পৃথিবী যখন বিভিন্ন সমস্যায় টালমাটাল। যুদ্ধ-বিগ্রহে যখন নাকাল আস্ত দুনিয়া। অর্থনৈতিক অবনতিতে সংকটে যখন উন্নত-বিশ্ব। আর অনুন্নত বিশ্ব যখন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নাকানি-চোবানি খাচ্ছে। কোভিড-১৯ এর মহামারীর পর অপরাপর কোভিডও যখন পৃথিবীর পিছু ছাড়ছে না তখন সৃষ্টিকর্তার অদৃশ্য পায়ে পড়া ছাড়া কি আর কোন গত্যন্তর আছে।
বিশ্ব, রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার আর ব্যক্তি সবই যখন আজ কোন না কোন ভাবে নাজেহাল। বিশেষ করে মুসলিম বিশ্ব যখন অভাবনীয় কোণঠাসা হয়ে আছে।তখন তো সাহায্যের আশায় একটি দ্বারে ফিরে আসার তাগাদা প্রবলই হচ্ছে।
যদিও মানুষের প্রবলেম হল—হিম্মতের ঘাটতি। কিছু শর্ত মেনে শোকর আর ছাবারকে সাথে নিয়ে স্রষ্টার নির্দেশিত ও প্রদর্শিত পথে চলার হিম্মত প্রয়োজন।আজ সে সাহসেরই নিতান্ত কমতি।
অবশ্য বস্তুবাদী (জড়বাদী), সংশয়বাদী ইত্যাদির গল্প ভিন্ন। তারা আশ্রয় নিবে তাঁদের প্রভুদের কাছে, বিজ্ঞানী আর নেতাদের কাছে। যারা দুনিয়াকে সাজাতে বার বার হোঁচট খাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে তছনছ করছে। বিশ্বকে তাঁরা বিস্ময় আর চমক ও ঝলক দেয় নিশ্চয় কিন্তু এ সবের নিচে থাকে আতঙ্ক ও শঙ্কা আর বৈষম্য।
সচেতন মুসলিমদের গল্প ভিন্ন। তাঁরা সুখে—আনন্দের সাথে শোকরিয়াকে প্রশ্রয় দেন আর দুঃখে—বেদনার সাথে ছাবার (সবর)-এর আশ্রয় নেন। তেমনি তাঁরা—বিপদে ও মুছিবাতে, আল্লাহর ভয় ও তাঁর সাহায্য পাওয়ার সমূহ পথ ও পাথেয়ের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। কারণ প্রকৃত মুসলিম কখনো নিরাশ ও হতাশ হয় না। তবে তাঁরা কোন জড় জগৎ অথবা বস্তু জগতের আশায় পড়েও থাকে না বরং তাঁদের আশার একমাত্র ঠিকানা খোদ স্রষ্টা। যিনি কৃপাময়। যিনি করুণাময়। যিনি দয়ালুদের দয়ালু।
বিপদ যত বহুল ও সংকুল এবং প্রচন্ড হয়, প্রকৃত মু’মিন মুসলিমের অন্তরের অন্দরের ঈমান তত জেগে উঠে।
তখন সে রাব্বুন ঘাফূরুন—এর কাছে মেলে ধরা হাতকে আরো বিস্তৃত করে।
তখন সে ছাদাক্বাতের নিমিত্তে মুক্ত করা হাত আরো অবারিত করে।
তখন সে ছালাতে (নামাজে) অবিচল দাঁড়িয়ে থাকাকে প্রলম্বিত করে।
তখন সে নিপট অনাবিল ইবাদাতকে সুসংহত করে।
তখন সে আচরণ, চরিত ও স্বভাবকে শাণিত ও সুশোভিত করে। তখন সে বিশদ ইসতেঘফারকে আরো যথাযথ ও দীর্ঘায়িত করে।
তখন সে সিজদা ও সুজূদে কপালকে নুয়ে দিয়ে আশ্রয় চাইতেই থাকে।
তখন সে অয়নে ললাট ঠেকিয়ে বিনীত আবদার ধরে কাঁদে।
তখন স্রষ্টার ভয়ে তাঁর রোদনে জোয়ার উঠে। তাঁর নিখাদ তাওবায় বাস্তবতা আসে।
মু’মিনরা এজন্য এসব করে থাকেন কারণ তাঁদের পালনকর্তা তাঁদেরকে তাই করতে উদ্বুদ্ধ ও প্রবুদ্ধ করেছেন।
৬০টি আয়াত বিশিষ্ট কুরআনুন করীমের ৩০ নাম্বার সুরা হচ্ছে আর-রূম। এ সুরার ৪১ নাম্বার আয়াতে পৃথিবীর বিপর্যয়ে আল্লাহর দিকে ফিরে আসতে মানুষকে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। তেমনি আপদ ও দুর্দশায় ফিরে আসতে উৎসাহিত করা হয়েছে ৩২ নাম্বার আস-সিজদাহ সূরায়। মক্কী এ সূরায় ৩০টি আয়াত রয়েছে এবং ২১ নাম্বার আয়াতে সে প্রত্যাবর্তন বা আল্লাহর কাছে ফিরে আসার পরামর্শ রয়েছে।
উল্লিখিত দুটো আয়াতের শেষ অংশে বলা হয়েছে :
لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ
(যাতে তাঁরা ফিরে আসে)
এ বাক্যের মর্মে বলা যেতে পারে যে, সাময়িক আপদ দিয়ে অথবা বিপদে ফেলে—সৃষ্টিকর্তা তাঁর সৃষ্ট মানুষকে তাঁর দিকে ফিরিয়ে নেয়ার অথবা তাঁর আরো কাছে নেয়ার সুযোগ দিয়ে থাকেন।
এ যেন রহমানী এক প্লান। আর তাতে সচেতনরা শুধরে যাবার সুযোগ পান।
এ ফিরে আসার প্রেরণা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কুরআনের অপরাপর জায়গায়ও দেওয়া হয়েছে।
নিশ্চয়ই এটি উপলব্ধি এবং অনুধাবনের বিষয় যে; এক, একক ও অদ্বিতীয় সৃষ্টিকর্তা কত বেশী মেহেরবান ও দয়ালু হলে পর এরকম বলতে পারেন। বান্দাকে তাঁর কাছে ফিরিয়ে নেয়ার সুযোগ করে দিতে পারেন।
আসলে তো মানুষই এই বিপদ ও বিপর্যয়ের আবহ সৃষ্টি করে। মানুষ তার অসতর্ক,অসঙ্গত,অবিবেচক এবং অপরিণামদর্শী কর্ম ও আচরণ দ্বারা অপরিহার্য মুসিবত ও সংকট ডেকে আনে। তারপরও স্রষ্টা তাঁর অপরাধী,সীমালঙ্ঘনকারী,
অনিষ্টকারী,পাপী ও দোষী মানুষকে পুরো ধ্বংস,আস্ত বিনাশ, সমূহ নাশ,সমুদায় বিলুপ্ত ও বিলোপ, সম্পূর্ণ নির্মূল ও সমাপ্তি ঘটিয়ে এ জগত সংসারকে এখনই সংহার করে দিচ্ছেন না।
বরং মানুষকে আরো সুযোগ দিচ্ছেন,আরো সময় দিচ্ছেন।এ সুযোগ—তাঁর দিকে ফিরে আসার।এ সময়—তাঁর কাছে চলে আসার।
ফিরে আসার সোজা কথা হল,পাপ কে না বলা। কৃত পাপ সমূহের জন্য অনুতপ্ত হওয়া। পাপ ছেড়ে সঠিক পথে যাত্রা করা। পূণ্য ও পবিত্র জীবন যাপন করা এবং গোনাহ ছেড়ে কুরআন ও সুন্নাহকে অবলম্বন করা।
ব্যস! এইতো হল ফিরে আসা।
এ তো ছিল একজন সাধারণ মুসলিম বা পাপী মুসলিম যিনি ছোট অথবা বড় গোনাহ দ্বারা নিজেকে অপমানিত এবং সমাজকে কলুষিত করছিলেন তাঁর ফিরে আসার কথা।
কিন্তু যিনি অমুসলিম তার ফিরে আসা মানে ইসলামে ফিরে আসা। এবং তার বা তাদের ইসলামে ফিরে আসা,ইসলামের দিক থেকে খুব সহজ। তার ফিরে আসাতে হয়ত দেরি হবে কিন্তু তাকে স্বাগত জানাতে মোটেই দেরী হবে না।
কারো লাল চোখের শাসানোতে নয়, কোন প্রলোভনে প্রভাবাচ্ছন্ন হয়ে নয়, চাপা কোন লিপ্সায় লোভাতুর হয়ে নয়,বরং সত্যের আকর্ষণে, অন্য সব কিছুকে বিসর্জন দিয়ে যখন কেউ সত্যাশ্রয়ী হয় তখন তাঁর সে ত্যাগকে মূল্যায়ন ও সমাদর করা হয়।মহামহিম আল্লাহ,সেই মানুষটির পিছনের সব পাপকে মার্জনা করতে বিলম্ব করেন না। লোকটি যদি শতবর্ষীও হয় তবুও তার পশ্চাতের সুদীর্ঘ সময়ের অজস্র, অসংখ্য এবং নিরন্তর গোনাহকে মুছে দেওয়া হয় কারণ সে তো ফিরেনি অন্য কারো কাছে বরং সে তো ফিরেছে আল-ঘাফুর (পরম মার্জনাকারী) -এর কাছে।
সে তো ফিরেছে আল-ঘাফফার (অতি ক্ষমাশীল)-এর কাছে। এবং সে তো ফিরেছে আল-ওয়াদুদ-এর কাছে, যিনি (বান্দাদের প্রতি) সদয়, প্রেমময়, পরম-স্নেহশীল।
লেখক: মুফতি