শ্রমজীবী মানুষ এবং অভিবাসনবান্ধব রাজনৈতিক দল হিসেবে ব্রিটিশ লেবার পার্টির সাথে শুরু থেকেই সম্পৃক্ততা ব্রিটিশ মুসলিম এবং বৃটেনের বাংলাদেশী কমিউনিটির। একই কারণে বৃটেনের বাংলাদেশী কমিউনিটি ও মুসলিম কমিউনিটির বৃহৎ অংশও তাই লেবারের সমর্থক ও ভোটার। তাছাড়া কট্টর জাতীয়তাদী বা ডানপন্থী রক্ষণশীল কনজারভেটিভ পার্টির বদলে স্যোশাল ও ওয়েলফেয়ার ভ্যালুজের উপর প্রতিষ্ঠিত লেবার পার্টি শুধু মুসলিম ও বাংলাদেশীই নয়, প্রায় সব দেশের মাইগ্র্যান্ট তথা বিএমই কমিউনিটির পছন্দ ও ভরসার দল। কিন্তু জনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে আমেরিকার সাথে ইরাক যুদ্ধে অংশ নেওয়াসহ নানা বিতর্কিত পলিসির কারণে অনেকেই লেবার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। তবু বাংলাদেশী ও মুসলমানদের বিশাল একটি অংশ এখনো লেবার পার্টি করেন এবং লেবারের মাধ্যমে তাদের প্রত্যাশা পূরণে এখনো আশাবাদী। কিন্তু আসন্ন স্ন্যাপ ইলেকশনে তাদের পছন্দের দল লেবারকে নিয়ে তারা পড়েছেন মহাবিপদে। প্যালেস্টাইনে ইসরাইলী জেনোসাইডের নিন্দা না জানানো এবং তা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ার বিপরীতে ইসরাইলের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন এমনকি ইসরাইল কর্তৃক প্যালেস্টাইনীদের ফুড, ওয়াটার ও ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই বন্ধ করে দেয়ার মতো অমানবিক কাজের প্রতি লেবার লিডারের সমর্থন শুধু মুসলিমই নয় পুরো বিশ্বের মানবতাবাদী মানুষকে বিস্মিত ও মর্মাহত করেছে। আর সম্প্রতি “অবৈধ অভিবাসী” বিতাড়নে কেবল বাংলাদেশীদের নাম উল্লেখ করে ব্রিটিশ বাংলাদেশীদের চরমভাবে আহত করেছেন লেবার লিডার। আর তাই নির্বাচনকে সামনে রেখে বেশ মানসিক টানাপোড়েনে পড়েছেন মুসলিম ও বাংলাদেশী ভোটাররা।
আসন্ন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট নির্বাচনে ফিলিস্তিন ইস্যুতে মুসলিম ভোটারদের বৃহদাংশ এবং সম্প্রতি “অবৈধ” অভিবাসন ইস্যুতে কথা বলতে গিয়ে বাংলাদেশীদের হাইলাইট করায় চরমভাবে মর্মাহত বাংলাদেশী কমিউনিটিও পড়েছে দারুণ দোটানায়! মুসলিম ভোটার বৃহৎ একটি অংশ স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বেছে নেওয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ব্রিটিশ ভাবী প্রধানমন্ত্রী মুখে একটি বিতর্কিত ও অপমানমূলক বিষয়ের উদাহরণ হিসেবে কোনো দেশ বা জাতির নাম কি সুখকর? তাই ক্ষুদ্ধ বাংলাদেশীরাও লেবার লিডারের এমন হেয়মূলক আচরণের সমোচিত জবাব দেয়ার জন্য উদগ্রীব। বিশেষ করে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটসের ভোটাররা বিষয়টি নিয়ে বেশ ভাবিত। দলীয় নেতার এমন আচরনের প্রতিবাদে টাওয়ার হ্যামলেটস লেবার গ্রুপের ডেপুটি লিডার সাবিনা আখতার পদত্যাগ করেছেন। টাওয়ার হ্যামলেটসের বাসিন্দারা ইতোপূর্বে লেবারের এমন আচরণের জবাব বেশ শক্তভাবেই কয়েকবার দিয়ে দেখিয়েছেনও।
এটা অনেকেই জানেন যে, এই লেবার আর সেই লেবার নেই। যুদ্ধবাজ টনি ব্লেয়ারের নেতৃত্বে নিউ লেবার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই লেবার ও কনজারভেটিভি পার্টির মধ্যে তেমন ব্যবধান নেই বলে রাজনৈতিক সচেতন মানুষমাত্রই বুঝতে পারছেন। তাছাড়া উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনা বাড়ার পর থেকে সবদেশই অভিবাসন নীতি কঠোর থেকে কঠোরতর দিকে এগোচ্ছে। অথচ এই মাইগ্র্যান্ট সমস্যার বড় কারণ হচ্ছে যুদ্ধ। বিশেষ করে ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া ও লেবানযুদ্ধ ইউকে তথা ইউরোপ ও আমেরিকায় অভিবাসন প্রত্যাশীর ভিড় বাড়িয়েছে। আর কিছু দেশের স্বৈরতন্ত্রী সরকারের অত্যাচারে সামান্য স্থিতি ও শান্তির অন্বেষায় মানুষ পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এরপরও যদি যুদ্ধবাজ দেশ ও স্বৈরতন্ত্রী দেশ পালিয়ে বেড়ানো এসব মানুষদের অনিচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো তৃতীয় দেশে প্রেরণ কিংবা অনিশ্চিয়তায় ভরা স্বদেশে ফিরিয়ে নেওয়ার চুক্তিতে সম্মত হয়, তা কি মানবিকভাবে মেনে নেওয়া যায়?
এ প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের মধ্যে “অবৈধ অভিবাসী”দের ফেরত পাঠাবার যে চুক্তি হয়েছে সে বিষয়টিও পরিষ্কার হওয়া দরকার। অনেকের জানার ইচ্ছে, এই যে চুক্তি হলো সেটি শুধু কি বাংলাদেশের সাথে নাকি অন্যসব দেশের সাথেও চুক্তি এভাবে চুক্তি হয়েছে? কারণ বৃটেনে শুধু বাংলাদেশীরা নন বিভিন্নভাবে আসা পৃথিবীর প্রায় সবদেশেরই মাইগ্র্যান্ট রয়েছেন। আর বর্তমানে বৃটেনের “ইল্লিগ্যাল মাইগ্র্যান্ট” ইস্যুতে যে তোলপাড় শুরু হয়েছে সেটি সাগর পাড়ি দিয়ে স্মল বৌট বা নৌকায় আসাদের নিয়ে। কিন্তু সেই নৌকায় আসাদের তালিকায় বাংলাদেশীরা নাম নাই বললেই চলে। নৌকায় আসাদের তালিকায় আফগানিস্তান, ইরান, ইরাক, সিরিয়া, তার্কি ও অন্যান্যদের রেকর্ড সর্বোচ্চ। এখন প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের পূর্বে বা পরে সেইসব দেশের সাথে কি বৃটেন সরকার এধরণের কোনো চুক্তি করতে পেরেছে। না করে থাকলে আমাদের এতো তাড়াহুড়ো করে তা করার যুক্তিইবা কী? আমাদের দেশ কি সত্যি সিঙ্গাপুর বা সুইজারল্যাণ্ড হয়ে গেছে। যদি হয়ে থাকে চলুন আমরাও ফিরে যাই আমাদের “সোনার বাংলায়”। আর যদি তেমনটি না হয় তাহলে এই চুক্তি দুর্বল ও গরীব দেশের অপারদর্শী ও অপরিণামদর্শী কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডেরই নজীর।
আরেকটি বিষয় হলো যে, কেউ কেউ মনে করেন এবং মানুষকে এমন ধারণা দিতে চান- এবার লেবার ক্ষমতায় যাবে সেটি নিশ্চিত। একই সাথে সাবেক চার বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত এমপির সাথে আরো ২/১ জন যুক্ত হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে তাদের কেউ কেউ মন্ত্রীও হতে পারেন। হলে হতেও পারে। অনেক আগ থেকে বিভিন্ন জরীপে লেবারের ক্ষমতায় যাওয়ার অধিক সম্ভাবনার কথাটি বারবার প্রকাশ পেয়ে আসছে। তবে এটা লেবার নেতৃত্বের ক্যারিশমায় নয়, কনজারভেটিভের বিভিন্ন ব্যর্থতা ও অন্তঃকলহের কারণেই ঘটছে, সেটি লেখার প্রারম্ভেই বলে এসেছি।
আর লেবার ক্ষমতায় গেলে আমরা যে মন্ত্রী পেতে পারি, সে বিষয়ে আমার বক্তব্য হলো- আমরা তা অবশ্যই ডিজার্ভ করি। আমাদের প্রতিনিধিদের যোগ্যতা এবং আমাদের কমিউনিটির বিভিন্ন অবদানের রেকর্ডের ভিত্তিতে অবশ্যই তা প্রাপ্য। তাই বলে সেটির জন্য লেবার বা লেবার লিডারের অগ্রহণযোগ্য আচরণের প্রতিবাদ বা সমালোচনা থেকে বিরত কিংবা তাদের দয়ার প্রতি তাকিয়ে থাকতে হতে হবে কেন? যিনি ভবিষ্যতের পদপদবী বা কোনো প্রাপ্তির প্রত্যাশায় চলমান জাতীয় বা মানবিক ইস্যুতেও চুপ থাকেন তিনি কি ভবিষ্যতে পলিসি বদলানোর মতো কঠিন কিছু করার সাহস দেখাতে পারবেন? আমিতো তাতে ভরসা করতে পারছি না। আর যারা প্রতিবাদের বিপরীতে চুপ থাকাকে বুদ্ধিমানের কাজ মনে করেন, সেই তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই- যে লেবার আমাদের প্রথম এমপি হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো দয়া প্রদর্শন করেনি তারা কীভাবে আমাদের মন্ত্রীত্ব দিতে দয়াবান হবে? আমরা কি ভুলে গেলাম, স্কটল্যাণ্ড থেকে আসা একজন রাজনৈতিক জর্জ গ্যালওয়েকে দিয়ে লেবারকে চ্যালেঞ্জ করেই তবে আমাদের লেবার থেকে এমপি প্রার্থী পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হয়েছে। আর টাওয়ার হ্যামলেটসে আমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে নেতৃত্ব থেকে দূরে রাখতে লেবারের মূলধারা যা করেছে, সেটি না হয় নাইবা বললাম।
পরিশেষে বলতে চাই, সভ্য দেশে কোনকিছুর প্রতিবাদে কেউ কাউকে মারতে যায় না। সাধারণ মানুষ গণতান্ত্রিকভাবে সভা-সমাবেশ করে প্রতিবাদ জানান এবং জনমত গঠন করেন। বিবেকবান দায়িত্বশীলরা পদত্যাগ করে সর্বোচ্চ নজীর পেশ করেন। আর তাই ইতোমধ্যে ফিলিস্তিন ইস্যুতে স্যোশাল ও হিউম্যান ভ্যালুজের বিপরীতে অবস্থানকারী লেবার ছেড়েছেন অনেক রাজনৈতিক। এমনও অনেকে আছেন যারা দলত্যাগ না করলেও প্রতিবাদ স্বরূপ উচ্চপদ থেকে ইস্তেফা দিতে মোটেও পিছপা হননি। এমনই একজন হাইপ্রোপাইল এমপি জেস ফিলিপস। এই এমপি লেবার ফ্রেণ্ডস অব ইসরাইলের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও প্যালেস্টাইন ইস্যুতে ফ্রন্টবেঞ্চ থেকে পদত্যাগ করে এক অনন্য নজীর স্থাপন করেছেন। তাঁর কী এমন দায় ছিলো এমন ভালো একটি পজিশন ছেড়ে দেওয়ার? নিশ্চয়ই তাঁর কাছে সুবিধা নেয়ার চেয়ে মানবিকতা প্রদর্শন প্রাধান্য পেয়েছে।
ফিলিস্তিনের মানুষের উপর বর্বরতম ইসরাইলী গণহত্যা বন্ধে সম্মিলিত দাবী উত্থাপনের পরও কিয়ার স্টারমারের নেতৃত্বাধীন লেবার কোনো ভূমিকা না রেখে উপরোন্তু ইসরাইলের প্রতি বারবার সমর্থন ব্যক্ত করার মতো অমানবিক ইস্যুত শুধু মুসলমান নয়, সব ধর্ম-বর্ণের মানুষকেই আশাহত ও আহত করেছে। অনেকেই ইতোমধ্যে লেবার থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন কিংবা তাদের কেউ কেউ পজিশন ছেড়ে দিয়েছেন। এসব পদত্যাগী রাজনীতিক, ফিলিস্তিন ইস্যুতে মুসলিম এবং সাম্প্রতিক “অবৈধ অভিবাসী” ইস্যুতে আহত বাংলাদেশী ভোটারা লেবারকে না বলা বা রিজেক্ট করাটা কোনভাবেই ভুল কিংবা অযৌক্তিক নয়। ভোট যখন দিতেই হবে তখন কোনো স্বতন্ত্র বা ছোট দলের প্রার্থীদের তাদের অনেকেই বেছে নিতে পারেন। শুধু বিজয়ী দেখে ভোট দিতে হবে সেটি অনেকের কাছে একটি স্থুল চিন্তা। তাদের মতে, কিয়ার স্টারমারকে একটি শক্ত মেসেজ দিতে এই নির্বাচনই একটি মোক্ষম সময়। যাতে কিয়ার স্টারমার প্রধানমন্ত্রী হলেও পাবলিক সেন্টিমেন্টের বিষয়টি ভুলে না যান।
লেখক: কবি, লণ্ডন থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সুরমার বার্তা সম্পাদক।