১১ বছর ছিলাম একই ব্লকে কোনদিন রুথের কোন আত্বীয়-স্বজন বা বন্ধু বান্ধবকে তার বাসায় আসতে দেখিনি।

আমাদের ফ্ল্যাটের দ্বিতীয় তলার বাসিন্দা ছিলেন হেলেন এবং মিশেইল। সম্পর্কে মা-মেয়ে তারা এক সাথে থাকতেন। মা হেলেন একটু বয়স্ক আর মেয়ে মিশেইল মানসিক রোগী প্রায় সময় মায়ের সাথে ঝগড়া করতো, আবার কিছুক্ষণ পর পর জোরে হাসতো। ২০১১ সালের নভেম্বরের কোন এক রোববার সকাল আটটার দিকে শুনতে পেলাম আমার দরজার সামনে হেলেন এবং জসের মা কথা বলছেন। আমি আর বাবরা পাশাপাশি গ্রাউন্ড ফ্লোরে থাকি। দরজার সামনে তাদের কথাবার্তা শুনে আমি বের হলাম। বাবরা বলল ফ্ল্যাটে এতো পুলিশ কেন? হেলেন ও মিশেইল বলল, উই ডোন্ট নো’। আমরা উপরের দিকে বার বার তাকাচ্ছিলাম আর রুথের কথা বলাবলি করছিলাম। ঐ সময় মিশেইল বলছিল সে দু’দিন আগে সন্ধ্যায় রুথকে অসুস্থ দেখেছে , রুথের হাত থেকে রক্ত বেরুচ্ছিল। মনে হয় কোথাও পড়ে গিয়েছিল, যার কারণে এ রক্তক্ষরণ। বাবরার দরজার সামনে এবং উপরে উঠার সিঁড়িতে সামান্য দু এক ফোঁটা রক্তের দাগও দেখিয়ে বলছিল,এই রক্ত রুথের হাত থেকে পড়েছে। রুথ উপরে যেতে পারছিল না। ওকে আমরা উপরে উঠার জন্য সাহায্য করেছিলাম। এরপর রুথকে দেখিনি। হেলেন আমাকে উদ্দেশ্যে করে বলল, আমরা তোমার দরজায় নক করেছিলাম, তুমি বাসায় ছিলে না। আমরা তখনও জানতাম না যে রুথ বেঁচে নেই। শুধু দেখছিলাম পুলিশ উপরে উঠানামা করছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ঝসের মা উপর থেকে নীচে এসে বলল রুথ নেই, মারা গেছে। আমরা সবাই নীরব হয়ে গেলাম। মনে হল একখন্ড কালো মেঘ এসে নিমিষেই ঢেকে দিল আমাদের আকাশ। আমরা বাকরুদ্ধ ক’জন মানুষ কেবলই অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।

ডাক্তারের ভাষ্যমতে রুথ মারা গেয়েছিলেন দুদিন আগে বাসায়। উনার নিথর দেহটি পড়ে ছিলো ঘরের প্যাচিজে দরজা ছিলো সামান্য খোলা। ডাক্তার দরজাটা একটু ধাক্কা দেয়ার সাথে সাথে দেখতে পান তার নিথর দেহটি। মুহুর্তের মদ্যে ডাক্তার জেনে গেলেণ রুথ বেঁচে নেই। পুলিশ ডাকা হলো, সারাদির চারজন পুলিশ ছিলো ফ্ল্যাটে। রাতে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। হায়রে নিয়তি! কার ভাগ্যে কি ভাবে মৃত্যু লেখা কেউ জানে না।

রুথ মারা যাবার আগে উনার সাথে খুব কম-ই দেখা হয়েছে। ব্যস্ততা প্রচণ্ড বেড়েছিলো আমার। ঠিকমতো সবার সাথে যোগাযোগ রক্ষা পারতাম না । তবে মনে পড়ে রুথ মারা যাবার আগের ক্রিসমাস ২০১০, রুথ কার্ড ও চকলেট নিয়ে এয়েছিলো আমার ফ্ল্যাটে। বলেছিলো হ্যালো, ‘হাউ আর ইউ? ওয়ার হেভ ইউ বিন, লং টাইম নো সি’ বলে জড়িয়ে ধরেছিল। সে দিন রুথ বেশিক্ষণ বসেননি, চা বা কফি কোন কিছু পান না করেই চলে গিয়েছিলেন মার্কেটে কেনাকাটার জন্য। এরপর আবার রুথের সাথে দেখা হয়েছিল কয়েক সপ্তাহ পড়ে। উনি লেটরা বক্স থেকে চিঠি বের করে ওপরের দিকে যাচ্ছিলেন আর আমি বাইরে যাবার জন্য বের হচ্ছিলাম। সেদিনও তেমন কথা হয়নি আমাদের মধ্যে।

পৃথিবী ছেড়ে সবাই চলে যায়। নাম ধরে যার ডাক আসে সেই একা যাত্রী হয় পরপারের বাহনে, পেছনে ফেলে যায় পরিচিত স্বজন, প্রিয় মানুষ, বন্ধু-বান্ধবসহ কতো কতো স্মৃতি। হায়রে মানুষ! সময়ের সাথে থেমে যায় তোমার জীবনের ঘড়ি। নতুন সাজে সজ্জিত হও, চার বাহকের পালকি চড়ে চলে যাও আপন নিবাসে .. প্রিয়জনের হৃদয় কাঁদে বিরহে তোমার.. তারপর অল্প অল্প করে মুছে যাও তুমি, কেউ মনে রাখে না তোমার নাম।

আসলে মানুষ বড় একা। কবি আবুল হাসানের কবিতার সাথে আমিও আজ সুর মিলিয়ে বলছি ’অবশেষে জেনেছি মানুষ চিরকাল একা, চিরকাল তার চিবুকের কাছে ভীষণ অচেনা ও একা।’

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!