প্রায় ১১ বছর একটি ঘরে বসবাসের পর সম্প্রতি অন্য আরেকটি ঘরে স্থানান্তরিত হলাম। যদিও উভয় ঘরের দুরত্ব খুব বেশী নয় তবুও এ স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় যে সমস্ত কাজ করতে হয়েছে তাতে এটা উপলব্দি করতে পেরেছি যে, দূরে হউক আর কাছে হউক স্থান পরিবর্তনের কর্মযজ্ঞ প্রায় সমান। শুধু যাতায়াতের সময়টাই ব্যতিক্রম। আমার মনে হয় যারা বিভিন্ন সময় ঘর বদল করেছেন তারা সবাই এ বিষয়টি সম্পর্কে কমবেশী অবগত।
পুরাতন আবাসস্থল থেকে আমার নতুন ঠিকানায় বাসে গেলে এক স্টপ এবং হেঁটে গেলে ২ মিনিটের রাস্থা। তা ছাড়া আমার নতুন আবাসস্থল পুরাতন ঘরের পার্শ্ববর্তী রাস্থা দিয়েই যেতে হয়। তাই অনেক সময় পুরাতন ঘরের কাছে আসলে এতদিনের নানা স্মৃতি মনের মধ্যে ভেসে উঠে। এমতাবস্থায় কোন কোন সময় সেখানে একটু দাঁড়াই এবং চতুর্দিকে তাকাই। কিন্তু দেখতে পাই সবকিছু আগের মতই আছে শুধু আমি নই সেখানে। মনের মধ্যে তখন কোন কিছু হারানোর মত একটা বেদনা অনুভূত হয়। তবে সেটা খুব বেশীক্ষণ স্থায়ী হয়না। তাই নতুন গন্তব্যেই চলে যাই অবলীলায়।
একদিনের ঘটনা। আমি নতুন ঘরের দিকে যাচ্ছিলাম। কিন্তু কেন জানি আনমনা হয়ে চলে যাই সেই পুরাতন ঘরের দিকে। বারান্দায় গিয়ে যেইমাত্র দরজার কড়া নাড়বো সে সময়ই সম্বিত ফিরে পাই। মনের মধ্যে ভেসে উঠে আমিতো আর এখানের বাসিন্দা নই। তখন চলে যাই নতুন ঠিকানার উদ্দেশ্যে। এভাবে আরো বেশ কয়েকদিন আমার মতিভ্রম হয়।
যারা চাকুরী করেন বা দেশ থেকে বিদেশে পাড়ী জমান অথবা স্কুল-কলেজে লেখাপড়া শেষ করে চলে যান, তাদের জন্য বিভিন্ন সময় বিদায় সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়ে থাকে। কিন্তু ঘর বদলের পর বিদায় সংবর্ধনার আয়োজনের ঘটনা খুবই বিরল। আমার মনে হয় যারা ঘর বদল করেন তাদের জন্য সংক্ষিপ্তভাবে হলেও বদলকারীদের বন্ধু-বান্ধব কর্তৃক একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা উচিত। আর এর জবাবে যিনি নতুন ঘরে যাবেন তিনিও নতুন ঘরে পৌছামাত্র একটা পার্টির আয়োজন করবেন। এতে পুরাতন বন্ধু-বান্ধবের সাথে নতুন পাড়া-পড়শীদের আমন্ত্রণ জানাবেন। এতে করে সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে একটু জানাশুনা হয়ে যাবে।
এদেশের আরও একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, যারা যেখানেই বসবাস করেন না কেন তাদের পাড়া-প্রতিবেশীর সাথে তেমন একটা সম্পর্ক সৃষ্টি হয় না। ভিন্ন জাতীর লোকজন দূরের কথা স্ব-জাতীর অনেকের সাথেও শুধুমাত্র ‘হায়-হ্যালো’ ছাড়া তেমন একটা ভাব জমে উঠে না। বছরের পর বছর এভাবেই কেটে যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে এটা বংশ পরম্পরায় চলতে থাকে। কিন্তু তেমনটি হওয়া উচিৎ নয়। আমরা সমাজবদ্ধ মানুষ হিসাবে যারাই আমাদের পাড়া-প্রতিবেশী তাদের সাথে সু-সম্পর্ক অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আর এ প্রয়োজনীয়তার কথা আমাদের ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্বসহকারে বলা হয়েছে। মনে রাখতে হবে যে, দূরবর্তী স্থানে অবস্থানরত আমাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনদের চাইতে পাড়া-প্রতিবেশী অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নানা বিপদে-আপদে তারাই প্রথমে এগিয়ে আসেন।
সে যাই হোক, ঘর বদল করতে গিয়ে ঘরের সমস্ত জিনিষপত্র স্থানান্তর করার সময় খুবই ঝামেলায় পড়তে হয়। ভ্যানগাড়ীতে এগুলি তুলতে গিয়ে দেখা যায় একটা না একটা কিছু রয়েই গেছে। এক বা দুই ট্রিপে তা শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা শেষ হচ্ছে না। এ সময় অনেক কিছু নষ্ট হয়ে যায় বা নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ সময় কিছু কিছু পুরাতন জিনিষপত্র ফেলে দিতে হয়। তবে এদেশে এগুলি যত্রতত্র ফেলে দেয়া যায় না। নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে ফেলে দিতে হয়। এ জন্য পরিবহন বাবদ আলাদা মাসুল দিতে হয়। এরপর নতুন অনেক কিছু ক্রয় করতে হয়। এ জন্য বাড়তী খরচ হয়। এর ফলে নির্ধারিত বাজেটে ঘাটতি পড়ে। যা পুর্ণ করতে গিয়ে অনেককে হিমশীম খেতে হয়। পরিবারে অনেক সময় টানাপুড়েন সৃষ্টি হতেও দেখা যায়।
এ দেশে ঘর বদলের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলি হচ্ছে, বিভিন্ন সেবা সংস্থা সমূহের সাথে যোগাযোগ করা। গ্যাস, পানি, ইলেক্ট্রিসিটি, টিভি লাইসেন্স, ব্যাংক-বিমা, প্রভৃতির সাথে যোগাযোগ ও ঠিকানা পরিবর্তন করতে গিয়ে একাধিকবার যোগাযোগ করতে হয় বা চিটি লিখতে হয়। এ ব্যাপারে বেশী প্রয়োজন বলে মনে করলে কয়েকমাসের জন্য ডাক বিভাগের ‘রিডাইরেকশন সার্ভিসের’ সাহায্য নিতে হয়। এ সার্ভিসের জন্যও আলাদা চার্জ রয়েছে।
লেখক : যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক, ইস্টউড অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্ত কলামিস্ট ও সম্পাদক মাসিক দর্পণ।